December 23, 2024
সাহিত্যফিচার ২প্রবন্ধ

রনে দেকার্ত এবং তার ‘মন দেহ দ্বৈতবাদ’

আতিকুল ইসলাম ইমন।।

“মন ও শরীর দুই আলাদা বস্তু। ফলে মন ও দেহ স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে।”

পাশ্চাত্যে আধুনিক দর্শনে ভাববাদকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে বলে যতটুকু দাবি করা হয়- ততটুকু পুরোপুরি সত্য নয়। পাশ্চাত্য সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা যে দর্শন চর্চার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল তা ইউরোপীয় ভাববাদেরই ফল। সে কারণেই ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও পুঁজিবাদ নামের তিন ভয়ংকর বাদের প্রতাপশালী উদ্ভব। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিস্তর তত্ত্ব একদিকে যেমন দিয়েছে সুবিধা- তেমনই একজনের সুবিধা যে আরেক জনের অসুবিধার কারণ হয়েছে- সেই সমস্যার বিস্তারিত সমাধানে ইউরোপীয় দর্শনের আগ্রহ দেখা যায়নি। পরে অবশ্য মার্ক্সবাদের আবির্ভাবে মানুষে-মানুষে সাম্যের কথা উঠেছে, তা অর্থনৈতিক মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছে। পাশ্চাত্য ভাববাদকে সম্পূর্ণভাবে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েই মার্ক্সবাদ তা করেছে।

ইউরোপীয় আলোকযুগের আবির্ভাবে প্রধানতম কুশলী ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত ঈশ্বরকে বস্তু জগত থেকে আলাদা করেছেন, তবে দর্শনের ছাঁচে নব উদ্যমে নব পন্থায় পুরনো ভাববাদেরই উন্মেষ ঘটেছে তাতে। কারণ পাশ্চাত্য দর্শন যাজকতন্ত্রকে শৃঙ্খলে পুরলেও এর উদ্ভবের কারণকে দিয়েছে দার্শনিক ভিত্তি। খ্রিস্টানিজমের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে অস্বীকার করেনি, বরং করা হয়েছে আরও পাকাপোক্ত।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী, মানুষের সঙ্গে আরেক প্রাণীর সম্পর্ক কী, মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষেরই বা সম্পর্কের কথা জোর দিয়ে বাতলে দেওয়ার প্রচেষ্টা পাশ্চাত্য দর্শনে লম্বা সময় ধরে অনুপস্থিত ছিল। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে— প্রকৃতির প্রতি নির্মমতা, মানুষে মানুষে অসহযোগিতা, মানুষে প্রাণিতে নৃশংসতা ইত্যাদি পাশ্চাত্য সমৃদ্ধিরই ওপিঠ। ইউরোপীয় দর্শন চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হলো দ্বৈতবাদ। মানুষ-প্রাণি, সভ্যতা-প্রকৃতি, প্রাচ্য-পশ্চিম, পুরুষ-নারী ইত্যাদি দ্বৈতবাদী মূল্যবোধ- আধুনিক সময়ের দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তায় বড় প্রভাব ফেলেছে। পশ্চিমে দ্বৈতবাদের উদ্ভব দর্শন চিন্তার ইতিহাসের শুরু থেকেই। তবে রনে দেকার্ত, ইমানুয়েল কান্টের মতো দার্শনিকরা দ্বৈতবাদী কাঠামোকে আধুনিক দর্শন চিন্তার ভিত্তি করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ নাম।

বিশেষত রনে দেকার্ত দ্বৈতবাদকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। একে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও ভবিষ্যত দর্শন চিন্তার ভিত্তিরূপে স্থাপন করেছেন। রনে দেকার্তের মন দেহ দ্বৈতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্ব। দ্বৈতবাদের আলোচনায় রনে দেকার্তের মন দেহ দ্বৈতবাদ বিষয়ক আলোচনা সবার আগেই হওয়া প্রয়োজন। দেকার্ত যেভাবে তার মন দেহ দ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন তা দর্শনে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা।

