র্যাডিকেল ফেমিনিজম: শেকড় ধরে টান মারে যে নারীবাদ
নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-১৪
শারমিন শামস্।। র্যাডিকেল ফেমিনিজম, বাংলায় বললে চরমপন্থী নারীবাদ। অনেকে বলে, উগ্র নারীবাদ। কেন বলে? কারণ র্যাডিকেল ফেমিনজম গোঁড়া ধরে টান মারে। শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে চায় সমাজের প্রচলিত সব নিয়ম কানুন, প্রথা ও প্রতিষ্ঠান। র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা মনে করেন, নারীর শোষিত বঞ্চিত হবার কারণ হল পিতৃতন্ত্র, সমাজে পুরুষের প্রাধান্য; পিতৃতন্ত্রই নারী পুরুষের ভেতরে অসমতা তৈরি করে, প্রতিষ্ঠা করে, নারীকে করে পুরুষের অধীন, পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমই নারীর বঞ্চনা আর পুরুষের বেশি সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য দায়ী। তাই র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা এই সমাজ ও সিস্টেমের আমূল পরিবর্তন চান। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই তারা সমাজে নারী পুরুষের সমতা আনতে চান। তারা সমাজে বিদ্যমান সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্বীকার করেন, কেননা তারা মনে করেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো পিতৃতন্ত্রকেই জিইয়ে রেখেছে। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙেচুড়ে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোনো লৈঙ্গিক বৈষম্য ও অসমতা থাকবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেকোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপকে র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা সন্দেহের চোখে দেখেন। তারা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পক্ষে, যে পরিবর্তন পুরো সমাজের আপাদমস্তক বদল ঘটাবে।
অন্য নারীবাদী ধারার চেয়ে র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা একটু আলাদা, কারণ তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চান, সব তুলে উপড়ে ফেলতে চান। তারা প্রচলিত নিয়মের সাথে খাপ খাওয়াতে আগ্রহী নন। বিদ্যমান ব্যবস্থাকে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের কোনো বিশ্বাস ও আস্থা নেই। তাই এই সিস্টেমের ভেতরে থেকে তারা পরিবর্তন ঘটাতে চান না। সিস্টেমকে ভেঙে নতুন সিস্টেম গড়ে তুলতে চাওয়াই তাদের দর্শন। কোনো আইন পাশ করে বা নতুন নতুন নিয়ম কানুন চালু করে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হবে না- এটা তাদের বিশ্বাস। আইন যেহেতু বানাচ্ছে সেই পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমই, তাই এই আইনের প্রতিও তাদের আস্থা থাকে না। তবে এটিও মনে রাখতে হবে যে, র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা পিতৃতন্ত্রবিরোধী, পুরুষবিরোধী নন। র্যাডিকেল ফেমিনিস্টদের বিষয়ে প্রচার চালানো হয় যে তারা পুরুষকে ঘৃণা করেন, যা সত্য নয়।
ষাটের দশকে যুদ্ধবিরোধী ও মাক্সসিস্ট আন্দোলনের সময় কিছু আন্দোলনকারীর মধ্যে জমে ওঠা হতাশা, বঞ্চনার অনুভূতি ও ক্ষোভ থেকে র্যাডিকেল ফেমিনিজমের উদ্ভব। আন্দোলনে থাকা নারীরা একসময় উপলব্ধি করলেন আন্দোলনের ভেতরেও পুরুষপ্রাধান্য বজায় আছে এবং পুরুষেরা এখানেও নারীর ওপর খবরদারি করার চেষ্টা করছে। তারা টের পেলেন পুরুষ নারীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে রাজি নয়, উল্টো তারা ক্রমশ নারীদের আন্দোলনের বাইরে ঠেলছে। বহু নারী, বিশেষ করে নারীবাদী গ্রুপগুলো তখন এই আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসলেন, বিভক্ত হলেন। কিছু নারীবাদী তখন হয়ে উঠলেন র্যাডিকেল দর্শনে বিশ্বাসী। বিদ্যমান কাঠামো ভাঙতে বদ্ধপরিকর হলেন। প্রথম অবস্থায় নারীর আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা দূর করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। পরে কিছু র্যাডিকেল ফেমিনিস্ট নারীর যৌনতার দিকটিতেও দৃষ্টি দিলেন। র্যাডিকেল পলিটিক্যাল লেসবিয়ানিজমের প্রতিও ঝুঁকলেন কেউ কেউ।
