অপলা’র একদিন
সায়মা আরজু।।
বিলবোর্ডটি থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা অপলা। ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে গাড়ি প্রায় পনের মিনিট হলো,তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে থাকতে হবে আরো কিছুক্ষণ। সাধারনত এসব জ্যামে বসে থাকতে অসহ্য লাগে অপলার, কিন্তু আজ লাগছেনা। বিলবোর্ডের ছবিটা তাকে টানছে। ছবিটাতে একটা কোঁকড়া চুলের মিষ্টি মেয়ে এক হাতে মায়ের আঙ্গুল ধরে আছে, অন্য হাত দিয়ে আড়াল করে মায়ের কানে কানে বলছে আইসক্রিম, আর ইনসেটে তার বাবার ছবি, বাবা আইসক্রিম হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। খুবই সাধারন অভিব্যক্তি কিন্তু কি অসাধারন মিনিং! ম্যজিকের মত একে অন্যের মনের কথা বুঝে ফেলা!
আহা এমন সত্যি সত্যি যদি হত! ছোট বেলায় কত আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হত। সেই কাঠির মাথায় লাল, সাদা বা কমলা রঙের আইসক্রিম, উপরে নারকেল কুড়িয়ে দেয়া। খেতে খেতে জিভ লাল টুকটুকে বা গাঢ় সবুজ হয়ে যেত। হাসি পায় অপলার। রোজ তো দূরের কথা, কালেভদ্রে পাওয়া যেত সেই অমৃত, তারপর যতক্ষন পারা যায় ততটা সময় নিয়ে চেটে চেটে খাওয়া। এখনও ইচ্ছে করে রাত বিরাতে বাইরে গিয়ে আইসক্রিম খেতে, তবে সেটা গরমকালে মোটেও নয়, শীতে কিংবা ঘোর বর্ষায়, হালকা কুয়াশা বা দোলনচাঁপার ঘ্রান সমেত, এটাও দুস্প্রাপ্য।
অপলা বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক, মেয়েটির মুখ পাল্টে যায়, ঠোঁটের দিকটা, থুতনিটা অপলার মত হয়ে যায়, অপলা চেয়ে থাকে। মেয়েটি দৌড়ে আসে, অপলার কোলে বসে। অপলা আদর দেয়, আঙুল ধরে চুমু খায়।
ড্রাইভার কালাম গাড়ি থেকে নামে, এদিক ওদিক উঁকি দেয়, খানিকটা সামনে আগায়। সালেহীনের নম্বরে ডায়াল করে অপলা। অপর দিকে ফোন বেজে বেজে এক সময় রিংটোন শেষ হয়। মনে মনে অপলা প্রহর গোনে হয়তো সালেহীন এখনই ফোন করবে, ফোন ভাইব্রেশনে কিনা চেক করে, কিন্তু না, সব ঠিক আছে কেবল ফোনটাই আসছেনা, হয়তো আসবেওনা।
অপলা চারপাশে তাকায়, সামনে একটা জটলা মত মনে হয়। ড্রাইভার কালামও গাড়ি থেকে বের হয়ে ওদিকটাতেই গেল। অপলা অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হয় । ইতিমধ্যেই বই বিক্রেতা, তোয়ালে বিক্রেতা জানালায় টোকা দেয়। ‘লাগবে চুইং জিঞ্জার, চকলেট, মিমি, লজেন্স, পান মশলা’ বলে চৌদ্দ -পনের বছরের একটা ছেলে অপলার ধার ঘেঁষে জানালায় দাঁড়ায়। অপলা হাত ইশারায় না বলে। ছেলেটা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, ঘ্যানঘ্যান করে। অপলা অল্প একটু গ্লাস নামিয়ে বিশ টাকা দিয়ে একটা চুইং জিঞ্জার কেনে। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে রে
– বাবা ওয়ালা ধরছে
– এখানে?
– হ
– কার কাছে বিক্রি করে?