রনে দেকার্ত শুরুতেই অতীতের সকল দার্শনিকি অবস্থান অস্বীকার করে তার ভাবনা শুরু করেন। দেকার্তের মতে, ইতিমধ্যেই যা প্রমাণিত বা ইতিমধ্যে যা স্বতঃসিদ্ধ তা আমি নিজে পরীক্ষা করিনি, ফলে আমি তা স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করতে পারি না। দেকার্ত এমনভাবে শুরু করেন- যাতে মনে হবে এর আগে কোনো দর্শনচর্চা হয়নি, অর্থাৎ আগের সব অবস্থানকেই অবহেলা করেন তিনি। তবে তিনি আগের কোনো অবস্থানকেই অস্বীকার বা অপ্রমাণিত বলেও ঘোষণা দেননি। দর্শনের অভিজ্ঞতাবাদ ও যুক্তিবাদের দ্বন্দ্বে তিনি যুক্তিবাদের আশ্রয় নেন। দেকার্ত জানান, ইতিমধ্যে জানা সবকিছুকে যদি একটি ইমারতের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে তিনি এই ইমারতটি পুরোপুরি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। তারপর আবার তা নতুন করে গড়ে তুলবেন। তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হলো এই যে, নিজে প্রমাণ করেননি এমন কোনো বিষয়ই তিনি গ্রহণ করবেন না। অর্থাৎ তিনি শুরু করেন এটা ধরে নিয়ে, এর আগে কিছুই নেই। অধিবিদ্যার প্রত্যেকটি প্রশ্ন তিনি নিজে সামনে আনেন এবং একে একে তা বিশ্লেষণ করেন। দেকার্ত তার দার্শিনিকি ভাবনার পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করেন। কেননা তাকে প্রত্যেক বিষয় পরীক্ষা করতে হবে। তাই একটি অমোঘ পদ্ধতি প্রয়োজন। এ কারণেই মূলত দেকার্ত দর্শনের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছেন।

অভিজ্ঞতাবাদ নিজের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেই নিশ্চিত জ্ঞান বলে ধরে নেয়। অর্থাৎ অভিজ্ঞতাবাদীরা নিজের ইন্দ্রিয় দ্বারা নিজে জ্ঞান আহরণ না করলে সেটাকে নিশ্চিত বলে মেনে নেন না। এর সমালোচনায় যুক্তিবাদীরা বলেন- ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ জ্ঞান সবসময় নিশ্চিত জ্ঞান হয় না। যেমন উদাহরণস্বরূপ- হাতি ও অন্ধ লোকদের গল্পটি উপস্থাপন করা হয়। কোনো লোক যদি চোখ বন্ধ করে হাতি সম্পর্কে জ্ঞান নিতে যায়, তবে কেউ বলবে হাতি একটি দড়ির মতো, কেউ বলবে হাতি একটি দেওয়ালের মতো আবার কেউ বলবে হাতি হচ্ছে মূলত মোটা খুঁটির মতো। ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞান হাতি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের কোনো মাধ্যম নয়। যুক্তিবাদীদের মতে, প্রত্যেকটি সত্যকেই যুক্তির দ্বারা পরীক্ষা করে করে দেখতে হবে তা প্রকৃত জ্ঞান কি না। জ্ঞান হতে হবে অ্যাবসুলেট সার্টেইন। পূর্বানুমান নির্ভর নয় বরং প্রশ্নাতীত।

ফার্স্ট ফিলোসোফিতে দেকার্ত প্রস্তাব করেন- দর্শনে নিশ্চয়তা বা সার্টেইনিটি খুঁজে পেলেই দর্শন একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে। তাই ‘নিশ্চিত’ এর খুঁজে তিনি ইতিমধ্যে তার জনা সব বিষয়কে নিয়ে আসেন প্রশ্নের আওতায়। প্রশ্ন করে করে যে বিষয়টি অপ্রমাণিত হবে তা বর্জিত হবে এবং যা প্রমাণিত হবে তা হবে গৃহীত। শুধু অপ্রমাণিত বা মিথ্যা বিশ্বাসকেই দেকার্ত বর্জন করবেন না, বরং ফার্স্ট মেডিটেশনে দেকার্তের ঘোষণা- তিনি সন্দেহযুক্ত বিশ্বাসকেও বর্জন করবেন। কেননা সন্দেহযুক্ত বিশ্বাস তার নিশ্চিত ভিত্তি বা জ্ঞানের ইমারতটি দাঁড় করাতে সহায়ক হবে না। দেকার্তে তার পরীক্ষার আওতায় সব বিষয়কে এনে তিনি দেখতে চান— এমন কোনো বিষয় আছে কি না, যা নিশ্চিত। তিনি দেখতে চান এমন কোনো সত্য আদৌ আছে কি না যাতে কোনো বিচারেই সন্দেহ করা যাবে না। এটা মূলত যুক্তিবাদী দার্শনিকদের পদ্ধতি যা দেকার্তের বহু আগে থেকেই চর্চিত।

