“এমনিতেই তো ডিভোর্স হয়েছে, মানুষ খারাপ বলবে!”
সিদ্রাত মুনতাহা।। ডিভোর্সি। কোনো মেয়ের নামের আগে এই বিশেষণ ব্যবহার করলে যেন নিজের অজান্তেই ভ্রু কুচকে যায়।
মেয়েটাকে খুবই ভালো লেগেছে। এক কথায় বলা যায় মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছেন তবে ডিভোর্সি শোনামাত্রই আগ্রহে ভাটা পড়ে গেল।
এমন কেন হয়? কারণ দুঃখজনক হলেও সত্যি ডিভোর্সকে এখনো অস্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়।
বিয়েসাদী হলে আমরা যেমন সবাই মহানন্দে বলি বিয়ের কথা ডিভোর্সের কথা কিন্তু সাধারণভাবেও বলতে পারিনা।
বিয়ের পর ম্যারিড স্ট্যাটাস দিতে পারি তবে ডিভোর্স হলে ডিভোর্সড স্ট্যাটাস দিতে পারিনা। বিয়ের কথা সবাইকে জানানো যায়। ডিভোর্সের কথা কাউকে জানানো যায়না। কারণ ডিভোর্স শব্দটাই তো অপয়া অলুক্ষনে। ডিভোর্সের কথা জানলে লোকে কী বলবে?
বিয়েতে সবাই অভিনন্দন দেয় আর ডিভোর্স এ মনে মনে সবাই মেয়েটার দোষই খোঁজে।
মা বাবা আত্মীয়স্বজন বলবে ডিভোর্সের কথা কাউকে বলার দরকার নেই, ডিভোর্সের কথা বললে প্রচার হবে বেশি, যারা জানত না তোমার বিয়ে হয়েছিল তারাও জানবে তখন তোমার ফিউচারে বিয়েসাদী হতে সমস্যা হবে। হ্যাঁ বিটার ট্রুথ এই কথাটা প্রায় প্রতিটা ডিভোর্সি মেয়েই শোনে। ডিভোর্সি মেয়েদের এমনভাবে ট্রিট করা হয় যেন তারা ক্রাইম করে ফেলেছে এবং ডিভোর্সি হওয়া একটা অপরাধ।
এমন হাজার হাজার উদাহরণ দেখবেন, একটা মেয়ে উচ্চশিক্ষিত, সাবলম্বী যথেষ্ট গুনবতী তার বিয়ে ঠিক হলো এমন একজনের সাথে যে কিনা তার কাছাকাছি যোগ্যতারও না। এর কারণ কী? কারণ সে ডিভোর্সি। তার তো গায়ে দাগ লেগে গেছে এবং তার উচিত না এখন ভালো কিছু আশা করা। তার অধিকার নেই ইচ্ছেমত কাউকে ভালোবাসার। মুখে মুখে যতই প্রগেসিভ ভাব দেখাইনা কেন চুপি চুপি আমরা সেই মেয়েটার দোষই খুঁজি।
এ ভাবনার পেছনে আমরাই দায়ী। একটা ডিভোর্সি ছেলেকে তো বলা হয়না এটা সেটা মেইনটেইন করে চলতে। অথচ একটা ডিভোর্সি মেয়েকে অহরহই শুনতে হয় “তোমার এমনিতেই ডিভোর্স হয়েছে, এখন ভালোভাবে চলবা, নাহলে মানুষ খারাপ বলবে।”
একটা ডিভোর্সি মেয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেনা,তার দুঃখ বিলাস করতে হবে। ডিভোর্সের পর সে স্বাভাবিকভাবে সুখী জীবনযাপন করলেই মানুষজন বলবে “ঝামেলা নিশ্চয়ই মেয়ের মাঝেই ছিল, ডিভোর্স হয়েছে, কোন দুঃখ কষ্ট নাই”, বা “নিশ্চয়ই মেয়ে পরকীয়া করত,এজন্যই তো ডিভোর্সের পর ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে”
অথচ ডিভোর্সের পর সে কষ্ট পেয়ে ঘরে বসে থাকলে ঠিক আছে। বাই এসে স্বান্তনা দিবে বলবে “থাক মন খারাপ করোনা” তারপর এসে আরেক জায়গায় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাবে আর সেটা মেনে নিলেই মেয়েটা ভালো। অথচ ডিভোর্স নেওয়া একটা ছেলেকে বলা হয় “মেয়ে মানুষের জন্য দুঃখ কষ্ট পাওয়া উচিত না, জীবন এঞ্জয় করা উচিত, মেয়ে মানুষ যাবে আসবে”। বরং একটা ছেলে যদি ডিভোর্সের পর কষ্টে থাকে সেই ছেলেকে নিয়েই মজা নেওয়া হয়। কিন্তু মেয়েটা নিজের মত প্রান খুলে বাঁচলেই যেন মেয়েটা খারাপ।
