পুরুষতন্ত্রের সিগারেট
আঞ্জুমান রোজী।। পুরুষের আধিপত্য ঘরে-বাইরে সবখানে। নিজ ঘরে মা, বোন, স্ত্রীর উপর যে আধিপত্য, কর্তৃত্বগিরি পুরুষ চালায় ঠিক একই কায়দায় বাইরেও অন্য নারীর উপর আধিপত্য ও কর্তৃত্বগিরি করে। পুরুষদের ভেতর এই মানসিকতা জন্ম থেকেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এখন পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং যোগ্যতা থাকুক আর না-থাকুক, পুরুষ তো পুরুষই। অর্থাৎ সর্বেসর্বা। পুরুষদের এই মানসিকতাকে এড়িয়ে চলা যে কোনো নারীর পক্ষেই কঠিন কাজ। সময় বিশেষে নারীকে পুরুষের অসুর শক্তির কাছে নত হয়েও থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতির শিকার ঘরে-বাইরে সকল অবস্থায় নারীকে পড়তে হয়৷
দু’দিন ধরে একটা ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। একটা নারী বাইরে বসে সিগারেট টানছিলো। তাতে অন্য পুরুষের মাথাব্যথা হয়ে গেলো। কারণ সিগারেট শুধু পুরুষের এবং তারা সেই সিগারেট ঘরে-বাইরে সব জায়গায়, সব অবস্থায় টানতে পারে। মেয়েদের সেই অধিকার নেই। এমন একটা মিথ পুরুষের মাথায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঢুকিয়ে দিয়েছে। শুধু সিগারেটই না, যে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা, ব্যভিচার করার অধিকার বা এখতিয়ার শুধু পুরুষের। এই মানসিকতা থেকে একটা পুরুষ এসে সিগারেট টানা নারীটিকে উচ্চবাচ্য করে হেনস্তা করছিল। সেইসঙ্গে অন্য পুরুষও জড়ো হয়ে নারীটিকে নাজেহাল করতে উদ্যত হলো।
আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে ভিডিওটা দেখি। নারীর সিগারেট টানাই কি শুধু! মাথায় ঘোমটা না দিলে, কোন পুরুষের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে, এসবের দিকেও পুরুষগুলো কড়া নজর রাখে। আমার কথা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ। তার উপর, সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।’ যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের বিষয়টি সমমর্যাদায় রাখা হয়েছে এবং সেইসাথে সরকার প্রধান আছেন নারী, সেখানে এই একবিংশ শতকে এসে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান কত নিচুতে চলে গেছে, তা কল্পনাও করা যায় না। ধিক্কার জানাতে হয় সমস্ত সিস্টেমকে। ধিক্কার জানাতে হয় সকল নেতা-নেত্রীকে। বলতে গেলে তাদের জন্যেই আজ সাধারণ নারীরা এতো ভুক্তভোগী। নাহলে, পুরুষগুলো এতো সাহস পায় কেমন করে?
নারীর মুখে সামান্য সিগারেট টানা নিয়ে পুরুষগুলোর যেমন ধমকাধমকি দেখলাম, তাতে বাংলাদেশকে তালেবানী রূপ দিতে আর বেশি দূরে যেতে হবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে সিগারেট টানার পক্ষে নই। আর টানলেও সেটা যেখানে সেখানে অবশ্যই না৷ কিন্তু নারীটিকে সিগারেট টানার ব্যাপারে যেভাবে বকাঝকা করছিল, তার অর্থ হলো ভালো নারীরা সিগারেট টানতে পারে না। এর সঙ্গে আরো নারী হয়ে চলার যত বিধিনিষেধের তকমা ঝরাচ্ছিলো৷ অর্থাৎ মূল সমস্যা হলো নারী। পরিবেশ দূষণের কারণে যদি নারীটিকে বকাঝকা করতো তাহলেও বিষয়টা বিবেচনায় আনা যেতো। কিন্তু, দেখা গেলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষালি মানসিকতা।
ধর্মীয় গোড়ামীর আস্ফালনেই মূলত বাংলাদেশে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি এবং পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি কঠিন আইন বা ব্যবস্থা না নেয় তাহলে সমুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোনোকিছুই থাকবে না। আমি আবারও বলছি, নারীর সিগারেট টানার ভিডিওটি শুধু সিগারেট টানার অপরাধকে বিবৃত করেনি, করেছে নারীসত্তার উপরে আঘাত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]