September 20, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩

আর্থিকভাবে স্বীকৃত কর্মসংস্থানে নারী   

Tony Cliff এর “Class Struggle and Women’s Liberation” বইটির১৫তমঅধ্যায় “The Struggle For Socialism and Women’s Liberation”। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য এ অধ্যায়টি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফাতিন ইশরাক, সুবাহ মালিহা এবং রাহাত আলম দ্বীপ্ত। অনুবাদটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর দ্বিতীয় পর্ব।

শ্রমিকশ্রেণির নারীরা যদি গৃহিণী হয়, তবে তাদের উপর করা শোষণ তাদেরকে অসহায় বানিয়ে ফেলবে। নারীরা যখন গৃহিণীর ভূমিকায় থাকে, সে দুর্বল এবং অবহেলিত হয়ে পড়ে। Margery Spring Rice ১৯৩০ সালের দিকে তার শ্রমিকশ্রেণির নারীদের গার্হস্থ্য শ্রমের একটি লিখিত বিবরণী তে উল্লেখ করেনঃ

আমাদের দৃষ্টিসীমায় তাদের যে শ্রমকে দেখি, সেখানে তারা শুধু খায়দায় আর ঘুমায়। গার্হস্থ্য কাজে তারা নিঃসঙ্গভাবে শ্রম দিয়ে থাকে। তার পরিবার এর প্রতিদানে যেই আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাক না কেনো, তার টান যতই গভীর হোক না কেনো, তার পরিবার তার শ্রম দিয়ে যে বন্ধন তৈরি করে, সেটা তাকে গৃহের নিঃসঙ্গ এবং সংকীর্ণ গোলকধাঁধায় আটকে ফেলে।  (১৩) 

গৃহিণী নারীদের এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এক ধরণের অসহায়ত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। নিয়তির প্রতি বিশ্বাস তাকে চরমভাবে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। এর সূক্ষ্ম বর্ণনা পাওয়া যায়  Emily Durkheim এর লেখায়, “ব্যক্তিসত্তার মধ্যে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় যার ভবিষ্যত কঠোরভাবে অবরুদ্ধ, যার আবেগ কঠোর হাতে দমন করা হয় মর্মযন্ত্রণার মাধ্যমে, যেমনটা হয় অসহায়ের সাথে সহিংস এবং পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব এক চরিত্রের আচরণে।”

খেটে খাওয়া শ্রেণির মায়েরা তাদের গণ্ডিবদ্ধ ভূমিকার মধ্যে নিজেদের জীবনের অর্থ খুজে পাওয়ার জন্য গার্হস্থ্য কাজের বাইরে কোনো বিকল্প খুঁজে পায় না। Sue Sharp এর বর্ণনায় ব্যাপারটি হলো এরূপ, “চাপিয়ে দেওয়া ঘরের কাজের প্রতি অসম্ভব দায়িত্ববোধের মনোভাব খুবই যুক্তিসঙ্গত যদি এই কাজের বাইরে তাদের কোনো বিকল্প পথ না থাকে। সংসারে তার উপর অর্পিত এই দায়িত্বের গুরুত্বের মধ্যেই সে নিজের আত্মসম্মান খুঁজে পায়। আর তার উপর চাপিয়ে দেওয়া গুরুভার যদি সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে তার অস্তিত্ত্বের গুরুত্বই সমূলে উৎপাটন করে ফেলা হয়। [১৪] Linda Gordon তার অসাধারণ বই “Woman’s Body, Woman’s Right” – এ আত্মরক্ষার এই দিকগুলোর উপর জোর দেয়।

… মানুষের বোধগম্যতার উর্ধ্বে রহস্যের অস্তিত্বের ধারণা নারীরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই এবং তাদের সৃজনশীলতা আর জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার জন্য এই চিন্তাধারা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তাই যখনই সম্ভবপর হয়, মাতৃত্বের পূর্ণকালীন দায়িত্ব অধিকাংশ নারীর জন্যই তাদের অন্য যেকোনো বিকল্প কাজের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য।  [15]

