পুরুষতন্ত্রকে ঠাট্টা করা ভ্যালেরি সোলানাস, কোনো শৃঙ্খল মেনে নেননি যে
ইমতিয়াজ মাহমুদ।। একজন বিদ্রোহী নারীর কথা বলি। এই মেয়েটি কোন সংগঠনের নেতা ছিল না বা কোন সংগঠিত আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিল না। এই নারীটি পৃথিবীর প্রচলিত প্রথা পদ্ধতি মানতে চায়নি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের শৃঙ্খলাও সে অস্বীকার করেছে। কোন প্রকার শৃঙ্খলাই সে মানেনি। প্রচলিত বিদ্রোহীদের মধ্যেও তো একরকম শৃঙ্খলা থাকে, অথবা বিপ্লবী যারা ওদের মধ্যেও- অথবা যাদেরকে আমরা ছন্নছাড়া বোহেমিয়ান বলি ওদেরও। এই নারীটি কোন শৃঙ্খলাই মানতে চায়নি- কেবল নিজের পছন্দমত নিজের জীবনটি মাথা উঁচু করে যাপন করতে চেয়েছিল আর নিজে পৃথিবীকে যেভাবে দেখেন সেইটা লিখে সকলকে জানাতে চেয়েছিল। অসাধারণ কৌতুকবোধ আর সৃজনশীল ক্ষমতা ছিল, লেখার স্টাইল একটু ধারালোও ছিল বটে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল, সৃজনশীলতাও ছিল তার সকলের চেয়ে ভিন্ন। এইজন্যে এই পৃথিবীর সাথে ওর আর বনিবনা হয়নি- একদিন সকলের চোখের আড়ালে নিভৃতে জীবন ত্যাগ করেছেন।
এই নারীটির নাম ভেলেরি সোলানাস। আমেরিকার নিউ জার্সিতে ১৯৩৬ সনের এপ্রিল মাসে ওর জন্ম। ওর যখন মাত্র চার বছর বয়স, তখন ওর বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর ভ্যালেরি কিছুদিন বাস করেছে ওর দাদা দাদীর সাথে, পরে আবার ফিরে আসে মায়ের সাথে। শৈশবেই ওর প্রতিভা ও রসবোধ দেখা গেছে। মাত্র সাত বছর বয়সেই সে পিয়ানো বাজাতে শিখে যায়। পিয়ানো বাজিয়ে গান করতো- কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো জনপ্রিয় সব গানের কথা বদলে হাসি কৌতুক ধরণের কথা বসিয়ে চমৎকার সব প্যারোডি গাইছে ছোট্ট মেয়েটি।
কৈশোরের শুরুতেই দেখা গেল এই মেয়েটি বিদ্রোহী ধরণের মেজাজ- প্রচন্ড রাগী আর আক্রমনাত্মক। ক্যাথলিকদের যে স্কুলটিতে সে পড়তো, সেই স্কুলের এক নানকে মারধোর করে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয় মেয়েটি। এরপর জীবন থেকে শৃঙ্খলা চলে যায়। পনের বছর বয়সের মধ্যে দুইবার গর্ভবতী হয়ে পড়ে। প্রথমবার নিকটাত্মীয়দের একজনের সাথে আর দ্বিতীয়বার বয়স্ক একজন নাবিকের সাথে। এইসব ঘটনার অনেক পর ভ্যালেরি ওর একজন সাইকোলজিস্ট বন্ধুকে বলেছে, তার মাতাল পিতার হাতেও সে শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। জীবনের এই পর্যায়ে ভ্যালেরি যেন নিজেকে খুঁজে পায়- অচিরেই সে আবিষ্কার করে পুরুষদের প্রতি তার কোন আকর্ষণ নেই, ওর রোম্যান্টিক আকর্ষণ নারীর প্রতিই এবং এই সময়ে একাধিক নারীর প্রতি তার রোম্যান্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই সময় স্কুলে ওর রেজাল্টও বেশ ভাল হতে থাকে। স্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সময় স্কুলের প্রিন্সিপাল ওকে যে সুপারিশপত্র দিয়েছিল, সেখানে প্রিন্সিপাল লিখেছিলেন, ছাত্রী হিসাবে ভ্যালেরি অসাধারণ মেধাবী, দুরন্ত সাহসী আর দৃঢ়চেতা।
মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজি পড়তে যায় ভ্যালেরি। সেখানেও ওকে ওর ক্রোধ আর আগ্রাসী মেজাজের জন্যে অসুবিধায় পড়তে হয় বারবার, কিন্তু পড়ালেখায় সে ছিল অসাধারণ। প্রচন্ড অর্থকষ্টে কেটেছে ওর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন- নিজের জীবন আর পড়াশুনা চালানোর জন্যে কাজ করতে হতো- সম্ভবত যৌনকর্মী হিসাবেও ওকে কাজ করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই লেখালেখিতে ওর আকর্ষণ জন্মে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব কাগজ ইত্যাদি বের হতো সেগুলিতে সে লেখা শুরু করে। এই সময়ই পুরুষপ্রাধান্য, নারীবিদ্বেষ এইসবের বিরুদ্ধে তার আক্রমণ আর চমৎকার রসবোধ সকলের নজর কাড়ে। বুঝাই যায় যে নিজের জীবন নিয়ে তার সকল উদ্বেগ সমাজের প্রতি তার যত ক্রোধ সবকিছু প্রকাশের জন্যেই লেখালেখিকে কাজে লাগাত ভ্যালেরি।
মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করে যখন মাস্টার্স করছিল, সেইসময়ই একদিন ভ্যালেরি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসে। এটা হচ্ছে ১৯৬২ সনের কথা।
নিউ ইয়র্কে কেন? কেননা সেসময় নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচ এলাকায় তখন দুনিয়ার সব বোহেমিয়ান কবি শিল্পী সাহিত্যিক ওরা এসে আখড়া গেড়েছিল। ভ্যালেরি গিয়ে সেখানে যোগ দিয়েছে। সস্তার হোটেলে থাকে, কখনো কখনো সেটাও জোটে না। দেখা যেত যে ছোট টাইপরাইটার একটা নিয়ে একখান থেকে আরেকখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাজ করতো কোন ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে ওয়েইট্রেস হিসাবে। ঐ পয়সায় জীবন চালানো কঠিন। এর মধ্যেই লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রিনিচ এলাকার বোহেমিয়ান সব কবি ও শিল্পীদের ভিড়ে ভ্যালেরি সোলানাস একটা পরিচিত মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৫’তে এসে ভ্যালেরি ওর একটা বড় কাজ, একটা নাটক লিখে শেষ করেছে। নাটকের সংক্ষিপ্ত নাম Up Your Ass- বাংলা করলে এটা কি দাঁড়ায় আমি বুঝতে পারছি না। নাটকটার পুরো শিরোনাম হচ্ছে, Up Your Ass or From the Cradle to the Boat or The Big Suck or Up from the Slime- এগুলিরও বাংলা করাটা সমীচীন মনে হচ্ছে না। নাটকটা হচ্ছে একজন লেসবিয়ান যৌনকর্মীকে নিয়ে। নাটকটা এমনিতে চমৎকার হয়েছে, কিন্তু গ্রিনিচ ভিলেজে বা ঐ এলাকার বাইরে নিউইয়র্কের কেউই এই নাটক মঞ্চে আনতে চাইছে না। ভ্যালেরি নাটকটা কয়েকজনকে পাঠিয়েছে, কেউ যদি নাটকটা মঞ্চস্থ করে, কিন্তু কেউই ঐ নাটক করতে সাহস পাচ্ছে না- ওদের কাছে এই নাটকটি হয়েছে অতিরিক্ত অশ্লীল ইত্যাদি।
যাদের কাছে নাটক পাঠিয়েছে ভ্যালেরি ওদের একজন ছিলেন অ্যান্ডি ওয়ারহল। অ্যান্ডি ওয়ারহল সেই সময় গ্রিনিচে বোহেমিয়ান কবি ও শিল্পীদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তি- পপ আর্টের বিরাট মাস্তান। সিনেমা পরিচালনা করেন, নাটক সিনেমা এইসব প্রডিউস করেন। নতুন লেখক ভ্যালেরি সোলানাস ওর কাছে একটা নাটক পাঠিয়েছে, ভ্যালেরির সাথে ওর তখন পরিচয় নাই। ওয়ারহল সেই নাটক মঞ্চস্থ করলেন না।
