সমাজরীতির নামে পুরুষতন্ত্র- এর শেষ কোথায়?
শাকিল মাহমুদ।। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বাবার নানা কারণেই ঝগড়া হতো। সে ঝগড়ার পথ ধরে কয়েকবার মামারা এসে মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বাবার সংসার থেকে, মা যেতে চান নি! কারণ তিনি চলে গেলে তার ছেলে অসহায় হয়ে যাবে৷
বাবা হয়তো নতুন বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে নিয়ে আসবে, সে নতুন বউ আমাকে খেতে দেবে না, ঘরে থাকতে দেবে না। ফলে আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে রাস্তায়, ভাগ বসাতে হবে কুকুরের সঙ্গে কোনো ডাস্টবিনে খাবারের খোঁজে। এসব ভয় নিয়ে আমার মা তিক্ত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এছাড়াও বিয়ের পর তিনি সংসার, স্বামী-সন্তান ছেড়ে চলে গেলে তার বাবার সমাজে মুখ দেখানোর মত অবস্থা থাকবে না- এসব ভেবেও সংসার ছেড়ে চলে যান নি।
সমাজে আমার মায়ের মত অসংখ্য নারী আছেন যারা সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে একটি বিষাক্ত সম্পর্ক বয়ে নিয়ে পার করে দেন গোটা জীবন। নিপীড়ন, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যান ‘সমাজ কি বলবে!’ এই ভেবে।
প্রথমত, সন্তানের কথা ভাবা পরিবারের কাজ নয়; রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্রকে জনগণ ট্যাক্স দেয় শুধু রাস্তাঘাট আর সেতু-ফ্লাইওভার করার জন্য নয়। জনগণের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেয়ার জন্য, পাঁচটি মৌলিক অধিকার পূরণ করার জন্য। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে সে সবের বালাই নেই। ফলে আমাদের দেশের নারীরা একটি অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখে সন্তানের কী হবে ভেবে। অথচ উন্নত অনেক রাষ্ট্রে সন্তানের যাবতীয় দায়িত্ব যখন রাষ্ট্র নিয়ে নিলো তখন সে দেশগুলোতে বাজে দাম্পত্যের সম্পর্ক ভেঙে যেতে শুরু করলো। এবং গবেষণায় দেখা গেল এর কারণে সন্তানের উপর মানসিক কোনো স্থায়ী প্রভাবই পড়ছে না!
আমাদের দেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি রাষ্ট্রে, যেখানে ধর্মতান্ত্রিকতা এবং পুরুষতন্ত্রের আদিম ধ্যান ধারনা এখনো জিইয়ে রাখা হয়েছে সে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে টু শব্দটি করাও যেনো পাপ! দলাইমলাই করে একজন নিপীড়ক স্বামীর সঙ্গে সমস্ত কিছু সহ্য করে থেকে যেতেই হবে- এই দিব্যি করেই যেনো নারী জন্মেছে!
আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের অভাবের কারণেই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়ে সন্তানের উপর৷ আধুনিক বিশ্বায়নের এ যুগে এসে পশ্চাৎপদ ভাবনা নিয়ে সম্পর্কের তিক্ততার মাঝে ‘মুচকি হেসে’ সম্পর্ক ধরে রাখাটা সামাজিকতা আর এ সামাজিকতা স্রেফ ভণ্ডামি বৈ আর কিছু নয়।
এ ভণ্ডামিমার্কা সামাজিকতার বিষয়ে আমার এক শ্রদ্ধেয় বড়ভাই মহাশয় মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘মানুষ এসব কিছুতে বিশেষ করে সামাজিকতায় নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে। যার ফলে ধর্ম, সামাজিক সম্পর্ক (বিয়ে, পারিবারিক বন্ধন) এসব নিয়ে বিরোধী কথায় অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে। ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়। যেহেতু এসব নিয়ে তারা আছে সেহেতু এসবের বিরুদ্ধে বলে তাদের খোঁচা দেয়ার কারণ হয় না।’ এসব বলার পরেও তিনি আরো বেশ কিছু যুক্তি দিয়ে বলতেন, ‘চাইলেই তো কয়েক হাজার বছরের রীতিনীতি পাল্টে ফেলা যাবে না!’
সত্যিই যাবে না যতকাল আমার ওই শ্রদ্ধেয় বড়ভাইয়ের মত মানুষ সমাজে বিরাজমান থাকবে। যারা আদিম ধ্যান ধারনাকে সমাজরীতি বলে বলে এরকম একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যেখানে এসব পশ্চাদপদ ভাবনা আধুনিক সভ্য মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর হলেও সামাজিকতার দোহাই দিয়ে তার মধ্যে থাকতে হবে!