একই ধারায়, একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান মা গর্ভধারণের অর্থ ব্যাখ্যা করেন যে, “আমার কাছে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার সময়টাই একমাত্র সময় যখন আমি প্রাণ ফিরে পাই। আমার গায়ের বর্ণ কিংবা মানুষ আমাকে যেসব নেতিবাচক নাম ধরেই ডাকুক না কেন, আমি জানি আমি কিছু সৃষ্টি করতে পারি, কিছু করতে পারি।” Linda Gordon মন্তব্য করেন, “সন্তানের যত্নের দায়িত্ব হাজার অসুবিধা সত্বেও থেকে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেনা এবং অধিক সৃজনশীল। কারণ এটি মা’কে তার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্ক ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়।” [১৬]

একজন নারী বহুতলবিশিষ্ট ভবনের ফ্ল্যাটে বন্দী হয়ে, সংসার চালানোর খরচের চিন্তায় উন্মাদ হয়ে, সংসারের গোলামি কাজে ঘন্টার পর ঘন্টা শ্রম দিয়ে, হয়তো খুব জোর দিয়েই দাবি করতে পারে সে “শুধু” মা এবং স্ত্রী হিসেবেই অনেক সুখী। কিন্তু তার এই দাবির কারণ হচ্ছে সে এমন ফাদে আটকা পড়েছে যা থেকে উত্তরণের উপায় তার জানা নাই আর এই অবস্থানে থাকার মধ্যেই তার সুখী হওয়া স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। তার যদি কখনো নিজের কাছেই নিজেকে অসুখী মনে হয়, তবে সে ব্যক্তি হিসেবে ব্যর্থ আর সেটা আরো গভীর অপরাধবোধে ভুগে, আরো অসুখী হয়ে পড়ে জীবনে।

প্রচলিত চিন্তাধারায় নারীর স্ত্রী এবং মা হিসেবে যে পরিচিতি তা লাখ লাখ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এই কুসংস্কার নগ্নভাবে প্রকাশিত হয় প্রথম থেচার গভমেন্টের স্টেট সোশ্যাল সার্ভিসের সেক্রেটারি, Patrick Jenkin এর বক্তব্যে, “ঈশ্বর যদি নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করা মেনে নিত তবে তিনি দুই লিঙ্গে পৃথক করে মানুষকে সৃষ্টি করতেন না।”

বাস্তবে সকল বুর্জোয়া সমাজতত্ত্ববিদ এবং নারীবাদী পরিবারের গঠনকাঠামোতে নারীদের স্থান দেওয়ার ব্যাপারে অটল অবস্থান নেয়। তারা শ্রমশক্তিতে নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করে অথবা তাদের গুরুত্বকে ছোট করে দেখে। এমনকি তথাকথিত “মার্ক্সিস্ট নারীবাদীরা” শুধু তাদের গার্হস্থ্য শ্রমেই নারীদের ভূমিকার উপর নজর দেয়। পরিবার কাঠামোতে নারীদের অবস্থান শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের উপর যেভাবে প্রভাব ফেলে, মজুরির জন্য শ্রম দেওয়া নারীদের নিয়ে কাজ করা গবেষণাকর্মগুলোয় তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়।

এবং এই পথে অগ্রসর হওয়া অবধারিত যদি না কেউ মার্ক্সবাদী পদ্ধতি ব্যবহার করে নারীদের  কাজের দুটি ক্ষেত্রের মধ্যকার ঐক্য এবং দ্বন্দ্বের  মধ্যে সমন্বয় না দেখায়। বাহ্যিক রুপ একাই মজুরি ভিত্তিক শ্রমের  তুলনায় গার্হ্যস্থ শ্রমকে অধিক গুরুত্ব দেয়। সর্বোপরি, নারীরা গার্হ্যস্থ্য শ্রমের পিছনে অনেক সময় অতিবাহিত করে যা Ann Oakley এর একটা বড় সংখ্যক নারীদের নিয়ে সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়, তারা সপ্তাহে গড়ে ৭৭ ঘন্টা শ্রম দিয়ে থাকে।

