‘‘আমরা নরম কোমল, সেলফ ডিফেন্স কেন শিখবো’’- এ মানসিকতার উৎস কোথায়?
মেহেরুন নূর রহমান।। সেদিন একটা লেখা ভাইরাল হয়ে আমার ওয়ালে চলে এসেছিল। ২০/২১ বছরের একটা মেয়ের লেখা। লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে, এই যে চলমান ধর্ষণের সংস্কৃতি, এর থেকে বাঁচার জন্য কেন সবসময় মেয়েদের বলা হচ্ছে সেল্ফ ডিফেন্স শিখতে, কেন বলা হয় কারাটে শিখতে? মেয়েটি লিখেছে সে নরম এবং কোমল। তার দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগেনা। সে দৌঁড়ে বাসে উঠতে পারে না। বাস সম্পূর্ণ থামার পর আস্তে ধীরে তাকে বাস থেকে নামতে হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা রকম কোমলতার বর্ণনা সে করেছে। তার প্রশ্ন হলো- কেন সবাই মেয়েদের নিজেদেরকে নিজে রক্ষার ব্যাপারে এতো জোর দিচ্ছে? সে নিজেকে চেঞ্জ করতে চায় না, সে যেমন তেমনই থাকবে। সে মনে করে- কী করে আইন-শৃঙ্খলা উন্নত করে, ধর্ষকদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সেটা নিয়ে সবার বেশি করে বলা দরকার।
লেখার নিচে অসংখ্য মেয়ের কমেন্টস এবং আমি মনে করি তারা এই মেয়েটির সমবয়েসী হবে। সে সব মেয়েদেরও একই ধরনের কথা। তারাও খুব নরম, কোমল, তারা চিৎকার করে কথা বলতে পারেনা, তারা দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না, কী করে তারা সেল্ফ ডিফেন্স শিখবে? আমার অর্ধেক বয়সের মেয়েদের কমেন্টগুলো পড়তে পড়তে আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” হেলাল হাফিজের যে কাব্য বাক্য আমাদের কানে মন্ত্রের মত বাজত তা কি এই প্রজন্মের জন্য মিথ্যে হয়ে গেছে?
যে বয়সে পৃথিবী জয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে, যে বয়সে সকল অন্যায় দুমড়ে-মুচড়ে চুরমার করে দেবার মতো দুর্দমনীয় ইচ্ছা জাগে, সেই বয়সে মেয়েরা যদি বলতে থাকে আমি কোমল, আমি নরম, আমাকে কেন তোমরা কঠিন কিছু করতে বলছো তখন সত্যিই ভীষণ হতাশ লাগে। কেন এরকম একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে আমাদের দেশে? কেন আমরা এত কম সাহসী মেয়ে দেখি আমাদের চারপাশে?
বিভিন্ন প্রতিবাদ মিছিলে জ্বলজ্বল করে নেতৃত্ব দেওয়া, প্রতিবাদে ফেটে পড়া মেয়েগুলির উজ্জ্বল মুখ দেখে গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। আমার মেয়ে নেই। সে কষ্ট আমার সবসময়ের। কিন্তু যদি মেয়ে হতো, তবে আমি এসব নরম কোমল মেয়েদের চেয়ে ঝড়ের মত, আগুনের মত, সূর্যের মত মেয়ে প্রত্যাশা করতাম।
এসব মেয়েদেরও দোষ আমি দেব না। তারা বড় হয়েছে এমনভাবে। এতো প্রটেক্টেডভাবে পরিবার তাদের বড় করেছে যে তারা আসলে নিজেকে সম্পূর্ণ মানুষ ভাবতেই শেখেনি। তারা পরনির্ভরশীল। তারা ভেবেই নেয় জীবনটা যাবে অন্যের কাঁধে ভর করে। পড়াশোনা শিখবে তারপর স্বামীর ঘাড় চেপে জীবন পার করে দেবে। কেউ কেউ ৯টা-৫টার রুটিনবাধা কোন জব করবে, কিন্তু তারপরও সবকিছুর জন্য স্বামীর উপরই নির্ভর করবে।
যে মেয়েটি এই লেখাটি লিখেছে বা যারা এই লেখাকে সাপোর্ট করছে তারা কোনদিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে না। তারা ভাবে দেশ তাদের রক্ষা করবে, সরকার তাদের রক্ষা করবে, কিংবা রক্ষা করবে তাদের ভাই বা ছেলে বন্ধু। তার নিজেরা কেন নিজেদের কষ্ট করে রক্ষা করার চেষ্টা করবে? তাদের মাথায় এতটুকু বুদ্ধি নাই বুঝতে যে চাইলেই রাতারাতি আমরা একটি সমাজ পরিবর্তন করে ফেলতে পারি না। চাইলে আগামীকালকেই আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা উন্নত করে ফেলতে পারি না। সুতরাং যতদিন না এটা হচ্ছে সেল্ফ ডিফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি। উন্নত বিশ্বেও যেখানে আইন-শৃঙ্খলা আমাদের দেশের তুলনায় কয়েকশত গুণ ভালো, সেখানেও মেয়েদের সেল্ফ ডিফেন্স শিখতে বলা হয় যে কোন খারাপ পরিস্থিতিকে মোকাবেলার জন্য। এবং এটা ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য।
