বৈবাহিক ধর্ষণ কেন “হাস্যরসাত্মক”!
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা।। হাল আমলের ট্রেন্ডি টপিক হিসেবে নয়, একজন নারী এবং নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নারীর সত্তা নিয়ে গবেষণার সূত্র ধরে বেশ ক’বছর আগে থেকেই বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। করোনাকালে যখন নারীর প্রতি ভীষণ মাত্রায় সহিংসতার নানাবিধ তথ্য সামনে চলে আসছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম পত্রপত্রিকার বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি উঠে আসছে। অতি সম্প্রতি স্বামী কর্তৃক ৩৪ দিন ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু হয় আমাদেরই কন্যা নুরুন্নাহারের। বলাবাহুল্য, আমরা এমন এক জাতি যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের চারপাশে কারো মৃত্যু ঘটে, সহিংসতার সর্বোচ্চ নগ্নরূপ আমাদের সামনে চলে আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবাই মুখে তালা দিয়ে থাকি, এটিই আমাদের বর্তমান সময়ের সামাজিক বাস্তবতা।
বিভিন্ন সামাজিক গবেষণা কাজ অথবা জরিপ কোনটাই যখন রাষ্ট্রের নজরে আসে না, গবেষণা এবং পলিসির সম্পর্ক যেখানে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে সেখানে এরকম হওয়ার বিষয়টি একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কেবলমাত্র রেজিষ্ট্রিকৃত ধর্ষণের মামলার সংখ্যা হাজার অতিক্রম করে বছরের পর বছর। তিন বছরের শিশুর যোনীকে ব্লেড দিয়ে কেটে তাকে ধর্ষনের ঘটনা পত্রিকায় পাতায় যখন দৃশ্যত হয়, তখনও আমরা চুপ থাকি। আমরা রিঅ্যাক্ট করি তখনই যখন ভিজ্যুয়ালি বেগমগঞ্জ এর ঘটনা সামনে আসে। কেন জানেন, কারণ আমাদের মন এবং চোখ কাকের মত। আমরা চোখ বন্ধ করে ভাবি কিছু হয় নাই, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকে আমাদের দীর্ঘদিনের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের চাদর। যেখানে যৌনতা, যৌন সহিংসতার বাস্তবতাকে কেবলই আড়ালে রাখাই নারীর ‘সম্মান’ বা ‘ইজ্জত’ রক্ষার একমাত্র মানদণ্ড।
জাতিসংঘ হিউম্যান রাইটস কমিশন ১৯৯৩ সালে বৈবাহিক ধর্ষণ অর্থাৎ ম্যারিটাল রেপকে মানবাধিকার লংঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে। দুই হাজার বিশ সালের শেষ প্রান্তে এসেও বর্তমান বাংলাদেশ “ম্যরিটিয়াল রেপ” নামক বিষয়টির সাথে সাধারণ মানুষের কোন পরিচয় নেই অথবা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই আইন কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি সেটি বিশেষভাবে বোঝা জরুরি।
যাই হোক আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে আসি, যে বিষয়টি নিয়ে এই লেখার তাগিদ অনুভব করছি সেটি হচ্ছে “ম্যারিটাল রেপ” বা “বৈবাহিক ধর্ষণ” কেন হাস্যরসাত্মক, কেনই বা তা আমাদের বিবেচনায় অপরাধ হিসেবে পরিগনিত হয় না?
প্রথমে আসি বৈবাহিক ধর্ষণ কী সে বিষয়ে। যদি এর সাদামাটা একটি উত্তর দিতে হয় তাহলে বলা যায়, যখন বিবাহিত দম্পতির মাঝে সম্মতি ব্যতীত জোরপুর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সেটাকে বলা হয় “বৈবাহিক ধর্ষণ”। প্রশ্ন হলো,শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নারীর যৌন কর্তাসত্তা এই বিষয়ে আমাদের কি কোনো ধারনা রয়েছে কিনা? যেখানে আমাদের সংস্কৃতিতে নারীকে কে শুধুই যৌনবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেখানে নারীর যৌন কর্তা সত্তার ধারণা আদৌ সম্ভব কি?