এছাড়া, যদি নারীদের নিজেদের উপলব্ধির ব্যাপারে যদি লক্ষ্য করি, তবে দেখা যায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গার্হস্থ্য শ্রমকে মজুরিভিত্তিক শ্রমের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যদি তাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে তাদের কষ্টসাধ্য দ্বিগুণ বোঝা টানার চেয়ে কোনটিকে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়, স্বাভাবিকভাবেই তারা গার্হস্থ্য শ্রমের কথাই বলবে। আর কোন বিকল্প পথই বা তারা চোখে দেখতে পায়? বাচ্চাদের অযত্নে রাখা, চাকর রাখা , বড় হোটেলে থাকা? তাই অবশ্যই পূর্ণকাল মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন, যখনি সম্ভবপর হয়, শ্রমিক শ্রেণির নারীদের কাছে অন্যান্য বিকল্প চাকরির চেয়ে গার্হস্থ্যকর্মই অধিক গ্রহণযোগ্য।

কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ নারীই তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় মজুরিভিত্তিক শ্রমের জন্য ব্যয় করে। ১৯৭১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায়, ব্রিটিশ নারীদের মধ্যে ৮৭% নারী নিজেদের জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও বাইরে কাজ করেছে। ব্রিটেনে বর্তমানে শ্রমশক্তির ৪১% -ই নারী। পূর্বে উল্লেখিত সেসব “সাধারণ শ্রমিক”- বিবাহিত পুরুষ, যাদের স্ত্রী বাইরে কাজ করে না, ঘরে সন্তান আছে, এমন শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৮% এবং পুরো শ্রমশক্তির হিসেবে মাত্র ৫%। [১৮]

১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে, ১৪.৫% পরিবার নারীরা একা চালায়। [১৯] সেখানেও দশটা পরিবারের মধ্যে মাত্র একটা পরিবার প্রচলিত একক পরিবারের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, নারীরা ব্যাপকভাবে বেতনভুক্ত চাকরিতে প্রবেশ করে। প্রথমত, জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রসার এবং ক্রমবর্ধমান আয়ুর সীমা বিবাহিত নারীরা কাজ খুঁজতে আরো সক্ষম তা প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয়ত, বিবাহিত নারীদের জন্য আরো অনেক গ্রহণসাধ্য চাকরি আছে।

নিচের পরিসংখ্যানে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়:

ব্রিটেনে চাকরিতে নিয়োগ (millions) [20]

                                               ১৯৫১   ১৯৬১   ১৯৭১   ১৯৭৬

পুরুষ                                   ১৫.৬    ১৬.১    ১৫.৯    ১৫.৯

বিবাহিত নারী                        ২.৭      ৩.৯    ৫.৮      ৬.৭

অন্যান্য নারী                         ৪.৩     ৩.৯    ৩.৪      ৩.২

মোট(নারী)                            ৭.০      ৭.৭     ৯.২      ১০.০

মোট(নারী  এবং পুরুষ)        ২২.৬   ২৩.৮  ২৫.১   ২৫.৯

এভাবে ১৯৫১ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে ব্রিটেনের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ৩৩ লক্ষ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ৩০ লক্ষই নারী। ১৯৫১ সালে মোট শ্রমশক্তির ৩১%; বর্তমানে ৪০% ই নারী। তবে এ পরিসংখ্যান প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পারে না কারণ এগুলোতে করের আওতাধীন নয় এমন খন্ডকালীন চাকরি কিংবা স্বল্প মজুরির শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করেনি।

মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানে প্রবেশাধিকারের জন্য একইরকমের আন্দোলন হয় পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ২১৫% বেড়ে ১৯৪০ সালের ১৩,৮৪০,০০০ জন থেকে ১৯৮০ সালে ৪৩,৬৯৩,০০০ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধির হার আরোও আকর্ষণীয়। ৪২২.৮% বৃদ্ধি পেয়ে ৫,০৪০,০০০ থেকে ২৬,৩৪৭,০০০ তে গিয়ে দাঁড়ায়।

