পাছে পুরুষত্ব খসে যায়!
তৌকির ইসলাম।। আমাদের সমাজে একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথে তার বায়োলজিক্যাল পরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক আইডেন্টিটি নিয়ে তাকে বড় করা হয়। ফলে শিশুটি যতটা না মানুষ হয় তার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে নারী অথবা পুরুষ।
বিষয়ভিত্তিক এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি আমার চোখের সামনে কিছু দৃশ্য দেখতে পাই। আর সেইসব দৃশ্যপট নিয়েই আমি বুঝাতে চাই যে পুরুষতেন্ত্রর শৃঙ্খলে আমরা কতটুকু আটকে আছি!
স্কুল জীবনে একটি ছেলে শিশু যখন তার মেয়ে সহপাঠীর সাথে ঝগড়াঝাটি কিংবা হাতাহাতিতে পরাস্ত হয় তখন বন্ধুরা তাকে “তুই মেয়েদের হাতে মার খাস” “তুই ছেলে হয়ে মেয়েদের হাতে মার খেলি” বলে অপমান করতে থাকে। পুরুষতন্ত্রের সূত্রপাত হয়ে যায় আমাদের সমাজে সেই শিশুকাল থেকেই। ছেলে শিশুকে শেখানো হয় ছেলেরা কাঁদে না, ছেলেরা ব্যাথা পেলেও কাঁদে না, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বড়। পুরুষতন্ত্র দিয়ে পুরুষের আবেগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয় ছোটবেলা থেকে।
আমাদের সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার অনেকগুলো বৃহৎ কারণের অন্যতম একটি হল এই পুরুষতন্ত্র। পরিবার ও সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষকে মানুষ থেকে পশুতে পরিণত করে। ছোট ছোট উদাহরণ দিয়ে আমি তা একটু আপনাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করছি।
প্রেমের কিংবা বিয়ের প্রস্তাবে মেয়ে রাজি হয় নি এবং একজন মেয়ের কাছে একজন ছেলে হয়েও রিফিউজড হতে হল এই কারণে আমাদের সমাজে কত মেয়ে এসিড এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার সংখ্যা কম নয়। হয়তো প্রস্তাব দেওয়া ছেলেটি এতটা হিংস্র হয়ে উঠত না কিন্তু তাকে তার চারপাশ এই বলে জানান দেয় যে একটা মেয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দিল! তুমি কেমন পুরুষ! আর এতেই সে তার পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে কাপুরুষত্বের পরিচয় দেয়। স্ত্রী নির্যাতনের দিকে এবার একটু চোখ দেওয়া যাক। স্বামী নিজে পুরুষ আর তাই তার পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, স্ত্রীর সিদ্ধান্তকে অবজ্ঞা করা আমাদের সমাজের একটা রুটিন ওয়ার্কের মত। এমন কি স্বামী যদি বোঝেন যে তার স্ত্রী যা করছে তা ঠিক, স্ত্রীকে তার সাপোর্ট দেওয়া উচিত তাতে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে উঠবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। “তুমি কেমন পুরুষ মানুষ যে বউয়ের কথা মেনে নাও” এমন কথা অহরহ শুনতে থাকেন নিজের স্ত্রীর ন্যায্য দাবি সমর্থন করা স্বামী আর তখন সে পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে হয়তো নীরব থাকেন নতুবা স্ত্রীকে থামাতে চেষ্টা করেন কিংবা হয়ে ওঠেন ক্ষেত্র বিশেষে হিংস্র। শুধু কি তাই! একজন পিতাও পুরুষতন্ত্রের আবরণ খুলতে পারেন না। সমাজের কাছে নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে নিজের মেয়ে সন্তানকে সমর্থন করতে পারেন না, মেয়ে সন্তানের ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারেন না। পাছে তার পুরুষত্ব খর্ব হয়। পুরুষ হয়ে অফিসে নারী বসের কাছে স্বীয় কর্মের জন্য দোষ স্বীকার করতে আমাদের বুকে বিঁধে, কারণ আমরা পুরুষ। পুরুষতন্ত্র এতটাই আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
নিজেদের এই পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে আমরা পুরুষতন্ত্রের দাসে পরিণত হয়েছি। পুরুষতান্ত্রিকতার শৃঙ্খলে আমরা এতটাই আটকে গেছি আমাদের আবেগ, বিবেক, ন্যায় অন্যায় সব কিছুর উপরে উঠে নিজে পুরুষ তা প্রমান নিয়ে ব্যস্ত। অথচ পুরুষত্ব কাজে লাগানো যেত প্রতিটি নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, নারীকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে।
পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে আমরা যা করছি তা আমাদের পুরুষত্ব নয়, আমাদের কাপুরুষত্ব, আমাদের পশুত্ব। পুরুষতন্ত্রের কাছে আমরা একজন মানুষ হিসেবে হেরে যাচ্ছি। আমাদের এটা মনে রাখা উচিত আমাদের চলে যাওয়ার পর কেউ বলবে না যে তিনি একজন ভালো পুরুষ কিংবা ভালো নারী ছিলেন, শুধু বলবে যে তিনি ভালো মানুষ ছিলেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]