ধর্ষণের পর ন্যায়বিচার বনাম আধুনিক সতী পরীক্ষা
শামস আবীরুজ্জামান সিয়াম।। আচ্ছা, আপনারা জানেন এই বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯৪৮ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে! আপনাদের নোয়াখালীর সেই বিবস্ত্র মহিলার আর্তনাদের কথা মনে আছে যেখানে বারবার তিনি চিৎকার করে বলছিলেন,‘‘বাবাগো আল্লার দোহাই আমারে ছাইড়া দে!”
সেই ভিডিও দেখে ঘটনার আকস্মিকতা বুঝতে পেরে অনেকে ট্রমাটাইজড হয়ে গেছিলেন, আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভ করে ফেলছিলেন, অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন, আমার মতো যাদের বাসায় মা বোনরা থাকেন তাদের বাসায় কোন সময় দু’চারজন দরজা ভেঙে ঢুকে এই ভয়ে রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেন নি অনেকে, এতটাই ভয়ংকর ট্রমাটাইজড হয়েছিলাম একটা ভিডিওর জাস্ট স্পেকটেটর হয়ে।
তাহলে চিন্তা করেন যার সাথে এই নির্মম ঘটনা ঘটেছে, যে নিজেই এটার ভিক্টিম তার ট্রমা কতটুকু! একজনের ধর্ষণ হওয়ার ভাইরাল ভিডিও দেখেই এমন করুণ অবস্থা আমাদের, অথচ এই চলতি বছরের ৯৪৮ নারী একই ভয়াবহ নৃশংসতার শিকার ছিলেন, প্রত্যেক নারীকে এইভাবেই ধর্ষণ করা হয়, এই ৯৪৮ জনের প্রত্যেকেই এই আতঙ্কের ভেতর দিয়ে গেছেন।
জানেন, ধর্ষণের শিকার এক নারীর জন্য সবচেয়ে ভয়ের কী এবং এই ভয়ংকর নৃশংসতার পর তারা আর কোন জিনিসটা মনেপ্রাণে চাননা?
যেসময় আপনারা মোরাল পুলিশিং শুরু করে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করেন, প্রায়ই যখন এই ধর্ষণের শিকার এই নারীকে সমাজ দুশ্চরিত্রা,পতিতা, বেশ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করে তখন চিন্তা করেন এই ভিক্টিমের উপর দিয়ে কী যায়। ধর্ষণের শিকার নারীরা হয়তো জীবনে আর আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারেনা, তবে তারা একটা জিনিসই চায়, আর তা হলো নোংরা চারিত্রিক অবজেক্টিফিকেশন আর নিজেকে সতী প্রমাণ করা না হোক। কিন্তু আপনার সমাজ, পরিবার, বন্ধু মহল কিংবা রাষ্ট্র কাপড়ের দোহাই দিয়ে কাটাগায়ে মরিচ ছিটকে ক্ষান্ত হননি, ক্রমাগত করে গেছেন দুশ্চরিত্র প্রমাণের চেষ্টা। এবং দুঃখের ব্যাপার এই জিনিস আপনার আইনের মধ্যেও আছে।
হ্যাঁ, সাক্ষ্য আইন ১৫৫ এর উপধারা ৪ সতী পরীক্ষারই আধুনিক রূপ। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অনুসারে, “কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানীর চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিনী দুশ্চরিত্রা।”
অর্থাৎ Reasonable Doubt প্রমাণের জন্য যদি কোনোভাবে অভিযোগ করা ভিক্টিমকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করা যায়,তাহলে ব্যাপারটা এমন হয় যে তার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা প্রমাণ করতে গিয়ে আদালতে ভিক্টিমকে তার চালচলন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন, ক্রমাগত ধর্ষণের বর্ণনা, বৈবাহিক জীবন সম্পর্কিত নানা ধরনের নোংরা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এবং নিজেকে সতী প্রমাণ করতে হয়।
আমি আজ পর্যন্ত এইটা বুঝে পেলাম না যে ধর্ষণের সাথে এই চরিত্রের আদৌ সম্পর্কটা কী। ধর্ষণের সাথে জড়িত হচ্ছে সম্মতি বা কনসেন্ট। কেউ কনসেন্ট ব্যতীত জোরপূর্বক যখন কারো সাথে এই নৃশংসতা দেখায় তখন তা ধর্ষণ। এই জায়গায় একজন মানুষের কনসেন্ট সবসময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মূল্য সর্বক্ষেত্রে সমান।
মানে সে বিবাহিতা হোক, অবিবাহিতা হোক, যৌনকর্মী হোক, দশটা প্রেম করুক না কেন যখন তার “না” এর বিরুদ্ধে গিয়ে জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করা হইসে, সকলের কনসেন্টই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে তারই ভায়োলেশন হয়ে নৃশংসতার শিকার হতে হইসে তাই সেই মানুষগুলা সবাই জাস্টিসের দাবি রাখে।
ডাউট ক্লিয়ারের জন্য আপনার ডিএনএ টেস্টিং, নার্কো টেস্ট, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, শরীরে রেসিসটেন্সের ট্রেইসেস এত্তোসব থাকার পরও কেন আমাকে চরিত্র বেসিসে ধর্ষণের জাজমেন্ট করতে হবে তা আদৌ আমার বোধগম্য হয় নাই, এবং বিশ্বাস করুন হবেও না কোনোদিন।
এই আইন আদতে তাহলে এই মেসেজই দেয় যে সতী সাবিত্রী হলে আপনার কনসেন্টটা বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আপনি যদি দুটা বিবাহ করেন বা তাদের কথামতো সতী না হন তাহলে আপনার কনসেন্ট বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ না।
মানে ব্যাপারটা এরকম যে ডিএনএ টেস্ট, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, নার্কো টেস্ট গোল্লায় যাক, আমরা চরিত্র দিয়ে রিজনেবল ডাউট মাপবো আর আদালাতে আরেকবার ভিক্টিমকে মেন্টালি রেইপ করব।
দেশের বেশিরভাগ ধর্ষিতা নারী কেইস করার সাহস পান না কারণ তারা জানেন ভরা আদালতে নিগ্রহের শিকার হয়ে কুরুচিপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আর তার জবাব দিতেই হবে কারণ শুনানি চলতেসে।
একজন ধর্ষণের শিকার ভিক্টিমকে আপনি চারিত্রিক জাস্টিফেকশন বা নিজেকে সতী পরীক্ষা করেন নানা ক্রস এক্সামিনেশনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আইনতভাবে আরেকবার নিগ্রহের শিকার হতে হয় ভিক্টিমকে।
এইখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে আমরা ভুলেযাই।
আচ্ছা অপরাধী যদি যৌনদাসী হয়, যৌনকর্মী হন,যদি তার চরিত্রে সমস্যা থাকে তারপর যদি সে ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে কি সে ন্যায়বিচার পাবেনা? তার কনসেন্ট ভায়োলেশন হয়ে একই নৃশংসতার শিকার হলে সেটা কি কম গুরুত্বপূর্ণ?
চারিত্রিক ওরিয়েন্টেশন এর উপর জাস্টিস পাবে কি না তা কেন নির্ভর করবে সে কথা আমরা ভাবতে ভুলে যাই, অথচ মানুষ চোর হলেও সে জাস্টিস পাওয়ার অধিকার রাখে।
ধর্ষকের কাছে ধর্ষিত হয়ে আরেকবার ভিক্টিম ধর্ষণের শিকার হন, শুধু এবার কোনো শারীরিকভাবে নয়, বরং আইনের মাধ্যমে!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]