২.
আমাদের গ্রামের চাচী-ভাবিরা কথা থেকে কথা হলেই বলেন, ছেলেকে বিয়ে করালেই তো বউয়ের কথা মত চলবে। ঢাকা চলে যাবে। নিজেদের মত করে ঘর-দরজা করে থাকবে। মা-বাবার খোঁজ খবর নেবে না আর! একই সঙ্গে শুনি, ছেলে তো আর খোঁজ নেয় না। তাদের নতুন সংসার, বউ নিয়ে আছে।
এই যে একটি ভয় এবং আফসোস ছেলের মা করছেন, তিনি কি একবারও ভেবেছেন তার ছেলের বউ করে একটি মেয়ে নিয়ে আসার সময় মেয়ের পরিবারের কী অবস্থা হলো? বিয়ের পর ছেলে তার বাবা-মাকে ছেড়ে চলে গেলে সমাজের এমন কেউ নেই যে বলবে না- এত কষ্ট করে পেলেপিন্দে বড় করলো, পড়াশুনা করালো। এখন বিয়ে করে বউ সব! কিন্তু কেউ একটি বারের জন্য একই কথাকে ঘুরিয়ে বলবে না, এত কষ্ট করে পেলেপিন্দে বড় করলো, পড়াশুনা করালো – পারলো বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে চলে যেতে?
আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা তা কখনো বলে না। তবুও এ সমাজের বাসিন্দারাই বলে ‘যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে!’ আদতে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই। একজন ছেলে যখন একজন মেয়েকে বিয়ে করে তার পরিবার থেকে নিয়ে আসে তখন সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তো নিয়ে আসে! তাহলে সে ভাঙনটা কোন সমাজের চোখে পড়ে না? কেন বিয়ের পর স্বামীর বাবা-মায়ের সংসারে না থেকে নিজের সংসার নিয়ে ভাবলেই ‘পরিবার ভেঙে যাচ্ছে’ বলে কপালে থাপ্পর দিয়ে ‘হায় হায়’ করা হবে?
পুরুষগুলোর পরিবার একমাত্র পরিবার, মেয়েদের পরিবার কিছু না?
৩.
বাংলাদেশের সামাজিকতা নারী নিপীড়নের মূল চালিকা শক্তি। ফলে নানা রকমভাবে নারীকে দাবিয়ে রাখার পথ সমাজ তৈরি করে। যে নারী নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে আসে সে কেনো অন্যের মা-বাবার সেবা করবে! এই সহজ বিষয়টি সমাজের বাসিন্দাদের মগজে ঢোকানো যাচ্ছে না৷ মেয়েটি বিয়ে করেছে নিজের সুখের জন্য। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা অন্যের সুখের জন্য হাঁড়ি-পাতিল মেজে, ঘর গুছিয়ে রাখা তো তার কর্ম নয়। ফলে স্বামীর মা-বাবার ঘর ছেড়ে সে একা ঘরে নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে চাইবেই – এটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিকতা মেনে নেয়ার শিক্ষা আমাদের নেই, সমাজ দেয় নি, দিচ্ছে না। উপরন্তু সমাজ শেখাচ্ছে, ছেলের মা-বাবার সেবা না করা মেয়েটি অসভ্য৷ একই কথা তো ছেলের, ছেলের বাবা-মা চৌদ্দগুষ্ঠির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অসভ্য, ইতরের মত তারা একটি মেয়েকে নিয়ে এলো তার মা-বাবার থেকে! ফলে সামাজিকতার ধ্বজা ধরে নারীকে অবদমিত করে রাখা এই আধুনিককালে আদিম, পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারনা বৈ আর কিছু নয়৷ পরিবার ভাঙবে, বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। এসব কারণে ঘটনাগুলোকে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি বলে কোনো লাভ নেই।
এগিয়ে চলাকে মেনে নিতে হবে। বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবার ও শিশু কল্যানে কর্মসূচি গ্রহণ করছে সেখানে আমাদের দেশ সড়ক আর সেতু-ফ্লাইওভার করে চলেছে। আর ধর্মতান্ত্রিকতা এবং সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নারীকে করে যাচ্ছে সমস্ত দোষের দোষী। অর্থাৎ যত দোষ নন্দঘোষ!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]