November 22, 2024
কলাম

পিতৃতন্ত্র যখন পিতাকে খুনি বানায়…

মেহেরুন নূর রহমান।। এক পিতা তার ২৬ দিনের শিশুকে খুন করেছে। শিশুটির অপরাধ সে মেয়ে। পিতাটি শুরু থেকেই কন্যা সন্তান হয়েছে বলে অখুশি ছিলো। শিশুটি কাঁদছিলো বলে বিরক্ত হয়ে কোল থেকে নিচে আছড়ে ফেলে তথাকথিত পিতাটি শিশুটিকে হত্যা করে। হৃদয়-বিদারক ঘটনা সন্দেহ নাই কিন্তু এরকম ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়। শুধুমাত্র কন্যা হবার কারণে অসংখ্য শিশু আমাদের সমাজে তাদের পিতা দ্বারা খুন হয়েছে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির এপাশে এরকম ঘটনা দেখেছি। গলা টিপে বাবা সদ্যজাত কন্যা শিশুকে খুন করেছিল। কারণ একই।

এসব  ঘটনা আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি, মেয়েদের প্রতি যে ডিপ রুটেড ভয়ঙ্কর ঘৃণা আছে তাকেই মনে করিয়ে দেয়।

ক্রিমিনাল মাইন্ডেড পিতারা হয়তো সরাসরি খুন করে ফেলে কিন্তু মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সমাজের পিতা এবং মাতারা মেয়েদের খুন করে আরেকভাবে। তাদের পায়ে বেড়ি বেঁধে, তাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে, তাদের স্বপ্নকে বিনাশ করে, তাদের অসম্পূর্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করে তাদের সত্তাকে  খুন করে প্রতিনিয়ত।

আমাদের ৭ বোন ১ ভাইয়ের সংসার। ৫ বোনের পর ভাই, বলাই বাহুল্য পুত্র সন্তানের আশায় আমার পিতা-মাতার সংসার এতো বড় হয়েছে। আমার মা অসম্ভব রকম মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন একজন নারী ছিলেন। আমার আজকে নারী হিসেবে যে বোধ, যে অহং তার অনেকটাই পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে। সে মা-ই একসময় পুত্র সন্তান হচ্ছে না বলে নিজেকে অসম্পূর্ন মনে করেছিলেন। ৪ কন্যা হবার পর আমার বাবা বলেছিলেন যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। কিন্তু আমার মা পুত্র সন্তানের জন্য জেদ ধরে বসেছিলেন। কারণ যে সমাজব্যবস্থার মধ্যে তিনি বড় হয়েছিলেন, সেখানে পুত্র সন্তানের মায়েরা বেশি সন্মানিয়া আর কন্যা সন্তানের মায়েরা করুণার পাত্র। এ অবস্থার খুব যে একটা পরিবর্তন হয়েছে তাই বা জোর গলায় কী করে বলি।

একটা মজার ঘটনা বলি। আমার ৫ নাম্বার বোন হবার পর আমাদের মা- বাবার আসেপাশের প্রতিবেশী নারী এবং পুরুষেরা মনে করলেন আবারও মেয়ে? মতিন সাহেব (আমার বাবা) নিশ্চয়ই অনেক রেগে আছেন, বৌকে হয়তো বকাবকি করছেন সুতরাং তারা দল বেঁধে আমাদের বাসায় আসলো বাবাকে বোঝাতে যেন তিনি আমার মায়ের উপর রাগ না করেন। তারা এসে দেখলো আমার মা বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছেন, বাবা চুলাতে মায়ের জন্য ডিম সেদ্ধ করতে দিয়েছেন এবং আমার বোনের নাভিতে সেক দিচ্ছেন। তারা খুব অবাক হয়েছিল।

এ সমাজে কন্যা প্রসবের কারণে মায়েরা নিগৃহীত হবে এবং কন্যাটি অবহেলার শিকার হবে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কখনো এই অবহেলা খুনে রূপান্তরিত হয় এই আর কি।

আমাদের এক প্রতিবেশীর গল্প জানি, স্ত্রী গর্ভবতী হবার পর ছেলে হবে আশা করে তিনি কিছু দামি খেলনা, তোয়ালে, টয়লেট্রিজ ইত্যাদি কিনেছিলেন। পুত্রের জায়গায় কন্যা হবার পর ওসব জিনিস আলমারি থেকে বের হয়নি। ওই লোকের স্ত্রী দুঃখ করে আমার মাকে এসব বলেছিলেন।

প্রতিবেশি দেশ ভারতে কন্যা ভ্রুণ হত্যার ঘটনা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। গত ৩০ বছরে ১২ মিলিয়নের বেশি কন্যা ভ্রুণের অ্যাবরশন হয়েছে। ভাবা যায়? ১২ মিলিয়ন? কি ভয়ঙ্কর অন্যায়। আমেরিকার মত দেশেও বহু সময় ধরে পরিবারগুলোতে সন্তান হিসেবে ছেলে শিশুর প্রতি প্রেফারেন্স বেশি ছিল। এখন যদিও এটা কমে এসেছে।