– মোটর সাইকেল নিয়া যারা ঘুরতে আহে, ফডো তুলে। ড্রাইবাররাও কেনে।
– আচ্ছা
অপলা গ্লাস তুলে দেয়, ছেলেটাও পাশের গাড়ির দিকে যায়। ড্রাইভার কালাম ফিরে আসে, সশব্দে সিটে বসতে বসতে বলে,
– আরও তিনডা সিগনাল লাগবো ম্যাডাম
– তোমার স্যার ফোন দিছিলো?
– জ্বী, আপনারে নামাইয়া গাড়ি বন্ধ কইরা দিতে কইছে। সকালে গাজীপুর যাইবে
– হুম
অপলার মনটা ভারি হতে শুরু করে। কালামকে ফোন দেয়া গেল অথচ আমাকে ফোন করা গেলনা, ভাবে অপলা। তাছাড়া আজ ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর থেকেই কিছুটা অস্থির সে, একটা মায়াভরা হাত, একটা স্নেহের আশ্রয় খুব দরকার ছিল এখন। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে অপলা। শ্রান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়।
অপলা একটা ঢালু খাড়া এন্ট্রেন্স পেরিয়ে বাজার মতো জায়গায় ঢোকে, ঢোকার মুখটাতে নিজের টাল সামলানোর জন্য তাকে অনেকটাই দৌড়ে নামতে হয়েছে। অপলা দেখল অনেকগুলো সারিবদ্ধ দোকান, তবে বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। জায়গাটা অন্ধকার, ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে, হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে টিমটিমে কেরোসিনের বাঁতি জ্বলছে। অপলার মনে হল এ জায়গাটা তার চেনা, সে আগেও এখানে এসেছে। তবে আজ এসেছে ছোট হাঁড়িকুঁড়ি কিনতে। পুরো বাজারটা অস্বস্তিকর জায়গা বলে মনে হয়। অপলা দ্রুত তার কেনাকাটা শেষ করে। এবার বের হবার পালা। বের হবার রাস্তায় এসে অপলা অবাক হয়, এতটা খাড়া পথ পার হয়ে সে বের হবে কী করে? অপলা একটু অপেক্ষা করে, দম নেয় তারপর একদৌড়ে খানিকটা উঠতে চেষ্টা করে কিন্তু না, হলনা, মাত্র তিন পা এগুনো গেল। অপলা নেমে আসে তবে দমে যায় না, তাকে বের হতেই হবে। এবার সাহস নিয়ে আবার দৌড়ে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে যতটা পারা যায়, প্রায় মুখের কাছাকাছি এসে আর পারেনা, অপলা হাত বাড়িয়ে একটা খাঁজ কাটা জায়গা ধরে ফেলে, এখান থেকে পড়ে গেলে খুব ব্যাথা পাবে, মাথায় ইনজুরিও হতে পারে, মনে মনে ভাবে অপলা। সব শক্তি দিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে, ‘একটু ধরো কেউ, বা একটা দড়ি ফেলো, আমাকে উপরে তোল’। উপরের রাস্তা দিয়ে রিক্সায় করে যাচ্ছিল দুজন মহিলা। তারা এগিয়ে আসে, অপলা উপরে ওঠে।
