অচেনা ও একা
ফায়জুন নাহার সিতু।।
পড়ন্ত দুপুরটা ভীষণ গোলমেলে, ঝিমাচ্ছে আকাশ, ঝিমাচ্ছে বেলা, ঝিমুয় মানুষের চোখ! হঠাৎ তন্দ্রায়, এমনি এক দুপুরে আসে জাদুর বাক্সওয়ালা। হেসে, ঠেসে ধরে চোখ! শরীর, মন কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া হয়ে যায় নিমেষেই। ওটা বায়োস্কোপ।
ওই তো, দেখো! বাক্সের ভেতর কিরকম পাল্টে যাচ্ছে একের পর এক দৃশ্য!
দৃশ্যপট ১
মন অবশ করা এক বিরহী সুর বাজে এক ভিড়ের মাঝে, দেখা যায় এক বৃদ্ধের হাতে ডজন খানেক মুরগী, এক পাশে কতগুলো গরু বাধা, কুকুর হেঁটে চলে যাচ্ছে যত্রতত্র, জুতা পায়ে ঐ বুঝি হাটুরে চললো, কামার, কুমোর, দোকানী সবে ব্যস্ত লেনদেনের হিসাব মেলাতে। কিশোরী এক বধূ জবুথবু বসে গনগনে কয়লার আগুনে জিলিপি ভাজছে মস্ত এক কড়াইয়ে।
কড়াইটা পুড়ছে, কত দিন আরো পোড়াবে কে জানে! এই আগুনে মানুষ পোড়ালে মানুষেরা ধ্বংস হতো। মানুষ বড় ভঙ্গুর, মানুষের শরীর গলে যায়, গলে যাওয়া মানুষের শরীর মন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কোন অতীতে কে জানে!
পাগল জাদুর বাক্স বোকার মতো সুর তোলে!
ভিড়। ভিড় মানে একের অধিকের জটলা।
এই ভিড়ের আলাদা কোন লিঙ্গ হয় না, কোনো জাত হয় না। ভিড়ে গরু, ছাগল, নর-নারী, লোহা, মাটি, কিশোরী বধূর কড়াই, সবজি, পায়ের জুতো সব একাকার
হয়ে যায়! সব মিলিয়ে, এরই নাম হয় ভিড়।
দৃশ্যপট ২
একটা প্রিয় সময় এসে সামনে দাঁড়ালো। একদল কবির আসর বসেছে কাছেই।
ছুটে গিয়ে প্রেমের কবিতা শোনার আবদার করলাম।
পুরুষেরা কবিতায় অনেকটাতেই জুড়ে দিলো নারী, নারীদেহ। হ্যাঁ, কিছুটা প্রেম আকুলতাও ছিলো বটে!
কেউ প্রেমিকার কাঁধে মাথা রাখতে চাইলেন, কেউ নারীকে প্রবঞ্চক বললেন, আবার চাইলেন শরীরে আশ্রয়, অনেকে লোভীর মতো নারী শরীরের দিকে তাকালেন, ক্ষুধার্ত কবির কবিতায় নারীর শরীর ভোগের কত উপমা! কখনো আসলো প্রেম না পাওয়ার হতাশা।
সবাই শুধু চাইলেন, দেয়ার কথা বলেননি কেউ।
হা হা হা! জাদুর বাক্সে ভ্রুকুটি!
নারীরা শুনালেন আক্ষেপ গাঁথা, হতাশা, আশংকা। কেউ শুনালেন না পাওয়ার বেদনা।কবিতার কিছুটা অংশ জুড়ে শরীর ছিলো,কিছু উপমা ছিলো,আর ছিলো নারীজীবনের অসহায় বেদনা।
আবারো,বায়োস্কোপে ভ্রুকুটি!
আশ্চর্য!
সবাই শুধু পেতে চাইলেন,কেউ মানুষটাকে পেতে চেয়ে বললেন দাও, হাত পেতে নিতে চাইলেন শরীর, মন অথবা গোটা অস্তিত্বটুকুকেই অধিকার করতে চাইলেন। হতাশ কবিরা প্রেম খুঁজে চলছেন, যেমন অন্ধ কেউ হাতরে হাতরে আকুল হয়ে খুঁজে চলে পথ!
তাদের না পাওয়ার হাহাকারে স্তব্ধতা ছিল, প্রেমের অসম্পূর্ণতা ছিল, ভালোবাসি ভালোবাসি চিৎকার ছিল, ভালবাসায় ঝলঝলে সাতরঙা রঙধনু ছিল, কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার হওয়া শান্তরাত্রির যে গভীর কালো রঙ হয়, তার লেশমাত্র ছিল না।
অথচ এই গভীরতার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কারো বলার প্রয়োজন ছিল, তুমি আমি মিলে অবিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে যাই চলো, হাত ধরে অভয় দিয়ে, ভালোবেসে সামনের পথটুকু চলার সাহস জোগানোর প্রয়োজন ছিল কারো। কেউ বলেনি, চলো দুজনের অস্তিত্ব এক হয়ে যাক!
কারো বলার প্রয়োজন ছিল ঠুনকো সব উপমার প্রেমকে ছাড়িয়ে প্রেম যে স্রোতে চলে চলতে দিই চলো! প্রেম তো খাদ্য নয়, প্রেমের উপমা হোক জীবনের স্বার্থকতার চাবি। মন শরীর এক করে অস্তিত্বে প্রবেশ করো। অনুভব করো জীবনবোধের চর্চায় স্বাস্থ্যকর প্রেম।
বায়স্কোপে সুর কেটে যায়।
দৃশ্যপট ৩
২৩ বছরের বিষন্ন তরুণী একাকী গল্প গাঁথে। রাতের শেষ ভাগ। দূর থেকে ও কীসের শব্দ ভেসে আসে? বাস, ট্রাক অথবা অন্য কোনো যানের দূর হতে ভেসে আসা গম্ভীর শব্দ শুনে ঠাওর করা যাচ্ছে না কিছুই। কে জানে এ রাত পৃথিবীর কত স্থানে, কত মুহূর্তের ঘটে যাওয়া ঘটনার সাক্ষী। অজানার অসীম সমুদ্র পারি দিতে দিতে জানার ভান করা মানুষের স্বভাব। অধিকাংশ মানুষ নিঃসঙ্গ, একাকীত্ব ঘুচানোর মন্ত্র এখনো অজানা। জীবনের আরো গভীরে যেতে হবে, যেখানে মানুষে মানুষে একাত্মতা হবে অন্যতম চাওয়া।
জাদুর বাক্সে চাপা কান্না। কিশোরী বারবার আবৃত্তি করে,আবুল হাসানের কবিতার দুটি লাইন-
“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!’’