প্রসঙ্গক্রমে বলছি যৌন কর্তা সত্তা বলতে যেটা বুঝাতে চেষ্টা করছি, সেটি হচ্ছে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা, নারীর শারীরিক চাহিদা, নারীর মানসিক অবস্থান বিবেচনা করে যৌন সম্পর্কে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার যে সক্ষমতা সেটিকে বলা হয় নারীর যৌন কর্তাসত্তা। প্রশ্ন হলো, আদৌ আমাদের সমাজে “শিক্ষিত “বা “অশিক্ষিত”, ” শহুরে “বা “গ্রাম্য”, “নিম্নবিত্ত”,”মধ্যবিত্ত “অথবা “উচ্চবিত্ত” কোন পরিসরেই নারীর এই যৌন কর্তা সত্তা অথবা যৌন বা শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কি? বিশেষত যখন বৈবাহিক সম্পর্কের প্রশ্ন আসে, তখন ক’জন পুরুষ খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি বা যারা তার অর্ধাঙ্গিনীর শারিরীক এবং মানসিক পরিবেশ এবং পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক, তার সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক করে থাকেন? পুরুষের ককথা বাদই দিলাম, সমাজে কজন নারী আছেন যিনি বা যারা বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনে করেন যে তাদের সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ? অথবা আরও যদি বলি নারীর কোনো শারীরিক বা যৌন চাহিদা থাকার বিষয়ে ক’জন নারী মুখ ফুটে নিজের কথা বলতে সক্ষম? নিজের শরীর, নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে দীর্ঘদিন অক্ষম করে রাখার এই রাজনীতির মূল হাতিয়ার হচ্ছে পুরুষতন্ত্র, আর তার সহায়ক নিয়ামক হিসাবে অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যবহার করে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে। যেখানে ভাবা হয়, নারী কেবলই তার স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণের খোরাক, অন্যভাবে বললে, বিবাহিত নারী চাহিবামাত্র স্বামীর যৌন তৃপ্তি পূরণে বাধ্য থাকিবে। এই অদেখা, অলিখিত ডিসকোর্সের আদলেই পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নারী ও পুরুষের মন। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বৈবাহিক ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ প্রসঙ্গটি যখন সামনে আসে তা অনেকের কাছেই হাস্যরসাত্মক, অযৌক্তিক দাবি হিসেবে মনে হতে পারে, যা কিনা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মন্তব্যে খুব দারুণ ভাবে প্রতিফলিত হয়।
বিগত কয়েকদিনের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে দুঃখ নিয়ে বলতে শুনেছি যে সমাজে সাধারণ একটি মেয়েকে ধর্ষণের বিচার হয়না সেখানে বৈবাহিক ধর্ষণের আদৌ কোনো বিচার হবে কি? অথবা সে বিষয়ক আইন করে কোনো লাভ হবে বা ফায়দা হবে কি?
সমস্যার খুব গভীরে যে যদি চিন্তা করা হয় তাহলে আমি বলব, আমাদের সমাজে ধর্ষক তৈরির প্রধান এবং প্রাথমিক পরিসর হচ্ছে পরিবার। একটি ছেলে শিশু ভাবতে শেখে চিন্তা করতে শেখে, নারী হচ্ছে কেবলই যৌনবস্তু, যেখানে নারীর সম্মতি তার যৌন ক্ষেত্রে হোক অথবা পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হোক, সকল সময়ই উপেক্ষিত। যেখানে নারীর যৌনতা বিষয়ক আলাপচারিতা ট্যাবু হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে মা মাত্রই মমতাময়ী সেবাপ্রদানকারী সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেখানে নারীর কোন কর্তৃত্ব থাকা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে খুব সূচারুভাবে আড়াল করে দেয় আমাদের মমতাময়ী মায়ের ডিসকোর্স। এমন কি আমরা কল্পনাতেও ভাবতে পারিনা আমাদের মায়েদের যে যৌন চাহিদা থাকতে পারে, অথবা যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, অথবা যৌন আকাঙক্ষা প্রকাশের অধিকার থাকতে পারে।
“বিবাহ” যেন কেবলি আমাদের সমাজে একজন নারীর সাথে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের একটি সামাজিক বৈধতার চুক্তি হিসেবে আবির্ভূত, যেখানে পুরুষ মাত্রই তার যৌন চাহিদা পূরনে তার স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন, আর নারী সেই যৌনতার খোরাক যোগাবেন। এও সত্য যে আমাদের সমাজে কোনো বিবাহিত নারী মুখ ফুটে যদি একথা বলেন,যে তিনি তার স্বামীর সাথে যৌনভাবে সুখী নন, আইনী ও ধর্মীয় মতে যদিও ওই নারী তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে পুনরায় বিয়ে করতে পারেন, কিন্তু আমাদের বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় কোন নারীর পক্ষে এটি বলা আদৌ সম্ভব কি?
