November 3, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

আমার বাবা কোনোদিন সমুদ্র দেখে নি!

রেহমান মুস্তাফিজ।। হ্যাঁ, আমার বাবা কোনোদিন সমুদ্র দেখে নি। খোলা চোখে দেখতে খুবই সাধারণ একটা বিষয়। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়টা এত সহজও না আবার৷ আমার বাবা তার চাকরি জীবনে প্রায় ৬-৭ বছর চট্টগ্রামে ছিলেন। তবুও এক দিনের জন্যও সমুদ্র দেখেন নি। আপনার মনে হতে পারে হয়তো তার কখনো সমুদ্র দেখার শখ হয় নি বা সমুদ্র তাকে টানে না বলেই সমুদ্র দেখে নি। এটা হয়তো মেনে নিতাম। কিন্তু কিছুদিন আগে উনার একটা কথার কারণে এটা মানতে পারছি না।

বাবা বর্তমানে রিটায়ারমেন্টে আছেন। সারাদিন বাসায় শুয়ে বসেই কাটে। ৩৫ বছরের বেশি সরকারি চাকরিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা মানুষটার জন্য ঘরে সময় কাটানো কঠিনই বেশ। আর তাই মাঝে মাঝে আমার কাজিন বাসায় আসলে তার সাথে গল্প করে সময় কাটায়। এরকমই একদিন গল্প করতে করতে কাজিনকে বলছিলো- কোনদিন সমুদ্র দেখে নি৷

এই কথা যখন আমার কানে আসে, আমি উনাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আসলেই কি তা সত্য? অবাক করে বলেছিলো, হ্যাঁ৷ তারপর বলেছিলাম, আপনার চাকরি এতদিন ছিল সেখানে, তবুও কেন যান কি? জবাবে বলেছিলো “কীভাবে যাব? সে সময় তো পরিবারের অবস্থা এত ভাল ছিল না। পরিবার চালাতে হতো, সবাইকে দেখতে হতো। তাই আর যাওয়া হয় নি।”

এখন এই ঘটনাকে আপনি শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের ভাবনা বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। বলতে পারেন না যে মধ্যবিত্তের টানাটানি সংসারে টাকার কথা ভেবেই যান নি। মধ্যবিত্তের টানাটানি একটা কারণ বটে কিন্তু একমাত্র কারণ নয়৷ দেখুন বাবা ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। উনার আর পাঁচজন ভাই বোন আছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে অর্থের একটা হিসাব ওনার রাখতেই হতো। কিন্তু তাই বলে সমুদ্রের এত কাছে থেকেও সমুদ্র দেখার সুযোগ হবে না একদিনের জন্যও, এটা আমি মানতে রাজি না। আমার মতে এটা হয়েছে মধ্যবিত্তের পুরুষতান্ত্রিক চর্চার কারণেই।

মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে খুবই সূক্ষ্মভাবে ছেলেদের টাকা বানানোর মেশিন বানিয়ে দেয়া হয়। এখানে আপনি ছেলে হলে সারাক্ষণ মাথায় থাকবে আপনিই হচ্ছেন “দ্যা ম্যান” “সুপারহিরো”। আর বাকি সবাই হচ্ছে নিচু শ্রেণির শোষিত সমাজ, যাদেরকে একার হাতে টেনে তোলার দায়িত্ব শুধুমাত্র আপনার হাতে। প্রতিটা সুপারহিরোর যেমন নিজের শহর বাঁচাতে ব্যক্তিগত অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করতে হয়, মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেদের ঠিক তেমন করেই নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়। দিনশেষে তাদের পাওয়া বলতে ঐ যে আমাদের আবেগী সেই স্ট্যাটাসগুলো “আমার বাবার শার্টের পকেটটা ছেঁড়া অথচ আমি ব্র‍্যান্ডের শার্ট পরে ঘুরে বেড়াই৷ এটাই আমার বাবা।” আদৌ কি এটা গর্ব করার মতো কিছু? আজকাল আমার সন্দেহ হয়। কেন হয়?

মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আপনি দেখবেন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা চাইল্ড অ্যাবিউজ বেশি হয় (চাইল্ড অ্যাবিউজ আবার অন্য কিছু ভাববেন না, মারামারি বুঝিয়েছি)। এসব পরিবারে অর্থ উপার্জনকারী কর্তার সাথে দেখবেন বাড়ির কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। কর্তা এখানে সারাক্ষণ একা একাই কাটায়। আর যতখানি সময়ই এরা কথা বলে, সেটা চিৎকার চেচামেচি, রাগ দেখানো ছাড়া আর কিছুই না। আমরা আবার সেটাকে আবেগী নাম দেই- একটু রাগী, এই যা।

আমি আমার বাবাকে দেখেছি। আমি যেদিন বিদেশ চলে আসি, আজীবন রাগী আর শক্ত থাকা লোকটাকে আমি আড়ালে কাঁদতে দেখেছি। এই ঘটনার কয়েক বছর পর থেকেই আমি শুধু এটাই ভেবেছি যে মানুষটা তাঁর সন্তান তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে বলে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে পারে, সে মানুষটা আর যাই হোক সে অনুভূতিহীন শক্ত মনের বদরাগী হতে পারে না। এই শক্ত আবরণটার নিচে একটা নরম হৃদয় তাঁরও আছে৷ তাহলে এই নরম মানুষটা সারাক্ষন রাগারাগিই বা কীভাবে করে যেত? বা কোনোদিন ভাল করে কেন কথা বলবে না আমাদের সাথে?