এই পরিবর্তনের ফলে শ্রমিক শ্রেণির নারীদের উপর দ্বিগুণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতি যে প্রতিক্রিয়া এক শতক আগে যা ছিল তার তুলনায় বর্তমানে যে প্রতিক্রিয়া তাতে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। কর্মসংস্থানে প্রবেশের ফলে তাদের আশা এবং আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন এবং উন্নতি ঘটে। তারা সেগুলো পূরণ করতে কিছুটা হলেও সক্ষমতা অর্জন করে। বর্তমানে অধিক কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে পারিবারিক দিক থেকেও বোঝা কমিয়ে আনা সম্ভব। আজকের নারীরা তাই স্ত্রী এবং তার স্বামীর উভয়ের প্রথাগত লিঙ্গভিত্তিক কর্তব্যের বিরোধিতা করে।

সমাজবিজ্ঞানী Harriet Holter কর্তৃক নরওয়েতে চালানো বিস্তৃত জরিপে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাতে দেখা যায় প্রথাগত লৈঙ্গিক কর্তব্যের প্রতি নারীর মনোভাব লাভজনকভাবে কাজে নিয়োগের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে।
(শতকরা)

                                                                ন্যুনতম ঐতিহ্যবাহী    মধ্যবর্তী    গোঁড়া ঐতিহ্যবাহী

লাভজনকভাবে নিযুক্ত গৃহিণী                            ৮                                ৩৬              ৫২

লাভজনকভাবে অস্থায়ী ভাবে নিযুক্ত গৃহিণী        ২০                              ৬৪              ১৪

লাভজনকভাবে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত গৃহিণী             ৪৫                              ৪৩               ৯

Hotler মন্তব্য করেন, “স্ত্রীরা যারা ঘরের বাইরে কাজ করে তারা অন্যান্য নারীর তুলনায় সমানাধিকারের বিশ্বাসের প্রতি অধিক অনমনীয়। তিনি আরেক পরিসংখ্যানে দেখান, ” যাদের স্ত্রী পেশাগতভাবে সক্রিয় তাদের সমানাধিকারপ্রশ্নে বিশ্বাস অন্যদের চেয়ে অধিক মজবুত।

(শতকরা)

                                                                ন্যুনতম ঐতিহ্যবাহী    মধ্যবর্তী    গোঁড়া ঐতিহ্যবাহী

স্ত্রী সহ স্বামী অলাভজনকভাবে নিযুক্ত                ৪                   ৩১                   ৬৩

স্ত্রী সহ স্বামী লাভজনকভাবে নিযুক্ত                    ৩০                 ৬০                  ১০

Women’s wage labour is more decisive in affecting domestic labour and attitudes towards it than vice versa. বুর্জোয়া সমাজবিজ্ঞানী এবং নারীবাদীরা যারা নারীদের এই মনোভাব বাইরে বের হবার কারণে তৈরি হয় এবং কর্মসংস্থানগুলোয় তার এই মনোভাবের পরিচয় দেয় বলে ভাবে, পিছিয়ে পড়া সৃজনীশক্তিহীন নারীশ্রমের যে অযৌক্তিক ভাবনাগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে, তারা সমাজে প্রচলিত আদর্শকে গ্রহণ করে নিলেও, আমরা দেখতে পাই কিভাবে কর্মসংস্থানে প্রবেশের ফলে নারীদের যে আচরণিক পরিবর্তন এবং ধারণা তৈরি হয় তার প্রভাব ঘরের ভেতরেও পরে। উৎপাদনশীলতা এবং প্রজনন এই ক্ষেত্র দুটি সাংঘর্ষিকভাবে অবিচ্ছিন্ন হলেও, উৎপাদনই এর মধ্যে মুখ্য । গার্হ্যস্থ্য শ্রম যতটা না মজুরি শ্রমকে প্রভাবিত করে করে তার চেয়ে মজুরী শ্রম গার্হস্থ্য শ্রমকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।

মার্ক্স এ ব্যাপারে সঠিক ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সামাজিক উৎপাদনকাজে নারীদের (এবং সন্তানদের) নিয়ে আসলে তার প্রভাব পরিবারিক এবং লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের উপর পড়বেঃ

এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়, আদিম পারবারিক বন্ধনের বিলোপ যতটা ভয়ংকর এবং জঘন্যই মনে হোক না কেনো, আধুনিক শিল্পব্যবস্থা ,ঘরোয়া পরিবেশের বাইরে, নারী , তরুণসমাজ এবং উভয়লিঙ্গের শিশুদের জন্য যেভাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনিভাবে পরিবারের উচ্চতর কাঠামো এবং লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের জন্য নতুন অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। স্পষ্টত, উভয়লিঙ্গ এবং সকল বয়সের ব্যক্তিদের নিয়ে সামষ্টিক শ্রমিক শ্রেণিই উপযুক্ত পরিবেশে মানবকল্যাণের উৎস হয়ে উঠবেই।

শ্রমিকশ্রেণির নারীদের শোষণ এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তির পথ তাদের বিচ্ছিন্ন ঘরে খুঁজে পাবে না। পাবে মজুরী অর্জনকারী হিসেবে তাদের সমষ্টিগত সম্পর্কে যেখানে তারা তাদের সহকর্মী নারী এবং পুরুষের সাথে জোটবদ্ধ হতে পারবে।

ঘরে নারীদের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে যখন তারা শিল্পায়ন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন দেখা যায় যে, ১৯৮২ সালে স্কটল্যান্ডের লি জিনস ফ্যাক্টরির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া নারীদের ধ্যান ধারণার আমূল পরিবর্তন হয় এবং তারা তাদের পুরুষসঙ্গীসহ সকল সাধারণ পুরুষদের লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে যে কুসংস্কার আছে, সেগুলার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। “আমি ব্যস্ত। তুমি গিয়ে চা বানাও এবং বাচ্চাদের যত্ন নাও” এই ধরণের আচরণ দেখা যায় তৎকালীন নারীদের মধ্যে।

শুধুমাত্র সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনের লড়াইয়েই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। কর্মসংস্থানই সেই জায়গা যেখানে আন্দোলন সংগঠন এবং নিজেদের মধ্যকার পরিবর্তন আসার সর্বোচ্চ সুযোগ পায় নারীরা। সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই নারীরা, পুরুষ সহকর্মীর মতো শ্রমিক হিসেবে উৎপাদনের সম্পর্কগুলোর অংশ হয়ে ওঠে, যেটা শ্রেণি সমাজের প্রধান ভিত্তি। মার্ক্সবাদ প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি ক্ষমতার উপরই জোর দেয় এবং কর্মক্ষেত্রেই এই সমস্যাটি কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারে।

শ্রমিক শ্রেণিকে বিভক্ত করে রাখতে মালিক শ্রেণি ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। ভিন্ন ভিন্ন দেশে, একই দেশের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন শাখায়, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার অসম উন্নয়ন শ্রমিক শ্রেণিকে হাজার খণ্ডে বিভক্ত করে ফেলে। বর্ণ, জাতি এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈসাদৃশ্য তাদের বিভেদের অতিরিক্ত সংযোজন। শ্রমের দক্ষতাভিত্তিক ইউনিয়নবাদ যে দক্ষতার বৈষম্য বৃদ্ধি করে, তা তাদের মধ্যকার অনৈক্য আরো ব্রদ্ধি করে। যেমনটা করে মালিকশ্রেণির “বিভাজন এবং শাসন” নীতি যার দ্বারা মালিকপক্ষ নারীদের সস্তা শ্রম হিসেবে উপস্থাপন করে পুরুষদের দর-কষাকষির অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে। তারা পুরুষদের দক্ষতা এবং লিঙ্গভিত্তিক কুসংস্কারকে ব্যবহার করে নারীদের অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে।

