November 23, 2024
কলামফিচার ২

দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার পরাধীনতার ছবি

মাসকাওয়াথ আহসান।। একজন নাগরিক কিছু আইনি অনুশাসন মেনেই একটি রাষ্ট্রে বসবাস করে। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রও তাকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে চলার রক্ষাকবচ দেয়। এইভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের একটি স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক তৈরি হয়। রাষ্ট্রের চোখে প্রতিটি নাগরিকই সমান; নারী বা পুরুষ বলে তাকে আলাদা চোখে দেখা হয় না।

একটি রাষ্ট্রে জনসমক্ষে কী করা যাবে; কী করা যাবে না; সে সম্পর্কেও কিছু নির্দেশাবলী রয়েছে। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার মাঝে; এরকম কোন ম্যানেজার নিয়োগ করা হয়নি; যে এসে নাগরিকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে কোনটি ঠিক কোনটি ঠিক না তা শেখাবে।

অথচ এরকম স্বপ্রণোদিত বা উপযাচক হয়ে নিজেই লেগে পড়া অনেক ম্যানেজার চোখে পড়ে; যে এসে অনধিকার চর্চা করে; ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইচ্ছার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। আর এই ব্যাপারটা নারীর সঙ্গেই বেশি ঘটে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে একজন স্বপ্রণোদিত উপযাচক ম্যানেজার চোখে পড়লো; যে একজন নারীকে ধূমপান বিষয়ক শিক্ষা দিচ্ছে। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; তা নারী-পুরুষ উভয়েরই জন্য। কিন্তু ঐ ম্যানেজার “নারীর ধূমপান”-কে সমাজের চরিত্রের জন্য একমাত্র ক্ষতিকর বিষয় বলে মনে করছেন। ভিডিওতে আরো অনেক সহ-ম্যানেজার জুটে গিয়ে “নারীকে” নানা উপদেশে জর্জরিত করে; নারীটি যেখানে বসে ছিলেন সেখান থেকে তাকে উঠে যেতে বাধ্য করে। একজন সচেতন মানুষ নারীটির ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্ন তুললে অন্যেরা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।

ফলে একবিংশ শতকের একটি মেট্রোপলিটান শহরে; অষ্টাদশ শতকের এক গ্রাম্য সালিশির দৃশ্য রচিত হয়। এই যে নারীকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে জুটে যাওয়া উপযাচক ম্যানেজার; এর সংখ্যা অসংখ্য। সময়ের বিবর্তনে নারী শিক্ষা-দীক্ষা ও পেশাগত দক্ষতায় পুরুষকে পিছে ফেলে এগিয়ে গেছে। ভিডিও-তে দৃশ্যমান নারীই উপযাচক ম্যানেজারটির চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে। কারণ নারীর মনোযোগ তার নিজের শিক্ষায়; আর ম্যানেজারটির মনোযোগ নিজের চরকা ফেলে “নারী কী করবে; না করবে” তা ঠিক করার দিকে। এই করতে করতে তিনি আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিক হবার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছেন। “নিজের চরকায় তেল না দিয়ে নারীর চরকায়” তেল দিতে উদ্যত এরকম অসংখ্য ম্যানেজার নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে।

রাস্তাঘাটে অন্যকে নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে বেড়ানোটা যে বে-আইনি কাজ; এটা এখন রাষ্ট্রকেই স্পষ্ট করে বোঝাতে হবে তার উপযাচক সামাজিক পুলিশদের।

সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে সেই সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হতে হবে। পথে-ঘাটে-যানবাহনে-পাবলিক প্লেসে নারীর জন্য ভীতিপ্রদ অবস্থা বিরাজ করা;
নারীর মৌলিক নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা। পাবলিক প্লেসে “নারীকে অপমান ও হেনস্থা” করা তার মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

রাষ্ট্রকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এই সমস্যা সমাধানের বিষয়টি। আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীকে এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বোঝাতে হবে। কারণ “নারীকে যত্রতত্র নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া” যে একটি বে-আইনি কাজ; এ সম্পর্কে অনেক নাগরিকই অবগত নয়। অবলীলায় তারা এই অপরাধটি করে চলেছে। ফলে আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদেরই “নারীর বিরুদ্ধে এই অপরাধ দমনে” ভূমিকা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ কী করে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এগিয়ে গেলো; এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে; বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যত বেড়েছে; অর্থনীতি তত এগিয়ে গেছে। যেসব দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নেই; তারা অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়েছে।

কতিপয় স্বপ্রণোদিত নৈতিকতার ম্যানেজারের বে-আইনি নৈতিকতা পুলিশিকে বন্ধ করা না গেলে; নারীর জন্য ভীতিপ্রদ পরিবেশ বিরাজ করলে; বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা থমকে যাবে।

নৈতিকতার ম্যানেজারি বা ঠিকাদারি করে বেড়ানোটা একটা মানসিক রোগ বিশেষ। প্রশ্রয় পেলে এই রোগ বাড়ে। আলোচিত ভিডিও-র দৃশ্যটি সারাদেশে নানা অজুহাতে নারীকে হেনস্থা করা; তাকে গলার জোরে দাবিয়ে রাখার একটা সাধারণ দৃশ্য; এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে; যা’র ভিডিও ধারণ করা হয়নি; তা-ই তা রয়েছে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এইখানে নারীর চলাচলের নাগরিক স্বাধীনতাটুকু না থাকলে; দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার পরাধীনতার ম্লান ছবিটা স্পষ্ট হয়।

একজন পুরুষ যে নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করে; একজন নারী ঠিক সেই নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করবে; এ হচ্ছে খুব সোজা একটা কথা। এই সোজা কথাটা যারা বুঝতে পারছে না; বা এটা বোঝাকে যারা প্রয়োজনীয় মনে করছে না; তাদেরকে এই সোজা কথাটা বোঝানোর দায়িত্ব সমাজের সচেতন নাগরিকদের। আর ‘এই সোজা কথাটা’ যে আইনের কথা; তা বোঝানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ বিষয়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের একটি সম্মিলিত উদ্যোগ এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]