এর উত্তরগুলোই আজ পেতে থাকি আস্তে আস্তে। এই রাগারাগি বা মারামারি পুরোটাই যে তার মনের অসুখের কারণে। আমাদের মত পরিবারের ছেলেগুলো যে কোনোদিন জীবন যাপন করতে পারে না, তারা শুধুমাত্র জীবন কাটিয়ে দেয়। আর যার ফলাফল এগুলো৷ ডিপ্রেশন শব্দটা তারা হয়তো স্বীকার করবে না কিন্তু প্রতিটা মানুষই ডিপ্রেশনেরই শিকার৷ তাদের কোন জীবনই নেই। টাকা কামাও, পরিবারের চাহিদা পূরণ কর, খাও, ঘুমাও। নিজের জন্য কিছুই করা যাবে না। যদিও ভুলে কিছু করে ফেলো, সেটা নিয়েও কথা উঠবে। আর এই রুটিন করা জীবনের হতাশা থেকেই তাদের এই খটমটে চরিত্রটার সৃষ্টি। অন্তত আমার মতে তো তাইই।

আজকাল আমার বাবা আমাকে কত দামী দামী জিনিস দিয়েছে বা কত টাকা আমাকে দিয়েছে-তার কিছুই আমার মাথায় আসে না৷ সবসময় শুধু মনে হয় আমার বাবা কোনোদিন আমার সাথে বন্ধুর মত আড্ডা দেয় নি, কখনো ডেকে নিয়ে দুটো ভাল কথা বলে নি। আমি আজীবন বাবা থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কারণ জানতাম, সামনাসামনি হলেই যে বকা শুনতে হবে। এই যে একটা হোস্টাইল পরিবেশ- এটাও ওনারই তৈরি করা। আর বলছিলাম না বাবা আমার কাজিনের সাথে আড্ডা দেয়? এটাও কিন্তু কাজিনের সাথে ক্লোজ, সে কারণে না। এটা হয়েছে কারণ আমাদের ভাই বোনের সাথে সম্পর্কের গ্যাপ হতে হতে এমন হয়েছে যে আমাদের সাথে গল্প করা এখন আর মানায় না। এখন যেমন উনি চাইলেও আমাদের সাথে গল্প করতে পারেন না, তেমনি আমাদের এত বছরের ভয়ের সম্পর্ক পাশ কাটিয়ে আমরাও মন খুলে কথা বলতে পারি না।

এগুলো সবই আপনার মধ্যবিত্ত পরিবারের কড়চা মনে হতে পারে। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো এর শুরুটা কীভাবে? এটা কি বছরের পর বছর ধরে ছেলেদের মধ্যে ইঞ্জেকশনের মতো ঢুকিয়ে দেয়া হয় না? যুগ যুগ ধরেই কি আমাদের সমাজ পরিবার এটাই শেখাচ্ছে না যে ছেলেরা আয় করে আনবে আর মেয়েরা থাকবে শুধুই রান্নাঘরে? এটাই কি শেখাচ্ছে না- মেয়েরা যখন ঘর সংসার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে নিজের উড়তে চাওয়া ডানাগুলো টেনে ছিড়ে ফেলতে থাকবে ঠিক সেই সময়ে ছেলেটাও নিজের হাতে কর্তৃত্ব তুলে নিতে, ঘর পরিবারের মানুষগুলোকে আরেকটু ভাল রাখতে, ভাল পরাতে নিজের ইচ্ছেগুলোও মেরে ফেলবে। এই সমাজ ব্যবস্থাই কি আমাদের প্রতিদিন শেখাচ্ছে না যে মায়েরা তো আদর করবেই সুতরাং বাবাদের একটু রাগী হতে হয় নাহলে বাচ্চা মানুষ হবে না, পরিবারের কেউ তাহলে তাকে মান্য করবে না? আর সমাজ সংসার যখন এই শিক্ষা দিতে থাকে, তখন আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবাটা রেগে গিয়ে আমাদের খাওয়ার খোঁটা দেয়, বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়। আমরাও সেটা মেনে নেই কারণ আমরা জানি এখানে যেই উপার্জন করে সেই রাজা, আর আমরা দাস মাত্র। রাজার হুকুম অমান্য করে যে রাজ্যে টেকা বড় কঠিন….!