কন্যাদের পিতার প্রিন্সেস বলা হয়। কত মধুর গল্প আছে এই নিয়ে। কিন্তু সেই সাথে যে কত বীভৎস গল্প আছে তা আমরা আড়াল করে রাখি। বাবা দ্বারা কন্যা সন্তানের যৌন হয়রানির বহু ভয়াবহ ঘটনা আছে যেসব নিয়ে আমার আলোচনা করি না বা করতে আমাদের অস্বস্তি হয়। লন্ডনের এক বাংলাদেশি বাবার ঘটনা বলি। তার তিন কন্যা। কন্যাদের সে ক্রমাগত রেইপ করে গেছে বছরের পর বছর। স্ত্রীকে মেরে বকে হত্যার হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত সব জানাজানি হলে সে লোক বলেছিলো, আমি খাওয়াই, আমি পরাই, আর সেই মেয়েদের কি না অন্যলোক এসে ভোগ করবে? আমার মেয়েদের উপর আমার অধিকার সবচেয়ে আগে। সুতরাং খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে বা খাওয়াবে পরাবে বলে মেয়েদের নিয়ে যা ইচ্ছা তা করার অধিকার আছে বলে বহু পুরুষ মনে করে। তারা মেয়েদের পড়ালেখা করাবে না, বাল্য-বিবাহ দেবে, চাইলে ভোগ করবে কিংবা ইচ্ছা হলে খুন করবে।

বহু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখেছি মেধাবী মেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ করতে চায়না কিন্তু সাধারণ মানের ছেলের শিক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে। এছাড়া মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা তো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। সনাতন ধর্মে এই সেদিন পর্যন্ত মেয়েরা পিতার সম্পত্তির ভাগও পেত না।

মেয়েদের সবকিছুতেই সমস্যা। তারা জোরে হাসলে সমস্যা, ইচ্ছামত সাজতে চাইলে সমস্যা, তারা প্রেম করলে সমস্যা, তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা আবার তারা বিয়ে না করতে চাইলে সমস্যা। পুত্র না হলে শেষ  বয়সে কে দেখবে, কবরে মাটি কে দেবে কিংবা মুখাগ্নি কে করবে এই ভেবে ভেবে বাবা-মায়েদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এই সব নানা কারণে কন্যা সন্তান হলে পিতা এবং মাতা দুজনেরই মুখ ভার হয়। বাবা-মায়েরা মেয়েদের বোঝা মনে করে, দায় মনে করে। অথচ চাইলে তারাই কিন্তু এটা দূর করতে পারে। মেয়ে এবং ছেলে দুজনকেই এক রকমভাবে বড় করলে মেয়েদের দায় ভাবার কোন কারণ দেখি না, বরং একটা শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ে, একটা ছেলের চেয়ে কোন অংশে কম না। আমাদের সমাজে এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে শেষ বয়েসে ছেলেরা মা-বাবাকে ফেলে চলে গেছে, তখন মেয়েরাই তাদের দেখছে।

একটা মানুষ একদিনে মেয়েদের ঘৃণা করতে শেখে না বা খুনি হয়ে ওঠেনা। তার পরিবার, শিক্ষা, সমাজ তাকে দিনে দিনে এমন এক নারীবিদ্বেষী খুনিতে রূপান্তরির করে যে নিজের মেয়েকে খুন করতেও পিছুপা হয় না। বহু বছর ধরে চলে আসা এই পিতৃতন্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পুরুষদের মানবিক হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে স্বার্থপর পুরুষ হতে। একই ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী অসংখ্য নারীও পাকাপোক্ত করেছে এই ব্যবস্থাকে। আর এই কারণেই শুধুমাত্র কন্যা হবার কারণে ফুলের মত শিশুদের তাদের পিতার হাতে মরতে হয়। এরপরও  কি নারীদের হুশ হবে না? এরপরও কি তারা প্রতিবাদ করতে না শিখবে না পিতৃতন্ত্র’র বিরুদ্ধে?

নিজের কথা নিজে না বললে কেউ শোনে না। তাই প্রথমত মেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে। দয়া করে শিক্ষিত হোন, স্বনির্ভর হোন। লিঙ্গভেদে সমাজের দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে কথা বলুন। মেয়েদের শিক্ষার জন্য আওয়াজ তুলুন। মেয়েদের উপর হওয়া সব রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলুন। পরিবারে আপনার কিংবা আপনার কন্যার উপর কোন অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করুন। আপনার কন্যা এবং পুত্রকে সমভাবে বড় করে তুলুন যেন তারা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শিখে। বিশ্বাস করুন মুখ বুজে থাকলে, মাথা নিচু করে থাকলে কোন লাভই হয় না বরং পরে পরে মার খেতে হয়। পুরুষদের অন্যায় অনেক তো মুখ বুজে সইলেন, এবার আওয়াজ তুলুন। শুধু নিজের বা নিজের কন্যার জন্য নয়, আপনার আশেপাশে যে কোন নারীর উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন, তাদের সাহসী হতে সাহায্য করুন। কন্যা হন্তারক, ধর্ষক রাক্ষসদের যেন দৃষ্টান্তমূলক কঠোর বিচার হয় সে ব্যাপারে কথা বলুন। পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক, স্বার্থপর, অসৎ, বিবেকহীনদের গালে জোরে চপেটাঘাত করার জন্য নিজের এবং কন্যার হাতকে শক্ত করুন এবং অন্যদের সচেতন করুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]