মেয়েদের এই মানসিকতা তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কারা জানেন? তাদের পরিবার এবং বাবা-মা। তুলুতুলু করে বড় করা হয় এদের। এখানে যেওনা, ওর সঙ্গে কথা বলোনা, রাত করে ফিরোনা, এটা মেয়েদের জন্য ভালো না, ওটা মেয়েদের জন্য ঠিক না- এরকম অসংখ্য অসংখ্য ‘না’ এর ভেতর দিয়ে তারা বড় হয়। এভাবে বড় হতে হতে এদের নিজস্ব কোন আইডেন্টিটি তৈরি হয় না। ভেবে দেখুন আমাদের রূপকথাগুলো, সেখানে রাজকন্যা সবসময় রাক্ষসেরা হাতে বন্দি। রাজপুত্র এসে রাক্ষসকে মেরে তাকে উদ্ধার করে। নাটকে, নভেলে আমরা বেশিরভাগ প্রধান নারী চরিত্রগুলোকে দেখি সুন্দরী, নরম, কোমল, পরিবারকেন্দ্রিক, অন্তর্মূখী এবং সেক্রিফাইসিং, যারা জীবন স্বামী/ প্রেমিক, পরিবার ছাড়া অস্তিত্বহীন। তাদের বাইরের কোন পৃথিবী আছে বলে দেখানো হয় না। তারা প্রতিবাদী হলেও সেই প্রতিবাদ নিয়ম এবং সামাজিক নৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। তারা উদ্দাম নয়, দুর্দমনীয় নয়। আর অন্যদিকে পুরুষ চরিত্রগুলি বহির্মুখী, সাহসী, বীর।
আমাদের সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের লেখায় আমরা নারী চরিত্রগুলোকে দেখি কোমল, মায়াবতী, সুন্দরী, মমতাময়ী। এর বাইরে কোন সাহসী, প্রতিবাদী নারী চরিত্র তিনি চিত্রিত করেছেন বলে মনে করতে পারছি না। আমাদের মেয়েরা বড় হয় এসব লেখা পড়ে। তারা নিজেদের সৌন্দর্য্য, কোমলতা, চামড়া ফর্সা করার ব্যাপারে যতটা যত্নশীল ততটা নিজেদের মানসিক দৃঢ়তা উন্নত করার ব্যাপারে নয়।
একটি ভালো লেখা পড়ছিলাম, সেখানে নারী লেখক লিখেছেন আমরা ছোটবেলা থেকে ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য আর প্রণয় কাহিনীগুলো শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু তিনি যে কত ভালো শাসক ছিলেন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় তার যে কৌশলগত দক্ষতা ছিলো সে সম্বন্ধে কিন্তু আমরা তেমন কিছু জানি না। কথাটা ভীষণ সত্যি। আমরা জানি হেলেন এর জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে কিন্তু হেলেন কেমন ছিল বা সে কী চেয়েছিলো তা কিন্তু আমার জানি না। কতজন বীর নারীর গল্প, রূপকথা আমরা জানি? আসলে নারীদের আমরা বীর হিসেবে দেখতে চাই না। নারীদের আমরা দেখতে চাই পরাধীন, নির্যাতিত, সর্বংসহা চরিত্রে। নারীদের দেখতে চাই শিকলে আবদ্ধ যেখান থেকে অন্য কেউ এসে তাকে উদ্ধার করবে, কোন বীরপুরুষ।
একটা লেখা লিখেছিলাম সিন্ডারেলা সিন্ড্রোম উপর। প্রথমে বলা মেয়েটির লেখা এবং কমেন্টসগুলো পড়ে পড়ে আমার সেটাই মনে হলো যে আমাদের দেশের মেয়েরা কী পরিমাণ সিন্ডারেলা সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। সবকিছুর জন্য পরনির্ভরশীলতা, সবকিছুর জন্য ভাবা অন্য কেউ এসে তার সমস্যার সমাধান করে দেবে। জীবন তো আসলে এত সহজ নয় বা রূপকথা নয় যে রূপকথার মতোই জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যায়। যে মেয়েটি আজ অন্যের উপর নির্ভরশীল সেটা অর্থনৈতিকভাবে হোক বা জীবন যাপনের জন্য হোক, সে মেয়েটির জীবনেও একটা সময় আসবে অপমানের, গ্লানির।
