নৈতিকতার বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মোরাল পুলিশের ‘ভালো মেয়েরা’
মেহেরুন নূর রহমান।। চারিদিকে মেয়েদের ধূমপান সংক্রান্ত পোস্ট দেখতে দেখতে আমার নিজের শেয়ার করা একটা পোষ্টের কথা মনে পড়লো। ৬০ এর দশকের বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রিন্ট অ্যাড শেয়ার করেছিলাম মজা করে, যেটি ছিলো মেয়েদের ধূমপানে উৎসাহ দেয়া সংক্রান্ত। ওখানে বলা হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের (নাম মনে নাই) সিগারেট পান করে আপনি ক্লাসি, স্মার্ট ইত্যাদি হন- এরকম কিছু। সামাজিকতার কারণে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যে কম হলেও (লুকিয়ে অনেকেই করে) প্রচুর নিম্নবিত্ত নারী বিড়ি, তামাক এসব পান করে আসছে এদেশে বহুকাল আগে থেকেই। মেয়েদের ধূমপান আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ ছেলে এবং মেয়ে দুজনের জন্যই। যারা ধূমপান করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই জেনে-শুনে-বুঝে ধূমপান করে। সুতরাং তাদের নিয়ে বলার কিছু নাই। সব জেনেশুনে যারা এই কাজটি করে তাদের বোঝানো সহজ কম্মো নয়। তবে যারা বলে ছেলেরা ধূমপান চাইলে করতে পারে কিন্তু মেয়ে হয়ে ধূমপান করা যাবে না সেই সব লোকদের আমার চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। এরা সারাক্ষণই ব্যস্ত কোনটি ছেলের কাজ, কোনটি মেয়ের কাজ এই গবেষণায়। কোন ধরনের পোশাক মেয়েরা পরতে পারবে না, কোন ধরনের জব মেয়েরা করতে পারবে না ইত্যদি ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে তাদের দিন যায়। মেয়েদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, মেয়েদের কীভাবে দমিয়ে রাখা যায়, মেয়েদের কীভাবে চুপ করিয়ে রাখা যায় এসব ভাবা ছাড়া এসব অসুখি আত্মার আর কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না। এরা পারলে বস্তাবন্দি করে মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতো এবং এরা তাদের তৈরি করা নিয়মের বাইরে মেয়েদের কোনো কিছু করার অধিকার আছে বলে মনে করে না।
অনেকেই হয়তো বলবেন ধূমপানের করতে বলা না বলার সঙ্গে নারীকে দমন করার কী সম্পর্ক? আছে, অবশ্যই সম্পর্ক আছে। শুধু মেয়ে হবার কারণে যে কোনো কিছু, যা মেয়েদের পক্ষে করা সম্ভব, সেগুলোতে মেয়েদের জন্য বলা প্রতিটা “না” এর মধ্যে মেয়েদের দমন করবার ইচ্ছার বীজ রোপিত থাকে।
একটি মেয়ে তো বড়ই হয় অসংখ্য না এর মধ্যে দিয়ে। এটা করতে পারবে না, ওখানে যেতে পারবেনা, এর সাথে মিশতে পারবে না, দেরি করে ঘরের বাইরে থাকতে পারবে না, নিজের ইচ্ছা মত বন্ধু নির্ধারণ করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তার উপর পরিবারের ভেতর এবং পরিবারের বাইরে চলে মোরাল পোলিসিং।
একটি মেয়ে নিজের মত বাঁচতে পারেনা, চলতে পারেনা, জীবন যাপন করতে পারেনা। চারিদিকে নৈতিকতার বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সো কলড মোরাল পুলিশরা। এদের জন্য পোশাক নিয়ে মেয়েদের কত রকম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, কত রকম কথা শুনতে হয়! আজকাল পোশাক সম্পর্কিত শালীনতার মাত্রাও বদলে গেছে। এখন হিজাব ছাড়া আর কোন পোশাকই কিছু কূপমন্ডুক নারী-পুরুষের কাছে শালীন না।
সেদিন এক ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখলাম, যেখানে এক লোক একটি মেয়ের ভিডিও করছে। পোশাকে দেখতে ভদ্রলোকের মতো লোকটি ভিডিও করছে এবং হেসে হেসে বলছে, আমাদের ঘরের মেয়েরা তো এরকম হিজাব ছাড়া বের হয়না, আপনি কেন হিজাব ছাড়া বাইরে বের হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ভিডিও করে মেয়েটিকে খুব লজ্জায় ফেলে দিতে পারছে সেই জান্তব আনন্দ লোকটির চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিলো। কে এই সব অসৎ লোকদের দায়িত্ব দিয়েছে নির্ধারণ করতে মেয়েদের পোশাক কী হবে না হবে? কোনো সভ্য দেশে কি এইভাবে কেউ কারো ভিডিও করতে পারে?