এর দুই বছর পর ১৯৬৭ সনে ভ্যালেরি রচনা করলেন তার অমর মেনিফেস্টো- The SCUM Manifesto, ভ্যালেরির the Society for Cutting Up Men সংগঠনের ঘোষণাপত্র। না, SCUM নামে আসলে কোন সংগঠন ছিল না, ভ্যালেরি একাই এই নামে নানা কর্মকাণ্ড করতো- মূলত সাহিত্যকর্ম বা বক্তৃতা দেওয়া তো এই ধরণের সব কাজ। কিন্তু ঘোষণাপত্রটা লোকজনের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেইসময়। আপনাদের জানা আছে যে সেই সময় নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ উত্তাল ছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে মেনিফ্যাস্টোটা বোধ হয় দ্বিতীয় তরঙ্গের র্যাডিকেল নারীবাদীদেরই বক্তব্য হবে এটা। আর অনেকেই ধরে নিয়েছিল মানুষে নজর কাড়ার জন্যে ব্যালেরই সোলানাসের এইটা বোধ হয় একটা কায়দা হবে। কিন্তু ঐ মেনিফেস্টোটা কেবল সাহিত্যকর্ম হিসাবেও একটা অনবদ্য সৃষ্টি।
এই মেনিফেস্টোর মুল বক্তব্য হচ্ছে, পুরুষ হচ্ছে একটা অপ্রয়োজনীয় ফালতু জিনিস, এদেরকে পৃথিবীতে রাখার প্রয়োজন নাই- পুরুষ নামক এই অপূর্ণ ঊন-মানুষ প্রজাতিটিকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে কেবল নারীদের নিয়ে একটি সুষম সুন্দর মানব সমাজ তৈরি করতে হবে। মেনিফ্যাস্টো শুরুই হয়েছে এই কথা দিয়ে যে, বর্তমান সমাজে জীবন একটি বিরক্তিকর ব্যাপার, সমাজের কোনকিছুই নারীর জীবনের জন্যে প্রাসঙ্গিক নয়। নারীদের জন্যে ভ্যালেরি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সরকার উৎখাত করা, অর্থব্যবস্থা বিলোপ করা, প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করে দেওয়া আর পুরুষদের বিনাশ করা। পুরুষদের বিনাশ করতে হবে কেন? কেননা পুরুষরা হচ্ছে পূর্নাঙ্গ মানুষ নয়, ওরা হচ্ছে অসম্পূর্ণ নারী। পুরুষ হচ্ছে অসম্পূর্ণ নারী এই কথাটা যেন সেইন্ট টমাস একুইনোর ঐ কথাটার বিপরীতেই বলা যে নারী হচ্ছে পুরুষের অপূর্ণ রূপ। ভ্যালেরি আবার কথাটা বেশ ব্যাখ্যাও করে দিয়েছে। মেনিফেস্টোতে ভ্যালেরি বলল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন তো আর মানুষের জন্মের জন্যেও পুরুষের দরকার নাই। পুরুষ ছাড়াই মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব, আর ভবিষ্যতের শিশুরা যে কেবল নারী হয় সেটাও নিশ্চিত করা সম্ভব- সুতরাং সব পুরুষকে বিনাশ করে ফেলতে হবে ইত্যাদি। এ যেন একটা ইউটোপিয়া শুধু নারীদের সমাজ গঠনের লক্ষ্য। না, এটা ভ্যালেরি কোন সিরিয়াস ঘোষণাপত্র আকারে রচনা করেনি। ভ্যালেরির রসবোধ আর তীক্ষ্ণ ভাষার পরিচয় পাবেন এই মেনিফেস্টোতে।