হঠাৎ ইঞ্জিন সচল হয় এতক্ষন আটকে থাকা গাড়ি গুলোর। হর্নের শব্দে আর মৃদু ঝাঁকুনিতে বর্তমানে ফিরে আসে অপলা। শেষ বারের মত কোঁকড়া চুলের মেয়েটার দিকে তাকায়, আদর দেয়, নিজের অজান্তেই চোখে পানি আসে। অনেকগুলো লাল, সবুজ, হলুদ আলো গায়ে মেখে; অকারণ অপ্রয়োজনীয় সব ভাবনাদের সাথে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে মহল্লার দোকান থেকে লিটার আইসক্রিম কিনে বাসায় ঢোকে।
দরজা থেকেই সালেহীনের সাথে চোখাচোখি হয়, না কোনো আলাদা অভিব্যাক্তি নেই, অপলাকে অনেকটা অগ্রাহ্য করেই সে সোফায় বসে কারো সাথে কথা বলছে। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে ঢোকে অপলা। সহজে কী করা যায় ভাবতেই সবজি বক্সে রাখা সকালে কেনা মূলাগুলোর দিকে চোখ পড়ল। টাকি মাছ দিয়ে ভর্তা করবে ভেবে কিনেছিল। সালেহীন খুব পছন্দ করে খায় এই ভর্তাটা। ঝটপট গ্রেটারে মূলা গ্রেট করে লবন মেখে কচলে পাশে রেখে, মাছ ভেজে সেই তেলে গোটা কয় শুকনো মরিচ ভেজে উঠায়। দ্রুত হাতে ভাত আর ডাল চচ্চরি বসিয়ে দিয়ে মাছটা কাঁটা ছাড়িয়ে, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনিয়া পাতা মেখে তাতে মাছ আর জল ঝড়িয়ে নেয়া মূলা মিশিয়ে একটু সরিষার তেল দিয়ে আবার মেখে লবন দেখে নিতে নিতে উঁকি দেয় সালেহীনের খোঁজে । না, ড্রইং রুমে নেই। অপলার আর ভালো লাগছে না, অনেক্ষন ধরে একা একা বিষয়টি মনের ভিতরে চাপ সৃষ্টি করে আছে, আর পারা যাচ্ছে না। খাবার টেবিলে কথাটা উঠায় অপলা।
– আজ ডাক্তারের কাছে গেলাম। তোমাকে ফোন দিলাম, কোনও কিছু …
– হুম, বল ডাক্তার কী বলছে
– তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো
– আমার সাথে কী? গাইনির ডাক্তার না? পুরুষ না মহিলা?
– হুম গাইনির
– পুরুষ না মহিলা?
– লেডি ডাক্তার
– কী বলে? কীসের ব্যাথা?
– ইউটেরাসে নাকি ফ্লুয়িড জমে যায়। ব্যাথাটা থাকবে. . .অথবা ইউটেরাস ফেলে দিতে হবে
– ফেলে দাও। ওটার আর কাজ কী! দরকার তো শেষ
– শেষ মানে? আমি বলেছি তোমাকে…
– আবার বেবি…
ফোন বেজে ওঠে সালেহীনের, বড় বোন হাজেরা আপা ভিডিও কলে, সালেহীন ফোন লাউড স্পীকারে দিয়ে কথা বলে
– হ অনেক দিন এই ব্যথার কাহিনী শুনছি। এহন ফালাইতে কয়।
– ডাক্তার ফালাইতে কইলে ফালাইতে হবে। খরচ কেমন? আমারডার সময় তো পঞ্চান্ন হাজার লাগছিল স্কয়ার হসপিটালে। এখন কেমন?
– খবর লই নাই।
– অফিস খরচা দিব?
