September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

জননী জন্মভূমিশ্চ

দিলরুবা পাপিয়া।। সকালটা শুরু হয়েছে ব্লাড দিয়ে। ছোটবেলায় ব্লাড নিলে আমি খুব রাগ করতাম। মনে হতো, এতো অসুখ- বিসুখের মধ্যে ডাক্তারের কোনো আন্দাজ নেই- নিজেই এতো ব্লাড নিয়ে নিচ্ছেন! আর বাবা-মা কিছু বলছে না কেন? তখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অনেকেই একটু বেশি সম্মানীতে বাড়িতে আসতেন, এবং রক্ত নেয়ার কাজটা তারাই করতেন! টেকনিশিয়ান হেসে বললেন- ম্যাম, এখনও সাধারণ অনেকেই, বিশেষ করে একটু কম পড়াশোনা জানা বড়রাও এই কথাটিই বলেন- ভাই, আমার শইল এমনেই দুর্বল, সব রক্ত তো আফনেই লইয়া গেলেন!

তারপর নার্স। সকাল ৬টায় নাস্তার আগে উনার যা যা কাজ সব নিজ দায়িত্বে ঠিকঠাক করে গেলেন। একজন নার্স হাসপাতালের প্রাণ। তার প্রাণান্ত ছোটাছুটি! তবু দেখি বাংলাদেশে ক’দিন পরপর নার্স তাদের সম্মান আর বেতন-ভাতার দাবিতে রাস্তায় নামছে। তাদের তো কোনো প্রাইভেট প্র্যাকটিসও নেই। হয়তো তারা আজও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো- সেবার ব্রত নিয়ে সেবাটাই শুধু করে যাচ্ছে। তবুও সম্মানটা তো আমরা দিতে পারি। সেটাও সর্বত্র নেই। হাসপাতালের সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে থাকেন ডাক্তার। আমি কোনোভাবেই তাদেরকে অসম্মান করছি না। আমি বরং বলি, বিশ্বমানের ডাক্তার আমার দেশে আছে। তাহলে তারা কেন একজন রোগীর কাছে বিশ্বস্ত হতে পারেন না? কেন প্রতিদিন দেশের কোটি কোটি টাকা কেবল ভারতের কাছেই চলে যাচ্ছে? অন্যান্য দেশ বাদই দিলাম। কিন্তু এই দায়িত্ব কার? এই নিয়ম, নীতিমালা কে বানাবে? আমি- আপনি? আমাদের রাজা- উজির- নাজির সবাই জ্বর- কাশিতেও বিদেশ চলে যান। তাঁরা আমাদের অভিভাবক। তাঁরা যদি নিজের দেশের স্বাস্থ্যসেবার উপর আস্থা রাখতে না পারেন- আমাদের রেখে যান কোন ভরসায়? আমরা কি এই দেখে লজ্জিত হবো না?

আমি আমার মেয়ের অ্যাজমার জন্য একজন ডাক্তার দেখাই। একটি নামী ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে। যেহেতু উনি ডাক্তার ভালো। উনার সময় এখানে ৮.৩০- এ। উনি চাকুরি করে, অন্য কোথাও রোগী দেখে এখানে আসতে আসতে ১০টা বাজান। আরও বেশিও বাজে। কারণ উনি তো রাস্তার হিসাব ধরেন না। উনি ওখান থেকে কখন বের হবেন সেই সময়টা এখানে বলে দেন। সবাই ৮টা থেকেই এসে জমতে থাকেন। আমি একদিন রাত পৌনে একটায় দেখালাম। তখনও রোগী অপেক্ষায় ছিলেন। আমার বাসা কাছে বলে এবং উত্তরার সেক্টর সিকিউরিটি ভালো বলে আমি এতো ভয় পাইনি। কিন্তু দূরের মানুষটির কী হবে? তবে যা দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি- কিছুদিন পর আমি অন্য একটি হাসপাতালে আমার হাজব্যান্ডকে ভর্তি করিয়েছি। একটা প্রয়োজনে রাত দুইটায় নিচে ঔষধের দোকানে আসি- একটা কফি খাবারও লোভ। ১২টার আগেই হাসপাতালের কেন্টিন বন্ধ হয়ে যায়। বেয়ারাকে দিয়ে একটা কফি আনিয়ে বসে খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি ওই ডাক্তার রিসেপশনে জিজ্ঞেস করছেন- রোগী ক’জন আছে। আমি মুখ নিচু করে বসে আছি লজ্জায়। বেয়ারাকে নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম। বেয়ারা আমাকে বললো: ম্যাডাম, এই জীবনের কী অর্থ বলেন- মানুষের বাঁচতে কতো টাকা দরকার?

পাশে ২/৩ টা চা, কফির দোকান সারারাতই খোলা থাকে। কারণ বাংলাদেশে নরমাল ওয়ার্ডের রোগীর এটেনডেন্ট সারারাত চা, কফি খায়, আর এখানে- সেখানে বসে থাকে। একটা কেবিন নেয়া সম্ভব না। রোগীর সাথে লোকও থাকতে হয়। তিনি কীভাবে একটু ঘুমাবেন- তার দায়িত্ব কারো নেই। যে রোগীর অপারেশন হচ্ছে- তার আত্মীয় বন্ধুরা অপেক্ষায়, বাকি রাত কোথায় কাটাবে, এতোরাতে কোথায় যাবে? অনেককে রক্ত ক্রসম্যাচ করে বসিয়ে রাখে। যদি রক্ত লাগে। লাগলো বা লাগলো না। কিন্তু রাত ২ টায় তারা কীভাবে যাবে? কেউ জানে না। সরকারি হাসপাতালের হাজার রকম নাম- ধাম-বদনাম নিয়ে তো ছোটবেলা থেকে ত্রাহিত্রাহি অবস্থা! কিন্তু আমি একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কোভিড পজেটিভ নিয়ে ভর্তি আছি। কারিকারি টাকা যাদের জন্য গুনতে হবে, হচ্ছে। সেখানেও ডাক্তার আসার কোনো নির্দিষ্ট সময় নাই। সকাল থেকে নার্স তার কাজ করেছেন, সিদ্ধান্ত দিবেন ডাক্তার। কিন্তু তিনি আসেননি। বাসায় আমার সন্তান, নিকটাত্মীয়দের কোনো আপডেট দিতে পারছি না। তাদের এই বঙ্গের লাট কে বানিয়েছে? পয়সা নেবে অগনিত, শ্রম দেবে গুনে। তার মানে এখানেও নিয়মনীতি, জবাবদিহিতা কঠোর থাকতে হবে।

সুতরাং সর্বত্র এক জায়গাতেই ফিরতে হবে। কতোদিন আর রবি ঠাকুরের কথায় বলবো- যা- কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।” এই কথা আর কতোদিন? তারপরও দেশকে ভালবাসি। এখনও শিশু থেকে বৃদ্ধ কাঁধে হাত রেখে গাই- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!

 

দিলরুবা পাপিয়া: শিল্পী। বর্তমানে শিল্পকলার ইতিহাসের উপর গবেষণারত

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]