মেনিফ্যাস্টো লেখার পর অ্যান্ডি ওয়ারহলের সাথে পরিচয় হয় ভ্যালেরির। ওয়ারহলের তখন একটা আখড়া ছিল, নাম ফ্যাক্টরি। চিত্র প্রদর্শনী, জমজমাট পার্টি, নাটক নানা কিছু হতো সেখানে। ভ্যালেরি সেখানে যেতো, অ্যান্ডি ওয়ারহলকে চাপাচাপি করতো ওর নাটকটা মঞ্চস্ত করতে। ভ্যালেরির তো টাকা দরকার, অভাবে তাড়নায় মাঝে মাঝেই তাকে পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে হতো টাকার জন্যে। অ্যান্ডি ওয়ারহল যদি ওর নাটকটা প্রডিউস করে তাইলে তো ভ্যালেরি কিছু টাকা পায় আরকি। অ্যান্ডি সেটা করেনি। অ্যান্ডি বরং ভ্যালেরিকে ওর একটা সিনেমায় একটা ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে দিয়ে বিনিময়ে পঁচিশ ডলার দিয়েছে। এই সময় এক প্রকাশকের সাথেও পরিচয় হয় ভ্যালেরির। প্রকাশক ওর বই প্রকাশ করতে আগ্রহী। ভ্যালেরি বলল, আমার মেনিফ্যাস্টো প্রকাশ কর। না, প্রকাশক ওর মেনিফ্যাস্টো প্রকাশ করবে না। ভ্যালেরি বরং একটা উপন্যাস লিখুক, সেটা প্রকাশ করবে ওরা। উপন্যাসর জন্যে প্রকাশক ওকে পাঁচশ ডলারও দিয়ে দেয়- অগ্রিম বাবদ।
কিন্তু কোনকিছুই ঠিকঠাক ওর মনের মত চলছিল না। নাটকটা কেউ মঞ্চস্থ করতে রাজি হচ্ছে না, মেনিফ্যাস্টোটা প্রকাশ হয়েছে বটে, কিন্তু সেটা নিয়ে লোকজন নানারকম নেতবাচক কথা বলছিল তখন। নিজের জীবন যেভাবে যাপন করতে চাচ্ছিল সেভাবে হচ্ছিল না। আর টাকা পয়সা নির্ভর সমাজ ও জীবন ব্যবস্থা যেন ভ্যালেরিকে কেবল ঐ রকম হাজার বছরের পুরনো রদ্দি পচা জীবন ধারণের পথের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল প্রতিনিয়ত। সামান্য টাকার জন্যে তাঁকে ঝগড়া করতে হচ্ছিল যারা ওর কাছে থেকে লেখা নেয় বা ওর সাক্ষাৎকার নেয় বা যারা ওর সাথে শোয়, ওদের সাথে।
জীবনের এই পর্যায়ে, ১৯৬৮ সনের জুন মাসের ৩ তারিখে, ভ্যালেরি একদিন গেছে অ্যান্ডি ওয়ারহলের ফ্যাক্টরিতে। ওয়ারহল তখন নতুন বিল্ডিং নিয়ে সেখানে ওর নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে। লিফটের সামনেই দেখা হয়েছে অ্যান্ডি ওয়ারহলের সাথে। ওয়ারহলের সাথে তখন আবার মারিও আমায়া নামের একজন ইংরেজ শিল্প সমালোচকও রয়েছে। ভ্যালেরি ওদের সাথে একসাথে লিফটে উঠেছে, টুকটাক সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও বলেছে। এরপর একটা বেড়েটা ৩২ রিভলভার বেড় করে ধুম ধুম করে দুইজনকেই গুলি করে দিয়েছে। মারিও আমায়া গুরুতর জখম হয়েছে বটে, কিন্তু প্রাণঘাতী কিছু না। অ্যান্ডি ওয়ারহলের পেটে গুলি লেগে নাড়িভুঁড়ি কিডনি লিভার ঐসব ছ্যাড়াবেড়া হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। হাসপাতালে চিকিৎসা ফিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু এরপর যতদিন বেঁচে ছিল অ্যান্ডি ওয়ারহলকে পেট শক্ত করে আটকে রাখার জন্যে একটা করসেট পরতে হতো।
গুলি করে ব্যাগের মধ্যে রিভলভার ঢুকিয়ে দিব্যি বেরিয়ে গেছে ভ্যালেরি। তারপর কিছুক্ষণ এলোমেলো হেঁটে বেরিয়েছে আশপাশের মার্কেট এলাকায় এখানে সেখানে। দুই তিন ঘণ্টা পর রাস্তায় দাঁড়ানো একজন পুলিশকে গিয়ে ভ্যালেরি বলেছে, আমি অ্যান্ডি ওয়ারহলকে গুলি করেছি। পুলিশ ওকে জিজ্ঞাসা করেছে, কেন আপনি কেন গুলি করেছেন অ্যান্ডি ওয়ারহলকে? ভ্যালেরির জবাব ছিল, লোকটা আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