দেকার্ত যুক্তিবাদী দার্শনিক হিসেবে স্বভাবতই শুরুতে তার ইন্দ্রিয়কেও বর্জন করেন, কেননা তিনি বলেন, এতদিন আমি যেসব বিশ্বাস করেছি তার কারণ হলো এই ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ জ্ঞান। তবে আমি দেখেছি এর মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান প্রায়ই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ফলে ইন্দ্রিয় আমাকে আবারও প্রতারিত করতে পারে। অর্থাৎ, দেকার্ত অভিজ্ঞতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে যুক্তিবাদের আশ্রয় নেন।

শুরুতেই দেকার্ত নিজেকে সন্দেহ করেন। তিনি সন্দেহ করেন ‘তিনি’ বলে আদৌ কেউ আছে কি না। তিনি সন্দেহ করেন ‘তিনি’ যে ‘তিনি’ তা তিনি জানলেন কিভাবে। তার যে শরীর তা বাস্তবে আছে কি না। কারণ তার অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। দেকার্ত তার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণে যুক্তি দেখান- যদি তিনি সন্দেহ করেন তবে একটি সন্দেহ করার ক্ষমতাসম্পন্ন বস্তু আছে। অর্থাৎ, তিনি আসলে চিন্তা করছেন কি না এমন সন্দেহ করার মাধ্যমে মূলত তিনি নিশ্চিত করছেন যে তিনি চিন্তা করছেন। কারণ তিনি চিন্তা না করলে এই সন্দেহটি জন্ম নিত না। যেহেতু তিনি চিন্তা করছেন- তাই চিন্তা করার জন্য একটা কিছু আছে। সেই একটা কিছুই হলেন তিনি বা ‘আই’ অর্থাৎ তার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন। এর মাধ্যমে দেকার্ত মাত্র এতটুকু নিশ্চিত হলেন যে, ‘আই’ বা ‘দেকার্ত’ বলে একটা সত্তার বাস্তবতা আছে। তবে এ পর্যন্ত তিনি হলেন শুধুই এমন একটি সত্তা যা চিন্তা করতে পারে। এবং তার এই সত্তার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হলেন। তবে সন্দেহ থাকলো যে- এই ‘আমি’ শুধু হয়ত চিন্তা করতে পারি অর্থাৎ, সন্দেহ, কল্পনা ইত্যাদি। শরীর বা দেহ বলে কিছুর বাস্তবতা আছে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। এর মাধ্যমে দেকার্ত আজীবন সংশয়ের চক্র থেকে মুক্ত হলেন। কারণ, একটি জায়গায় গিয়ে তার সংশয় থেমে গেছে, সেটা হলো তার নিজের অস্তিত্ব। তিনি যে একটি চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নিশ্চিত বস্তু- সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হলেন। দেকার্তের মতে, মন হলো পরম নিশ্চিত সত্তা যা গণিতের এক্সিওমের মতো।