শোষক শ্রেণির ধারণাগুলো সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং ঘর-পরিবার তা নিশ্চিতকরণের জন্য সর্বাধিক কার্যকর প্রতিষ্ঠান। সমাজের শোষকদের এই ধারণা ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের জন্য কার্যকর ক্ষেত্র হচ্ছে ঘর- পরিবার যেখানে আমরা ক্ষুদ্রতম দলে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকি। বিশেষত, টেলিভিশন এই বিশাল বিচ্ছিন্নভাবে থাকা নারীসহ গোষ্ঠীর সকলের চিন্তাভাবনার রূপ দিতে অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।

শ্রমের গার্হস্থ্য বিভাজন নারীর আর্থিকভাবে তার পুরুষসঙ্গীর উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তুলে এবং শ্রমবাজারে তার দর কষাকষির অবস্থান দুর্বল করে ফেলে। আর সেটা নারীকে তার সঙ্গীর উপর আরো নির্ভরশীল করে এবং এভাবে এই চক্র পূরণ হয়। অন্যভাবেও, পরিবারে একজন নারীর ভূমিকা, বেতনভুক্ত চাকরিতে তার ভূমিকার উপরও প্রভাব ফেলে। গার্হস্থ্য শ্রমের পরিসরে যে দক্ষতা লাগে তা অপেক্ষাকৃত অপরিবর্তনশীল। যার ফলে এই শ্রম শুধু অদক্ষ কাজের জন্যই প্রস্তুত করে নারীদেরকে। বাচ্চা প্রতিপালনের জন্য নারীদের নেওয়া বিরতি এবং বিরতি পরবর্তী সময়ে কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রবেশকারী হিসেবে ফিরে আসলে তাদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সেটা তাদের দক্ষতাবৃদ্ধিতে কোনোভাবে কার্যকর হয় না। এভাবে বিয়ে এবং মাতৃত্ব কার্যকরভাবে নারীদের দক্ষতা নষ্ট করে ফেলে।

নারীদের অস্থায়ী চাকরি গ্রহণের প্রবণতাও সরাসরিভাবে তাদের গৃহস্থ দায়দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ঘটে মূলত অস্থায়ী চাকরিগুলোতেই। ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ নারীদের ১২% খণ্ডকালীন চাকরি করে। ১৯৭৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০% এ। ১৯৭৫ সালে দুই বা ততোধিক সন্তানের মায়েদের দুই-তৃতীয়াংশ খন্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেয়। এই খণ্ডকালীন চাকরি করা নারীরা যে মজুরি এবং শর্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তা স্থায়ীভাবে কাজ করা কর্মীদের কাছে একদমই গ্রহণযোগ্য হতোনা। অনেকে রিডানডেন্সি পেমেন্ট স্কিমস এর অধীনে ( অতিরিক্ত বেতন কাঠামোর অধীনে ছুটির দিনের জন্য/ ছাটাই করার পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য/ চাকরি শেষে পেনশন হিসেবে ভাতা দেওয়া হয়) ছুটির দিনের জন্য, পেনশন কিংবা নিরাপত্তামূলক আর্থিক সহায়তাও পায় না।

কর্মক্ষেত্রে শ্রমের এই লৈঙ্গিক বিভাজন অত্যন্ত প্রকট এবং তার উপর ঘরে নারীর অবস্থানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও, ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ তাদের সংঘাত আর পর্যায়ের সাথে শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিক শ্রেণির নারী এবং পুরুষের মধ্যকার বিভাজন সংকীর্ণ হয়ে শ্রেণির একক পরিচয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। নারীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক বিস্তার, যেখানে অধিকাংশ নারী অফিস, হাসপাতাল এবং বড় দোকানগুলোর চাকরিতে ভিড় করে, সেটা নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের কর্মস্থলের পরিবেশের মধ্যকার পার্থক্য সংকুচিত করার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কায়িক শ্রমিক এবং হোয়াইট-কলার শ্রমিকদের ( পেশাদার কর্মী যারা অফিস-আদালতে প্রশাসনিক কিংবা ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত ) মধ্যকার পার্থক্যও কমে আসছে ।

নারী এবং পুরুষের জোটবদ্ধ হবার পার্থক্যের ক্রমহ্রাস পাওয়া হল এর একটি সুস্পষ্ট পরিমাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ট্রেড ইউনিয়নে নারীদের অংশগ্রহণ বিশাল আকার ধারণ করেঃ