গুলি করার পর দুই বছর ভ্যালেরিকে মানসিক চিকিৎসার জন্যে আটকে রাখা হয়। এরপর যখন ডাক্তাররা তাঁকে বিচারের জন্যে সুস্থ ঘোষণা করে তখন ওর বিচার হয়, বিচারে ওকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। মোটামুটি বছর চারেক পর ভ্যালেরি বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আবার গ্রিনিচ ভিলেজ, আবার আগের মত জীবনযাপন। এইবার কিছু সংখ্যক প্রকাশক সম্পাদক এরা অভিযোগ করলো যে ভ্যালেরি সোলানাস নাকি ওদেরকে হুমকি দিচ্ছে। আবার ওরা ধরে নিয়ে যায় ভ্যালেরিকে, এবার একদম ১৯৭৫ পর্যন্ত ওকে আটকে রাখে মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে। সত্তরের দশকেরই শেষ দিকে ভ্যালেরিকে আবার দেখা যায় গ্রিনিচ ভিলেজে। ঐ মেনিফ্যাস্টোটার একটা নতুন সংস্করণ করেছে এর মধ্যে। আর এইবার ওর একটা বড় সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় দ্য ভিলেজ ভয়েস-এ। ভিলেজ ভয়েস, আপনারা হয়তো জানে, সে সময়ের প্রথাবিরোধী বিকল্প সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মুল সাপ্তাহিক কাগজ ছিল। সেই কাগজে ওকে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনি অ্যান্ডি ওয়ারহলকে গুলি করলেন কেন? উত্তরে ভ্যালেরির জবাব ছিল, সেটা একটা নৈতিক ইস্যু ছিল।
এরপর বেশিদিন বাঁচেনি ভ্যালেরি সোলানাস। হঠাৎ একদিন নাই হয়ে গেল ভ্যালেরি সোলানাস গ্রিনিচ ভিলেজ থেকে। কেউ জানে না কোথায় গেছে কেমন আছে কী করছে- কিছুই না। পরে জানা গেছে ভ্যালেরি চলে গিয়েছিল অ্যারিজোনার ফিনিক্স শহরে, ভ্যালেরি সেখানে রাস্তায়ই থাকতো। সেখান থেকে গেছে সান ফ্রান্সিসকো। সান ফ্রান্সিস্কোতে ১৯৮৮ সনের এপ্রিলের ২৫ তারিখে একটা সস্তার হোটেলরুমে ভ্যালেরি সোলানাসকে মৃত পাওয়া যায়। হোটেল মালিক ওর রুমে গিয়েছিল হোটেলের বকেয়া ভাড়ার তাগাদা দিতে, গিয়ে দেখে মৃত পড়ে আছে ভ্যালেরি সোলানাস।
না, ভ্যালেরি সোলানাসের জীবন যে এইভাবে শেষ হবে সেটাতে দুঃখ করবেন না, কেননা ভ্যালেরি সোলানাস ধরনের নারীদের উপযোগী পৃথিবী এটা নয়- অন্তত গত শতকের সেই সময়টাতে তো ছিলই না। পরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে, একটা বিকল্প পৃথিবীর ইউটোপিয়া ছড়াবে সমাজে, এই রকম একটা মেয়েকে এই পৃথিবী সহ্য করবে না। তাও আবার টাকা নাই পয়সা নাই সংসার নাই প্রতিষ্ঠা নাই এই রকম একটা মেয়ে! কক্ষনো নয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানেন? ভ্যালেরির মৃত্যুর বেশ পর ওরা ওর প্রিয় রচনা, Up Your Ass নাটকটি, সেটার পুরদস্তুর পেশাগত মঞ্চায়ন করে। ওর জীবনী নিয়ে সিনেমাও হয়েছে কয়েকটা। আর ওর জীবনী তো বেশ ভালোই বিক্রি হয় আরকি। ওর নাটকটা, সেটাও এখন বই আকারে প্রকাশ হয়েছে।
ভ্যালেরি সোলানাসের কথা আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কখন মনে পড়ে জানেন? আমি যখন আমাদের এই প্রিয় নগর ঢাকায় ঘাড়ত্যাড়া, কিছুই মানি না মানব না, স্বাধীনতা চাই অবারিত আকাশের চেয়েও বিস্তৃত সীমাহীন স্বাধীনতা, এইরকম তরুণ নারীদেরকে দেখি, ওদের মধ্যে কেউ যখন মধ্যমা উঁচু করে প্রচলিত সমাজ প্রথা প্রতিষ্ঠান এইসবের দিকে Up Your Ass চিহ্ন দেখায়, তখন আমার মনে পড়ে ভ্যালেরি সোলানাসের কথা।
(তথ্য নিয়েছি অন্তর্জালে নানা সূত্র থেকে)