এর মাধ্যমে দেকার্ত নিশ্চিত হলেন জ্ঞানের নিশ্চিত ও প্রশ্নাতীত ভিত্তি হলো মন। এখান থেকে অবরোহ পদ্ধতিতে অন্য সকল সত্য ও নিশ্চয়তার সন্ধান করা যাবে। মনের বাস্তবতা নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে দেকার্ত জানলেন, তিনি যা ভাবছেন তা নিশ্চিত বা সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু যেহেতু ভাবছেন তাই সেরকম কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ, কেউ যদি একটি টেবিল দেখে, তবে হয়ত তার সামনে সেই টেবিলের অস্তিত্ব নেই কিন্তু চার পায়া, চতুষ্কোণি সমতলপৃষ্ট বিশিষ্ট একটি বস্তুকে যে টেবিল বলে তার অস্তিত্ব আছে। কমপক্ষে শক্ত, ত্রিমাতৃক স্থান দখল করে, আঘাত করলে শব্দ করে এরকম বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব আছে। কারণ তা না হলে এসব ‘বৈশিষ্ট্য’ মন ধারণা করত না। অর্থাৎ, টেবিল বাস্তবে নাও থাকতে পারে কিন্তু টেবিলের ধারণা আমার মনের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং মন যেহেতু আছে, মন যেহেতু সব ধারণা ধারণ করে তাই ‘মন’ হলো জ্ঞানের পরম ভিত্তি। এ পর্যন্ত দেকার্তের সিদ্ধান্ত- মনের যা যা জানা তা ধারণা হিসেবে জানা।

তবে ‘মন’ সত্তার এমন নিশ্চয়তার পর দেকার্তের যে সমস্যাটি উদ্ভব হয় তা হলো আত্মজ্ঞানবাদ। সত্তা হিসেবে মন নিশ্চিত হলেও এটাও তো হতে পারে যে, মন যা ভাবছে তা ভুল। হয়ত এমন হতে পারে এই মনটি আক্রান্ত। অর্থাৎ, মন নিজের মতো একটি বাস্তবতা তৈরি করেছে, যা দেখছি তা সবই মনের তৈরি। ‘আমার’ শরীরসহ সামনে যা যা দেখছি, স্পর্শ করছি, স্বাদ নিচ্ছি সবই মনের কল্পনা। ‘আমার’ মন ধারণা করছে সামনে একটি টেবিল রাখা, এটা শুধুই মন সৃষ্টি করেছে নাকি বাস্তবেই সামনে একটি টেবিল রাখা এটি নিশ্চিত হতে হবে দেকার্তকে। ‘আমার’ সামনে টেবিল দেখছি কিন্তু ‘আমি’ যদি নিশ্চিত না হই এটি ‘আমার’ সামনে আদৌ রাখা কি না তাহলে বাস্তব জগতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে না, এমনকি দেহের অস্তিত্বও প্রমাণিত হবে না।