মেয়েরা দেখবেন মোটরসাইকেল দুপাশে পা ছড়িয়ে বসে না, কারণ তাহলে মেয়েটি অসভ্য, অভব্য খেতাব পাবে। আমি নিজে দেখছি অনেককে সার্কাস্টিক কমেন্ট করে এভাবে বসা মেয়েদের অপ্রস্তুত করে দেয়ার চেষ্টা করতে। মেয়ে মানেই নরম, কোমল, মেয়ে মানেই লাজুকলতা সুতরাং সাহসী, প্রথাভাঙা নিজের মত বাঁচতে চাওয়া কোন মেয়েকে দেখলে তাদের গা জ্বলুনি হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
কোনো মেয়ে কাজের জন্য অথবা পড়াশুনার কারণে রাত করে বাড়ি ফিরছে, বা বাড়ি ফিরছে তার কোন ছেলে বন্ধু বা কলিগের সাথে, অমনি আশেপাশের মোরাল পুলিশরা জেগে উঠবে। বদনাম তো ছড়াবেই সেই সাথে বাড়ি বয়ে এসে ভালোমানুষির নাম করে মেয়েটির বাবা/মা/শশুর/শাশুড়ি/স্বামীর কান ভরে দিয়ে মেয়েটির জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। ভাবুন একবার, যারা অন্যের বাড়ির মেয়েদের নিয়েই এসব করে তাদের নিজেদের বাড়ির মেয়েদের জীবন কতটা দুর্বিষহ?
তো এই ধরণের জাতির বিবেকরাই রায় দেয় ধূমপান করা মেয়েদের উচিত না। পুরুষদের জন্য ধূমপান না বলা যেতে পারে কারণ এটা অস্বাস্থ্যকর কিন্তু মেয়েদের জন্য ধূমপান নিষিদ্ধ কারণ এটা তাদের জন্য অনৈতিক। ভালো মেয়েরা কখনো ধূমপান করে না। একমাত্র খারাপ, উশৃঙ্খল মেয়েরাই ধূমপান করে সুতরাং আমার ঘরের মেয়ে, আমার ঘরের বউ ধূমপান করতে তো পারবেই না, সেই সঙ্গে বাইরের কোন মেয়ে ধূমপান করলে তাকেও বাজে মন্দ কথা বলার অধিকার আমার আছে। কি অডাসিটি!
কিছু কিছু রিসার্চে বের হয়েছে যে ধূমপানে মেয়েদের লাংস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অর্থাৎ ধূমপানের ক্ষতিকারক প্রভাব মেয়েদের উপর পুরুষদের চেয়ে বেশি হতে পারে। ভালো মানুষের মত এই যুক্তি অনেককে দিতে দেখেছি যেন তারা মেয়েদের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব কনসার্নড। আরে ভাই ক্ষতির প্রভাব কম বেশি যাই হোক না কেন ধূমপান দুই পক্ষের জন্যই খারাপ। সুতরাং আপনি যদি ধূমপানকে না বলতে চান তাহলে ছেলে মেয়ে দুজনের জন্যই না বলতে হবে তার ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা ভেবে। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা হচ্ছে না। পুরুষরা দেদারসে রাস্তাঘাটে ধূমপান করে যাচ্ছে, কই তাদের ছবি বা ভিডিও তো ভাইরাল হচ্ছে না? আসল কথা হলো যেসব লোকজনকে মেয়েদের ধূমপান করতে দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায় তারা কিন্তু এর ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা ভাবে না। তারা মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা ভাবিত না। তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে একটা মেয়ে কেন ধূমপান করবে? এতো সাহস? এটা তাদের রাগান্বিত করে। এরা পারলে শারীরিকভাবে মেয়েটিকে আঘাত করতে চাইবে কিন্তু পারছে না বলে নানাভাবে তাকে লজ্জায় ফেলতে চায় বা অপমান করতে চায়।
ধূমপায়ী নারীরা (এবং পুরুষেরা), স্বাস্থ্যের কথা ভেবে, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকেন পারেন। এইসব অথর্ব, ইতর নৈতিকতার ধজ্জ্বাধারীদের কারণে নয়, নিজের ভালোর জন্য ধূমপান না করার কথা ভাবতে পারেন এবং সেটা হোক আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]