– না আমি পামু না।
– হ, দুই জনে চাকরি করস সমস্যা কি। হেয় কই? ডাক কথা বলি
সালেহীন স্ক্রিন ঘুরিয়ে অপলার দিকে দেয়
– শোন ভয় পাইও না
– না ভয় কী
– এহন তো কারো সাথে দেখা হইলেই জিজ্ঞেস করি, কি ইউটেরাস আছে নি? হি হি হি …
হাজেরা আপার কথায় গা গুলিয়ে ওঠে অপলার। না খেয়েই টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে। বেডরুম লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে নিঃশ্বাস নেয়। কি অদ্ভুত, কারো একবার মনে হলোনা অন্য কোন ডাক্তারের কাছ থেকে সেকেন্ড থট নিতে! আর ডাক্তারতো বলেছে পেইন সহ্য করতে পারলে কয়েক বছর থাকুক, এমনি এমনি পেইন কমেও যেতে পারে। কেউ পুরো কথাটা শুনলোই না। আচ্ছা কারো পায়ে গ্যাংরিন হলে কেটে ফেলতে হবে, না হলে জীবন সংশয় একথা জেনেও কি কেউ পা’টা এত সহজে কেটে ফেলতে বলে? নাকি আমার অঙ্গ বলে মূল্যহীন! বিয়ের পরপরই কনসিভ করেছি, কিছু বোঝার আগেই মা হয়েছি, মাতৃত্বকে উপভোগ করব কোথায় , শুধু মায়ের এটা দায়িত্ব, ওটা কর্তব্য, এভাবে দেখিয়ে দিয়েছে সবাই। কিন্তু এখন আমি যখন মাতৃত্বকে অনুভব করবো বলে মা হতে চাই তখন আমার ইউটেরাসের কোনও দরকার নেই। এত পাষান সব! আমার ইউটেরাস আমার নারী সত্ত্বার অহংকার, এর কোনো দাম নেই কারো কাছে! অপলার মনে পড়ে, চাচাতো বোন বুলু আপাকে অপারেশনের পর দেখতে গিয়েছিল সে হসপিটালে। তার হাতটা ধরে কিভাবে নীরব হয়ে ছিল বুলু আপা, এতটা কষ্ট, এতটা মানসিক চাপ! হাজেরা আপার বলা টাকার অঙ্কটার কথা মনে হয়। অপলার অভিমান গলে জল হয়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
ডাইনিং টেবিলে বেশ টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। মনে হয় বাপ- ছেলে মিলে আইসক্রিম খাচ্ছে। নিজেকে বিলবোর্ডের বাবাটির মত মনে হয়, অপলার৷ মনের কথা! কে কার মনের কথা বোঝে, আহারে মন, আহা মন!
অপলা একটা চেয়ার টেনে বসে, পিঠে ব্যাথা হচ্ছে। তাকিয়ে থাকে দূরের আকাশে। আজ হয়তো পূর্ণিমা, কে জানে! অপলার পায়ের উপরে চাঁদের আলো পড়ে, অপলা নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়।
পাশের কোনো ফ্লাটে হাই ভলিয়্যুমে টিভি চলছে। হিন্দি ছবি দেখছে হয়তো কেউ। ‘হামরা আম জনতা হ্যায়, লেকিন হামারি ভি ইজ্জৎ হ্যায়, হাম আজাদি চাহিয়ে…’ ডায়ালগ কানে আসে। আজাদি শব্দটা নেশার মত, যাকে একবার পেয়ে বশে তার কাছে আজাদি ছাড়া সবকিছু অর্থহীন লাগে, এমন কি মৃত্যুও। অরুন্ধতী রায়ের কলামে পড়া কাশ্মীর প্রসঙ্গে আম জনতার প্রাণের সংলাপ মনে পড়ে,
– পাকিস্তান চাও নাকি ভারত?
– আজাদি ‘
আজাদি, আজাদি… স্বাধীনতা শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয় অপলার সারা অস্তিত্বে, আমারও ইজ্জত আছে, ইচ্ছে আছে, ছন্দে আনন্দে বাঁচার সাধ আছে! নাহ, কালই আরেকজন ডাক্তারের সাথে কথা বলব, অল্টারনেটিভ মেডিকেশন থাকলে সেটা নিয়ে কথা বলব। অন্য কাউকে নিজের ইচ্ছের উপরে জায়গা দেয়া চলবেনা, মনে মনে ভাবে অপলা। অপলার নিজেকে এখন আর অতি সাধারণ মনে হয়না। নিজের প্রতি কেমন একটা মায়া অনুভূত হয়। চোখ ছাপিয়ে কোলের উপর টুপটাপ দু-এক ফোঁটা স্নেহের পরশ ঝড়ে পড়ে। কিন্তু মনের ভিতর কোথায় যেন খাঁ খাঁ করে। অপলার আজ খুব একলা লাগে।