বাস্তবতার প্রমাণ করতে দেকার্তের সবচেয়ে জরুরি হলো ঈশ্বর সত্তার প্রমাণ করা। কারণ দেকার্ত আগেই যুক্তি দিয়েছেন, আমার মন হয়ত সিজোফ্রেনিক, মন হয়ত নিজেই স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। দেকার্ত এক টুকরো ওয়াক্স হাতে নেন, তিনি জানান এটি দেখতে, গন্ধে ও ধারণা অনুযায়ী ওয়াক্সের মতো, এটি শক্ত, তাই কিছুতে আঘাত করলে শব্দ হয়। এই ওয়াক্সের গন্ধ, স্বাদ ও দৃশ্যমান অস্তিত্ব আছে। ‘আমি’ এটাকে ওয়াক্স হিসেবেই ভাবছি কেন? কারণ ওয়াক্সের কিছু বৈশিষ্ট্য ‘আমার মন’ ধারণা করছে। যার এসব নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে সে ওয়াক্স বলে ‘আমার মন’ ঠিক করে রেখেছে। দেকার্ত ওয়াক্সের টুকরোটি আগুনের পাশে নেন, ফলে তা গলে যায়। আগুনে গলে যাওয়া ওয়াক্সের গন্ধ, স্বাদ বা আকৃতি কোনটাই আর রইলো না অর্থাৎ ওয়াক্স হতে হলে যে বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তা আর ওই বস্তুতে থাকলো না। দেকার্ত যুক্তি দেন, এখন যদিও ওয়াক্সের আকৃতি, স্বাধ, গন্ধ কোনোটাই নেই তবুও আমি জানি এটি একটি ওয়াক্স ছিল। কারণ তথ্য সংগ্রহের জন্য ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। ইন্দ্রিয় আমাদের বলে এটির, স্বাদ, গন্ধ, আকৃতি কী? তবে ইন্দ্রিয় আমাদের জন্য ভাবে না। যদিও ‘আমি’ এখন ওয়াক্সের আকৃতি, স্বাদ, গন্ধ কোনোটাই পাচ্ছি না, তবুও ‘আমি’ জানি এটা ওয়াক্স কারণ আমার মন ইন্দ্রিয়দ্বারা প্রাপ্ত তথ্য থেকে ধারণা করছে এটি ওয়াক্স, কিন্তু এখন গলে গেছে। ‘কোনো কিছু’ কী কারণে ‘কোনো কিছু’ তা ওই ‘কোনো কিছু’র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা থেকে মন ঠিক করে। মন হলো ভাবনা করার উপযুক্ত সত্তা। তবে মনের জড় অস্তিত্ব নেই। তবে এতেও ওয়াক্সের জড় অস্তিত্ব নিশ্চিত হয় না। কারণ, ওয়াক্সের যেসব বৈশিষ্ট্য তা মন দ্বারা বোধগম্য হয়েছে কিন্তু বাস্তবে কি তা ‘আমার’ হাতে একটুকরো ওয়াক্স আছে ? যেমন কেউ ইউনিকর্ন সম্পর্কে ধারণা করতে পারে, ইউনিকর্ন হতে হলে কিছু আকৃতিগত ও গুণগত বৈশিষ্ট্য তার মনে আছে, মন তা ভাবছেও কিন্তু বাস্তবে ইউনিকর্নের অস্তিত্ব নেই। এটি একটি কল্পনা। একইভাবে শুধু আমার দেহ দেখছি ও স্পর্শ করছি বলেই তার জড় অস্তিত্ব নিশ্চিত হয় না, তবে দেহের ধারণাটি দেহের নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে আমার মনে আছে। হয়ত আমি স্বপ্নে আছি এবং এসব দেখছি, স্পর্শ করছি, স্বাধ নিচ্ছি সবই স্বপ্নে হচ্ছে।

এখন দেকার্তের সবচেয়ে জরুরিভিত্তিতে প্রমাণ করা প্রয়োজন একজন ঈশ্বর আছেন (পরম সত্তা) এবং তিনি মনকে প্রতারিত করেন না। অর্থাৎ, জড় পৃথিবীর অস্তিত্ব প্রমাণে সবার আগে প্রয়োজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়া। দেকার্তের যুক্তি অনুযায়ী ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে জড় জগতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে না। প্রশ্ন হলো- ঈশ্বর মনকে প্রতারিত করতে পারেন কি না? দেকার্তের মতে ঈশ্বরের সংজ্ঞাটাই এমন যে তিনি প্রতারণা করবেন না। ঈশ্বরের ধারণা যদি প্রমাণিত হয় তবে তিনি প্রতারণা করেন না নিশ্চিত গুণসম্পন্ন এমন কোনো সত্তা বলেই তিনি ঈশ্বর। যদি ঈশ্বর সত্তা না থাকে বা যদি ঈশ্বর মনকে প্রতারণা করেন তা সত্য হয়, তবে দেকার্তের কোনো যুক্তিই আর দাঁড়ায় না। শুধুমাত্র মনের নিশ্চয়তার সমস্যা হলো এতে বাস্তব জগতের জড় অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।