আমাদের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মননে এও বলা হয় যে গৃহ হচ্ছে শান্তির নীড় আর সেই গৃহকে শান্তির নীড় বানায় একজন নারী। যেখানে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পুরুষ সারাদিন পরিশ্রম শেষে গৃহে আসে সুখের আশায়, তৃপ্তির বাসনায়। তাছাড়া আমরা আমাদের বাবাকে সাধারণত দেখে থাকি মায়ের উপর কর্তৃত্ব আরোপ করতে, তা হোক পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, কোথাও ঘুরতে যাবার প্রসঙ্গক্রমে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের পোশাক নির্ধারনে। খুব নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করলে প্রতিটি বিষয় একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আবার আমরা আমাদের মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে দেখে থাকি নারী কেবলি পুরুষের যৌন কামনা বা আকাঙ্ক্ষার একটি পণ্য, যেখানে নারীকে পরিবেশন করা হয় যৌনভাবে নিষ্ক্রিয়, পুরুষের উপর নির্ভরশীল এক সত্তা হিসেবে।
যৌনতার কথা বাদই দেন, লক্ষ্য করবেন আমাদের মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে নারী প্রকৃতির ডাকে বাথরুমে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করে, এরকম কোন দৃশ্য উপস্থাপন হয়না, বরং পরিবেশন করা হয় নারীর গোসলের দৃশ্য অত্যন্ত আকর্ষিত করে, যা দেখে স্বামীর বা প্রেমিকের মনে যৌন আবেদন সৃষ্টি হয়। মিডিয়াতে বারংবার এটিই উপস্থাপন করা হয় নারীর ‘না’ এর মধ্যেই ‘হ্যা’ বা সম্মতি লুকিয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, যৌনতা বিষয়ে, নারীর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলার কোন সুযোগ আদৌ এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা রাখে কি? ঠিক পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার এই ফাঁদের মাঝে আটকে আছে আমাদের বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য না করার প্রবণতা।
এখনই সময় আমাদের সচেতন হবার যেখানে নারীর যৌনতাকে পৃথকভাবে মুল্যায়ন করা ভীষণভাবে জরুরি। নারীর যৌন চাহিদা, যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতি গ্রহণের এই চর্চা যদি পারিবারিক পরিসরে আমরা শুরু না করতে পারি, তাহলে আমাদের পরিবারের ছেলে সন্তানের ভবিষ্যত ধর্ষক মনন রুখে দেবার কোনো রাস্তা আমাদের সামনে নেই। নারীর ‘না’ বলার সক্ষমতা বৈবাহিক সম্পর্ক তথা পরিবার থেকে শুরু করা ভীষণভাবে জরুরি। কারণ ছেলে শিশুটিকে এই শিক্ষা দেয়া ভীষণভাবে জরুরি যে বৈবাহিক সম্পর্ক হোক, আর যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হোক না কেন, যৌনতাবিষয়ক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের সম্মতি ব্যতীত কোন ধরনের যৌন সম্পর্ক করা অন্যায় অপরাধ। তাই “বৈবাহিক ধর্ষণ” কোনো হাস্যরসাত্মক বিষয় নয় বরঞ্চ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতি গ্রহণের গুরুত্ব অনুধাবনে প্রাথমিক এবং প্রধান সোপান, যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ধর্ষক হতে নিরুৎসাহিত হতে শেখাতে পারে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]