ডিভোর্স মানে সবসময় খারাপ কিছুনা। ডিভোর্স মানে নবজন্ম। সুখে থাকলে কেউ ডিভোর্স নেয়না। মেয়েটা হয়তো প্রতিদিন স্বামীর কাছে অত্যাচারিত হত। হতে পারে মেয়েটার স্বামী নেশাগ্রস্থ ছিল, পরকীয়ায় আসক্ত ছিল। অসৎ ছিল। হতে পারে মেয়েটার জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় মেয়েটার কি করা উচিত?দিনের পর দিন মানুষের কথার ভয়ে এইসব সহ্য করে থেকে যাওয়া উচিত না বেরিয়ে এসে নিজের মত করে বাঁচা উচিত? প্রত্যেকের সুখ খোঁজার অধিকার আছে।মেয়েটা যদি তার বিয়েতে সুখি না থাকে তার অবশ্যই অধিকার আছে ডিভোর্স নিয়ে নতুন করে বাঁচার। যদি ছেলে ডিভোর্স দেয় তাতেও মেয়েদেরই দোষ খোঁজা হয়। মেয়ের কোনো ঝামেলা আছে নিশ্চয়ই, মেয়ে পরকীয়া করে তাই ছেলে ডিভোর্স দিয়েছে। কেন? ছেলের ঝামেলা থাকতে পারেনা? ছেলে পরকীয়া করতে পারেনা? যৌতুকসহ অন্য সব নানান অন্যায় আবদারজনিত কারণও তো কম না।
সব নেতিবাচক বিশেষন কি মেয়েদের নামের পাশে লাগানোই জরুরি? ডিভোর্স অতি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। একে বাকা চোখে দেখার কিছু নেই। বিয়ে যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার, ডিভোর্সও তেমন স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরাই একে অস্বাভাবিক বানাই এবং ডিভোর্সিদের অস্বাভাবিক চোখে দেখি। আপনি কোনো সর্ম্পকে আছেন, অ্যাডজাস্ট হচ্ছেনা কোনভাবেই, আপনি মোটেও সুখি নন, আপনি কী করবেন? স্বাভাবিকভাবে অবশ্যই সেখান থেকে বেরিয়ে আসবেন। ডিভোর্স ব্যাপারটাও ঠিক তাই। স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ডিভোর্সি মেয়েরা চরিত্রহীন বা ক্রিমিনাল না। বলা যায় জীবনের অন্যান্য দুর্ঘটনার মতই এটাও একটা দুর্ঘটনা আর দুর্ঘটনা কখনো কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটায় না। আপনি কখনো জানবেন না কারোর ডিভোর্সের আসল কারণ কী। কখনো জানবেন না তার ভেতরের অনুভূতি কি।তারপরও আপনি কী করবেন? আপনি নিজের ইচ্ছেমতো যা ইচ্ছে তাই ভেবে বসবেন। একটু ভেবে দেখেন তো এমনটা তো আপনার সাথেও হতে পারত। আর তখন সবাই আপনাকে বাকা চোখে দেখলে আপনি আসলে কেমন বোধ করতেন?
ডিভোর্স নিয়ে জড়তা আমাদের সবারই কাটানো উচিত। আমি ডিভোর্সি এই কথা বলতে আর দ্বিধা নয়, বলে ফেলুন। লুকানোর কিছু নেই। আপনি কোন দোষ করেন নি। ডিভোর্সি নারী হয়ে আপনি ক্রিমিনাল হয়ে যাননি। কেউ জিজ্ঞেস করলে অকপটে বলে ফেলবেন আপনি ডিভোর্সি। আপনার নিজের যত হেজিটেশন কাজ করবে ডিভোর্স নিয়ে মানুষ তত সুযোগ পাবে আপনাকে বলার। তাছাড়াও মানুষকে গোনারও বিশেষ দরকার নেই আপনার। ডিভোর্স হয়েছে বলে কখনোই ভাববেন না আপনার চরিত্রে দাগ লেগে গেছে। বরং ভাববেন আপনি আপনি একজন সাহসী নারী। এ দেশের প্রেক্ষাপটে সব নারীর সাহস হয়না একটা টক্সিস সর্ম্পক থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে বাচার। ডিভোর্সি বলে যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলার মত ভুল সিদ্ধান্তও নেবেন না বরং অপেক্ষা করবেন সঠিক মানুষটির যে আপনার অবস্থান বুঝে আপনাকে সম্মান করে ভালোবেসে সব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]