দেকার্ত যুক্তি দেন, শুধুমাত্র ‘ঈশ্বর’-এর ধারণা ছাড়া প্রত্যেক ধারণাই শুধু কল্পনা হওয়ার ঝুঁকি আছে। কারণ ঈশ্বর হলেন এমন এক সত্তা যা প্রত্যেক জিনিসের ইতিবাচক গুনাগুণের চূড়ান্ত রূপ। অর্থাৎ সকল ইতিবাচকতার চূড়ান্ত হচ্ছেন ঈশ্বর। ঈশ্বর অবশ্যই অসীম। সসীম হলে তিনি কোনো গুনের অসীম ধারক হতে পারবেন না। সসীম হলে সেই সত্তা সংজ্ঞাগতভাবে ঈশ্বর নয়। ঈশ্বর সম্পর্কে দেকার্তের মনে যে ধারণাটি আসলো তা হলো, ঈশ্বর অসীম ও সব গুনের অসীম ধারক। দেকার্তের মতে, যেহেতু ঈশ্বর সম্পর্কে স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র এক ধারণা আমার মনে আছে, যেহেতু কোনো কিছু কোনো কারণ ছাড়া উৎপত্তি হতে পারে না তাই ঈশ্বরের ধারণা আমার মনে আসার একটি কারণ আছে। অর্থাৎ একটি ওয়াক্সের টুকরো সম্পর্কে আমার ধারণা আছে- কারণ ওয়াক্সের টুকরোর নানা বৈশিষ্ট্য যেমন স্বাধ, গন্ধ, আকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আমার মনে একটি ধারণা আছে। একইভাবে ঈশ্বরের ধারণা আমার মনে এসেছে কারণ ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা আমার মনে আছে, এই ধারণা কোনো কারণ (Cause) ছাড়া মনে আসেনি। একটি নিখুঁত, ত্রুটিহীন সত্তার ধারণা একটি ত্রুটিযুক্ত কারণ (Cause) থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। সুতরাং আমার মনে যে নিখুঁত সত্তা সম্পর্কে ধারণাটি এসেছে— তার কারণও (Cause) হলো নিখুঁত।

ঈশ্বর সত্তা প্রমাণে দেকার্ত দ্বিতীয় যুক্তি হলো, আমার অস্তিত্বের (যদিও তা এখন পর্যন্ত শুধু মন) কারণগুলো (Causes) কী? কোনো একটা কারণ (Cause) থেকে আমার অস্তিত্ব উদ্ভূত। আমি আমার নিজের অস্তিত্বের জন্য নিজেই কারণ হতে পারি না, কেননা- নিখুঁত, নির্ভুল সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র ধারণা আমার মধ্যে রয়েছে। যদি আমার নিজের অস্তিত্বের কারণ আমি নিজেই হয়ে থাকি তবে আমিও নিখুঁত ও নির্ভুল হতাম। কিন্তু আমি নিখুঁত ও নির্ভুল সত্তা নই, ফলে আমার অস্তিত্বের কারণ আমি নিজেই হতে পারি না। অর্থাৎ, আমি আমাকে সৃষ্টি করিনি। তাই একটি চিন্তক সত্তা হিসেবে আমার অস্তিত্বের কারণ (Cause) অন্য একটি নিখুঁত, নির্ভুল সত্তা যা ঈশ্বর (GOD/ Absolute Substance)।

দেকার্ত ঈশ্বর সত্তা প্রমাণিত করার মাধ্যমে শরীরের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা প্রমাণের দ্বার উন্মুক্ত করেন। দেহের বাস্তবতায় নিশ্চিত হতে হলে প্রথমে ইন্দ্রিয়ের নির্ভরযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতায় নিশ্চিত হতে হবে। তিনি যুক্তি দেখান, প্রায়ই সেন্স ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন এতোই বাস্তব যেন কিছু দেখছি বা ধরছি কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় এসব বস্তুর কোনো অস্তিত্ব আর পাওয়া যায় না। এখন বস্তু সম্পর্কে যেসব ধারণা আসে সেগুলোর কারণ কী ? দেকার্ত যুক্তি দেন, বস্তু সম্পর্কে যতো ধারণা (যেমন সামনে একটি টেবিল দেখা যাচ্ছে, টেবিলের ধারণা) তার কারণ আমার মন নয়। আমার মন শুধু ধারণা করতে পারে, কিন্তু কোনো বস্তু তৈরি করতে পারে না। সামনে যে বস্তুটি আছে বলে ধারণা করছি- এই বস্তুর নিশ্চয়ই কোনো অস্তিত্ব কোনো এক জায়গায় আছে (আকৃতি, স্বাধ, গন্ধ ইত্যাদি)। এবং ওই প্রকৃত বস্তুটি আমাদের মনে ধারণা সৃষ্টির কারণ, যেহেতু এর বস্তুগত বৈশিষ্ট্য না থাকলে আমার মনে ধারণা সৃষ্টি হবে না। এবং অবশ্যই ঈশ্বর এই বস্তু তৈরি করেছেন এবং ঈশ্বর আমাকেও (মন) তৈরি করেছেন কিন্তু বস্তু সম্পর্কে আমার মনে যে ধারণা সৃষ্টি হয় তা ঈশ্বর তৈরি করেন না বরং ওই বস্তুই তৈরি করে। অর্থাৎ, বস্তু সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয় তার কারণ বস্তু নিজেই।