ব্রিটেনে ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যপদ

সাল                 নারী                  মোট               মোট সদস্যদের মধ্যে শতকরা নারী

১৮৮৬            ৩৭,০০০            ৬৩৬,০০০             ৫.৮

১৮৯৬             ১১৮,০০০          ১,৬০৮,০০০           ৭.৩

১৯০৬             ১৬৭,০০০          ২,২১০,০০০            ৭.৬

১৯৩৯             ৫৫৩,০০০         ৪,৬৬৯,০০০          ১১.৪

১৯৫৮            ১,৩৮৭,০০০        ৮,৩৩৭,০০০          ১৬.৬

১৯৬৮            ১,৭৬৭,০০০        ৮,৭২৬,০০০          ২০.২

১৯৭৮             ৩,৪১১,০০০        ১১,৮৬৫,০০০        ২৮.৭

নারীরা এখনো পুরুষদের চেয়ে কম জোটবদ্ধ। ১৯৭৪ সালে ৩৬.৭% শ্রমিক নারীরা ট্রেড ইউনিয়নে ছিল যেখানে পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে ছিল ৫৬.৯%। কায়িক শ্রমিকদের মধ্যে এই পার্থক্যটা তুলনামূলকভাবে বেশি। নারীরা ৪২.১% আর পুরুষরা ৬৪.৭%। অন্য দিকে হোয়াইট-কলার শ্রমিকদের মধ্যে সেই পার্থক্য তুলনামূলকভাবে কম। নারীদের ৩২.৬% এবং পুরুষদের ৪৪.৫%  ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সাথে জড়িত ছিল।

আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাই কিভাবে পরিবারের মধ্যকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভূমিকার প্রতি নারীদের আচরণ ,তাদের ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়া আর না যাওয়া দিয়ে প্রভাবিত হয়। কর্মক্ষেত্র এবং সেখানে নারী শ্রমিকদের নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য যে লড়াই, তা সামষ্টিকভাবে ‘সচেতনতা গড়ে তোলা’র মতো পরিবর্তনশীল ধারণার মূল চাবিকাঠি। এই সামষ্টিক কাজ তোমার, তোমার সহকর্মী এবং তোমার শ্রেণির মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলবে। এমনকি এটা শোষণের ভাবাদর্শ যা নারীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তা ভেঙে ফেলার একমাত্র উপায়। শ্রমিক শ্রেণির নারীরা যাদের প্রধান চিন্তা হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই, তারা “সচেতনতা বৃদ্ধি”র মতো বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার বিলাসিতা করতে পারেনা।

তার মানে এই না যে নারী শ্রমিকদের কেবল কর্মক্ষেত্রে অথবা কর্মক্ষেত্রভিত্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হতে হবে। কিন্তু সংগ্রামের অন্যান্য মাত্রার বীজ এখানেই বোনা আছে। মার্ক্সবাদ এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে যে, কেবল যে মুহূর্তে এসে সমস্যার সম্মুখীন হবে, তখনই তার সমাধান পাওয়া যায়। প্রবীণ ভাতা দিয়ে যেমন বয়স্করা প্রচেষ্টা চালিয়ে দারিদ্র থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়, সেরকম প্রচেষ্টা দিয়ে নারীরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে নারী শোষণ দূর করা সম্ভব না। শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, শামীলদের দুর্বল অবস্থানই চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে আসে না, নিয়ে আসে তাদের শক্তি। তাই নারী শোষণের বিরদ্ধে লড়াইয়ের শুরুর ধাপ শোষণ নয়, বরং যে পর্যায়ে শ্রমিক শ্রেণির নারীরা শক্তিশালী হতে পারেএবং নিজেদের শ্রেণির পুরুষ সহযোদ্ধাদের সাথে মিলে সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য লড়াই করতে পারে।

প্রথম পর্ব— নারী শোষণের শ্রেণি শেকড়

[শেষ পর্ব আগামীকাল]