November 23, 2024
কলামফিচার ২

ধর্ষণ নহে বলাৎকার! চমৎকার! চমৎকার!

শাশ্বতী বিপ্লব।। রাজ্যে “ধর্ষণের” সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়িয়া গিয়াছে শুনিয়া রাজা হুংকার ছাড়িয়া কহিলেন: একি কথা শুনি আজ খবরে? মাদ্রাসায় নাকি ধর্ষণ করে, ভয় নাই কি কবরে?

মন্ত্রী কহিলেন: জাহাপনা, খবরওয়ালাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান। ওইসকল দুর্মুখের কথা শুনিয়া হইবেন না বেচ্যাইন।

রাজা এইবার চোখ পাকাইয়া বলিলেন: হেঁয়ালীপনা আবারো! সত্য কহিতে যদি না পারো, তবে গদিখানা ছাড়ো।

মন্ত্রী ততোধিক কাঁচুমাচু, বলিলেন: মহারাজ, বৃত্তান্ত শোনেনই একবার। ধর্ষণ নহে, উহারা করিয়াছে বলাৎকার।

রাজা আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন: ওহ্, তাই বলো! চমৎকার! চমৎকার!

পরক্ষণেই আবার চোখ পাকাইয়া কহিলেন: তবে ওই শালারা ধর্ষণ কহে কেন খবরে?

মন্ত্রী জিভ কাটিয়া বলিলেন: সংজ্ঞা জানেনা হুজুর, হুদাই ফাল পারে। পুরুষের যোনি নাই, নাই পর্দার কারবার। যতোই ইয়ে করুক, পারে না কিছুই ফাটাবার!

বাংলাদেশের সংবিধান, আইন-কানুন এবং সমাজের অবস্থা অনেকটা এই রাজা ও মন্ত্রীর মতো। ধর্ষণ বলতে যারা শুধু “নারী ধর্ষণ”কেই বোঝে এবং পুরুষ ধর্ষণকে সমকামিতা বা “প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে” বলে পাশ কাটিয়ে যায়। শাস্তির বিধানও কম। সমাজে ছেলে শিশু ধর্ষণ নিয়ে কথা বলার সময় সাধারণত “বলাৎকার” শব্দটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। এইসব শব্দের মারপ্যাঁচে এবং “ধর্ষণের” সংজ্ঞার আওতায় না থাকায়, ছেলে শিশুদের ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। খুব বেশি হলে মৃদু ভৎসনা করে ছেড়ে দেয়া হয়।

এই যেমন, দিনাজপুরের হিলিতে আট বছরের ছাত্রকে ধর্ষণ করেছে মসজিদের মুয়াজ্জিন ইব্রাহিম হোসেন। তাকে বিচারের নামে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিরক্ত হয়েছেন মসজিদের খাদেম খবির উদ্দিন। মিমাংসিত বিষয়ে কেন বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। “ধর্ষণ” হলে খাদেম সাহেব হয়তো কিছুটা বুঝলেও বুঝতে পারতেন, “বলাৎকার” বলেই হয়তো বিরক্ত হলেন।

ছেলে শিশুদের ধর্ষণটা যেনো তুলনামূলক মামুলী ব্যাপার আমাদের কাছে। ইংরেজি “Rape” শব্দটা লিঙ্গ নিরপেক্ষ হলেও, বাংলা “ধর্ষণ” শব্দটা মারাত্মকভাবে লিঙ্গ পক্ষপাতদুষ্ট। ধর্ষণের আইনী সংজ্ঞাতে তো বটেই, সমস্যা আছে ধর্ষণের সামাজিক মনস্তত্ত্বেও। “ধর্ষণের” ধারণার সাথে নারীর যোনি বা প্রজনন অঙ্গের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হাইমেন নামক নারীর প্রজনন অঙ্গের একটি অংশে আটকে আছে সবার মাথা। আদর করে যাকে আমরা সতীচ্ছদ পর্দা বলে ডাকি। এই পর্দা যদি না ফাটে তবে ধর্ষণের শিকার ছেলেটির উপর যতো অত্যাচারই হোক না কেন, তার মনোজগত যতো ক্ষতিগ্রস্তই হোক না কেন, তাকে আমরা ধর্ষণ বলতে বা ভাবতে ইতস্তত করি।

এর সাথে আরো জড়িয়ে আছে নারীর ইজ্জত বা সতীত্বের ধারণা। ধর্ষণের শিকার হলে নারীর ইজ্জত যায় বা সতীত্ব নষ্ট হয় বলে বিশ্বাস করে এই সমাজ। কিন্তু পুরুষের যেহেতু যোনি নাই। পুরুষের হাইমেনও ফাটে না। তাই পুরুষের ইজ্জতও যায় না। আর ইজ্জত যায় না বলে পুরুষ ধর্ষণকে আমরা “বলাৎকার” নামে ডেকে সান্ত্বনা পাই।

একই অপরাধকে ভিন্ন নামে ডাকার বিপদ অনেক। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে না পারা। এবং একইসাথে সমাজে সেই অপরাধের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা। “ধর্ষণ”কে ধর্ষণই বলুন এবং দয়া করে একইরকম শাস্তির বিধান করুন। সেই ধর্ষণের শিকার হোক কোন নারী, কোন পুরুষ বা কোন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ।

ধর্ষণের শিকার কারোরই ইজ্জত যায় না হে আত্মপ্রবঞ্চিত সমাজ। ইজ্জত যায় ধর্ষকের। ধর্ষণের শিকার মানুষটা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং সেই ক্ষতির কোন নারী-পুরুষ-ট্রান্সজেন্ডার নাই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]