এখানে দেখা যায় দেকার্ত দেহের প্রমাণ দিতে গিয়ে এরিস্টেটেলিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। দার্শনিক প্লেটোর মতে, প্রতিটি বস্তু একটি ধারণার জগতে নিখুঁত অবস্থায় থাকে। আমাদের জগতে আমরা যা দেখি বা চিনি তা হলো নিখুঁত বস্তুর অনুকরণ। দেকার্ত বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণে প্লেটোর ধারণার জগতের সাহায্য নিয়েছেন।

এমন প্রমাণাদির ভিত্তিতে দেকার্ত মন দেহ দ্বৈতবাদের প্রস্তাব করেন- মন সম্পর্কে আমার স্বতন্ত্র ও পরিষ্কার ধারণা রয়েছে যে এটি একটি চিন্তাশীল সত্তা। দেহ সম্পর্কে আমার স্বতন্ত্র ও পরিষ্কার ধারণা রয়েছে যে এটি একটি চিন্তাহীন বস্তু। সুতরাং মন দেহ থেকে স্বতন্ত্র একটি বস্তু- এবং মন ও দেহ স্বতন্ত্র ও আলাদাভাবে অবস্থান করতে পারে।

দেকার্তের যুক্তি অনুযায়ী, যদি ঈশ্বর প্রতারণা করেন অর্থাৎ মনে বস্তু সম্পর্কে ধারণা ঢুকিয়ে দেন যা আসলে বাস্তব নয় তবে বস্তুজগতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। আবার ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে ‘আমি’ বা ‘মন’-এর উদ্ভবের ‘কারণ’ও পাওয়া যায় না। তাই ‘আমি’ প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে দেকার্ত ঈশ্বর সত্তা প্রমাণ করেছেন এবং আমরা জানি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যই হলো প্রতারণা না করা। যেহেতু ঈশ্বর প্রতারণা করেন না তাই মনে বস্তু সম্পর্কে ধারণা ঈশ্বর তৈরি করেন না, ঐ বস্তুই ধারণা সৃষ্টির জন্য দায়ী।

দেকার্তের এই আর্গুমেন্টের মাধ্যমে সমস্ত বস্তু জগতের অস্তিত্ব নিশ্চিত প্রমাণিত হয়। দেকার্ত যে নিশ্চয়তার খুঁজ করছিলেন তাতে পাওয়া যায়, মন সত্য, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্য, ও দেহের অস্তিত্ব সত্য। দেকার্তের দার্শনিক ভাবনার শুরুতে যে ধার দেখা যায় যত সময় যায় তা ততোই স্থূল হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। বারট্রান্ড রাসেল এ ব্যাপারে স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘দেকার্তের দর্শন চিন্তার ধ্বংসাত্মক অংশটুকু যতটা আকর্ষণীয় গঠনমূলক অংশটি ততটা আকর্ষণীয় নয়। কারণ, দেকার্ত সবকিছু যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেও ঈশ্বর বা পরম সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ করেছেন পূর্বধারণা দিয়ে। পরম সত্তা বা অনির্ভরশীল কোনো সত্তার নিশ্চয়তা প্রমাণে দেকার্ত আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নেন।

পুরোহিতদের রোষানল থেকে বাঁচতে দেকার্ত অধিবিদ্যার মৌলিক প্রশ্নের উত্তরগুলোকে অনেকটাই ধর্মের মোড়কে ঢেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন বলে বহু চিন্তাবিদ মনে করেন। দেকার্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে পরম সত্তার (absolute substance) নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু আর্গুমেন্টের বিস্তর অধ্যয়ন করলে তাতে বড় ফাঁক ধরা পড়ে।