আমি ছোটবেলায় একটা রাশান রূপকথা পড়েছিলাম যেখানে রাজপুত্র বন্দি এক মায়াবিনী ডাইনির হাতে। এক সাধারণ মেয়ে রাজপুত্রকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট আর যুদ্ধ করে রাজপুত্রকে উদ্ধার করে। এমন গল্প, এমন রূপকথার আরো তৈরি হোক যেখানে মেয়েরা সাহসী, যেখানে মেয়েরা নিজে হত্যা করে রাক্ষসকে, তাদের অপেক্ষা করতে হয় না কোন রাজপুত্রের। তারা রক্ষা করতে পারে নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের সাম্রাজ্যকে। আমি বলছিনা গল্প কবিতায় নারীকে শুধু বীর হিসেবেই দেখাতে হবে। নারীকে মমতাময়ী হিসেবে দেখানো হোক, প্রেমিকা হিসেবে দেখানো হোক, কোন সমস্যা নাই, কিন্তু সেটা যেন স্টেরিওটাইপ না হয়ে যায়। সাহসী, প্রতিবাদী, সংগ্রামী মেয়েরা উঠে আসুক আমাদের গল্পের নায়িকা হিসেবে বার বার।
মায়েরা এবং বাবারা দয়া করে মেয়েকে মোমের পুতুল তৈরি করবেন না। তাদের সাহসী করে তুলুন শারীরিক এবং মানসিকভাবে। তাদের শুধু রূপকথার গল্প নয় সেই সাথে বলুন ইলা মিত্রের কথা যিনি সাঁওতাল কৃষক আন্দোলনের জন্য জেলে যাবার পর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের পরও মাথা নোয়ান নি। কাহিনী শোনান প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। জানতে দিন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটকে যিনি সারা জীবন লড়াই করে গেছেন নারীর অধিকারের জন্য। জানান আমাদের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, বীরাঙ্গনাদের কথা। পড়ে শোনান বেগম রোকেয়া। এমনি কতশত নারী আছেন যাদের জীবনকাহিনী প্রেরণাদায়ক। যারা আমাদের ভাবতে শেখায়। সে সব নারীদের গল্প শোনান আপনার কন্যাকে।
পুরুষদের বীরগাঁথার ফাঁকে নারীদের বীরত্বের গল্প কীভাবে যেন চাপা পরে যায়। নারীর সেইসব বীরত্বের গল্প খুঁজে বলুন আপনার কন্যা শিশুকে এবং সেই সাথে আপনার পুত্র সন্তানকেও। যেন তারাও মেয়েদের সাহসী ভাবে। মেয়েরা দুর্বল এই ভেবে করুণা করার ইচ্ছা যেন তাদের না জাগে এবং তারা যেন নিজেদের নারীদের রক্ষাকর্তা না ভাবে।
মেয়েদের বলছি, আপনারাও এসব নারীদের পড়ুন, জানুন। পরিবার আপনাকে যেভাবেই বড় করুক না কেন চাইলে নিজেকে বদলাতে পারেন। শিক্ষিত হন, পরনির্ভরশীলতা আর নয়। জানুন নিজের জন্য নিজেকেই আগে দাঁড়াতে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখেন না হলে পরে পরে শুধু মারই খেতে হবে। মনে রাখবেন আপনার লড়াই আপনাকেই লড়তে হবে। অন্য কেউ আপনার হয়ে লড়তে আসবে না এবং সে আশা করাও বোকামি। চোখ খুলে চারপাশ দেখেন মেয়েরা। আপনি যদি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করেন, নিজেকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে সক্ষম মনে করেন, তবে কোনো প্রতিকূলতা মোকাবেলার জন্য আপনাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না। সহযোদ্ধা হিসেবে আপনার পাশে কেউ থাকতে পারে তবে তার উপর যদি আপনি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হন তবে একসময় তার থেকেও কিন্তু আপনি আর শ্রদ্ধা পাবেন না। কাঁধে বয়ে বেড়ানো বোঝা কেউ পছন্দ করে না। তাই অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজের সিদ্ধান্তে মাথা উঁচু করে সত্যিকারের মানুষের মত বাঁচুন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]