মূলত র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা আন্দোলন করেন নারীর প্রজনন স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ে, এর মধ্যে আছে জন্ম দেবার অধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সেই সাথে ঘরে বাইরে সবখানে প্রচলিত প্রথাগত জেন্ডার রোল ভাঙা, পুরুষের কাজ নারীর কাজ বলে যে স্টেরিওটাইপিং আছে- তা নিয়েও আওয়াজ তোলেন তারা। রেডিক্যাল ফেমিনিস্টরা মনে করেন পর্ণগ্রাফি নারীকে পণ্য করে যা নারীর জন্য ক্ষতির, যদিও কোনো কোনো র্যাডিকেল ফেমিনিস্ট এই মতটি সমর্থণ করেন না। এই ধারার নারীবাদীরা পতিতাবৃত্তিকে নারী নির্যাতন ও নিপীড়ণের একটি অস্ত্র মনে করেন। রেডিক্যাল ফেমিনিজম ধর্ষণের প্রতি প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে কাজ করে। ধর্ষণ যৌনতা নয়, বরং এটি নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ব্যবহার করা একটি অস্ত্র, যা দিয়ে নারীকে শায়েস্তা করার ইচ্ছা পোষণ করে পিতৃতন্ত্র।
র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা সমাজে প্রচলিত মাতৃত্ব ও যৌনতার ধারণা, বিবাহ, নিউক্লিয়ার পরিবার ইত্যাদির কঠোর সমালোচক। সেইসাথে সরকার, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্ম, ঐতিহ্যসহ সব বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনার মুখে রাখেন তারা, প্রশ্ন তোলেন ও পরিবর্তণ দাবি করেন।
র্যাডিকেল নারীবাদীরা নারীদের ভেতরে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করেন, প্রকাশ্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ জারি রাখেন, এমনকি শিল্পকেও তারা প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যহার করেন।
নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গে র্যাডিকেল ধারার আবির্ভাব। সুসান ব্রাউনমিলার, সুলামিথ ফায়ারস্টোন, ফিলিস চেস্টার, মেরি দালি, কেট মিলেট, রবিন মরগান, এলিন উইলিস, আন্দ্রে ডরকিন, জারমেন গিয়ার, জিল জনস্টন, ক্যাথরিন ম্যাককিনন প্রমুখ র্যাডিকেল ধারার নারীবাদী।
র্যাডিকেল ধারার নারীবাদীদের সংগঠনগুলোর একটি রেডস্টকিংস। ১৯৬৯ এ সুলামিথ ফায়ারস্টোন ও এলিন উইলিসের উদ্যোগে গড়ে ওঠে রেডস্টকিংস, যখন নিউইয়র্কের র্যাডিকেল ফেমিনিস্টরা দল ভেঙে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছিলেন। একই রকম আরেকটি গ্রুপ হল W.I.T.C.H (Women’s International Terrorist Conspiracy from Hell)।
র্যাডিকেল ধারার নারীবাদীদের দলগুলো সামাজিক রাজনৈতিক আমূল পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করেছিলেন দীর্ঘদিন। বিশেষ করে গর্ভপাতের অধিকার আদায় আন্দোলনে এই ফেমিনিস্ট গ্রুপগুলোর সক্রিয় দীর্ঘ অংশগ্রহণ ছিল।
সুলামিথ ফায়ারস্টোন নিউ ইয়র্ক র্যাডিকেল উইমেন নামে আরেকটি সংগঠনের কো-ফাউন্ডার ছিলেন। এছাড়া তিনি শিকাগো উইমেন’র লিবারেশন ইউনিয়ন গড়েছিলেন আরেক নারীবাদী জো ফ্রিম্যানের সাথে। সুলামিথের বিখ্যাত বই ‘The Dialectic of Sex’, প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। সুলামিথ ফায়ারস্টোন তার বইতে বলেছেন, নারীর উচিত নিউক্লিয়ার পরিবারের কাঠামোর ধারণাটি উল্টে দেয়া।
পরিবার কাঠামোর সাথে নারীর অধীনতার সম্পর্ক নিয়ে নারীবাদের চিন্তা, ধারণা ও তত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা করবো আগামী পর্বে।
[চলবে]