ধর্ষণ: মিথ বনাম ফ্যাক্ট
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ডেস্ক।। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের খবর যেমন প্রচুর দেখা যায়, তেমনি এই ভয়াবহ অপরাধের পক্ষে কিছু মিথও চোখে পড়ে। সামাজিক মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে প্রচলিত এসব মিথ সঙ্গত কারণেই বাস্তবতা বিবর্জিত, অত্যন্ত ভয়ংকর, মারাত্মক ক্ষতিকর এবং সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে—দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এসব মিথ খুবই মুখরোচক ও বহুল প্রচারিত। রেপ ক্রাইসিস ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস নামক এক নারীবাদী সংগঠনের ওয়েবসাইটে নিম্নে বর্ণিত এসব মিথ এবং এর বিপরীতে বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সুদূর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ধর্ষণ বিষয়ে যেসব মিথ প্রচলিত—আমাদের দেশে বা বিশ্বের এই অঞ্চলেও একই ধরনের মিথ প্রচলিত আছে। কে জানে, হয়তো সারা বিশ্বেই ধর্ষণ বিষয়ে এরকম ভয়ংকর সব মিথ সমানভাবে বিস্তার করে সর্বনাশ করে যাচ্ছে। যাইহোক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য ধর্ষণ নিয়ে মিথ বনাম ফ্যাক্ট শিরোনামে তা অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো। কারণ আমরা মনেকরি, ক্ষতিকর এসব মিথের ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও তার জবাব ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
মিথ: যদি কেউ মাতাল হয়ে পড়ে, এবং এ অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয়, তবে এটা তারই দোষ। কারণ তার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত ছিল।
ফ্যাক্ট: নির্যাতনের শিকার না হয়েই যে কারো অ্যালকোহল গ্রহণ করার অধিকার আছে। কেউ মাতাল হয়ে পড়লে বা জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে সে অবস্থায় তার সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করাই হলো ধর্ষণ। কারণ মাতাল বা জ্ঞানশূন্য অবস্থায় সম্মতি দেওয়া বা না দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। আর ধর্ষণে সবসময় ধর্ষকই দায়ী।
মিথ: নারীরা সবসময় ধর্ষণ নিয়ে মিথ্যাচার করে, কারণ তারা কারো সঙ্গে সেক্স করে অপরাধবোধে ভোগে বা তারা আসলে আলোচিত হতে চায়।
ফ্যাক্ট: মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদগুলো দেখলে কারু মনে হতে পারে নারীরা হয়তো ধর্ষণের ব্যাপারে মিথ্যাচার করছে। বস্তুত, ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ খুবই বিরল। বাস্তবতা হচ্ছে—বেশিরভাগ নারীই যারা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তারা পুলিশে অভিযোগই করতে পারেন না বা কাউকে বলেন না।
মিথ: কেউ যদি চিৎকার না করে বা আক্রমণকারীকে আঘাত না করে বা তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করে তবে এটা ধর্ষণ নয়।
ফ্যাক্ট: ধর্ষণের শিকার হলে চিৎকার না করা বা ধর্ষককে আঘাত বা ধস্তাধস্তি না করার বহু কারণ আছে। বস্তুত, অনেকেই নড়াচড়া করতে পারে না বা এমনকি মুখ দিয়ে কোনো শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না, আক্রমণের শিকার হলে এটা খুবই সাধারণ এক প্রতিক্রিয়া। কোনো কোনো ধর্ষক চিৎকার বা ধস্তাধস্তি করলে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে থাকে। কারো অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করাই হচ্ছে ধর্ষণ, এ ক্ষেত্রে সে লড়াই বা চিৎকার করুক বা না করুক, তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
মিথ: কারো সঙ্গে যদি আপনার প্রেমের সম্পর্ক থাকে তবে যে কোনো সময়ই সেক্স করা যাবে।
ফ্যাক্ট: যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গী বা যে কাউকে যে কোনো সময় না বলার অধিকার সবার আছে। যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে সব সময় অবশ্যই সঙ্গীর সম্মতি লাগবে। যে কোনো সম্পর্কে থাকা অবস্থায়ও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন অপরাধ।
মিথ: যারা ছোটবেলায় যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে থাকে, তারা বড় হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতক হয়।
ফ্যাক্ট: এটি একটি ভয়ঙ্কর মিথ। ধর্ষকদের পক্ষে অজুহাত বা সহানুভূতি আদায়ে এই মিথটি ব্যবহার হয়ে থাকে। বাস্তবতা হলো, ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন লোকদের বেশিরভাগই বড় হয়ে যৌন নির্যাতক বা ধর্ষক হয় না। শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক—কারো প্রতি যৌন নির্যাতনের জন্য কোনো যুক্তি, অজুহাত কখনই দাঁড় করানো যাবে না।
মিথ: রাতে একা নারীদের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়, কারণ এতে তারা ধর্ষণের শিকার হতে পারে।
ফ্যাক্ট: ধর্ষণের শিকার প্রতি ১০ জনের একজন অপরিচিত কারো দ্বারা ধর্ষণ হয়ে থাকে। বাকি ৯ জনই পূর্বপরিচিত কারো দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়—যেমন বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পার্টনার বা পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা। মানুষরা তাদের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের কর্মক্ষেত্রে বা অন্য জায়গায় যেখানে তারা নিরাপদে ছিল, এমন সব জায়গায় তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অপরিচিতদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি দেখিয়ে নারীদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বা তাদের জীবনে অযাচিত বিধি-নিষেধ আরোপ করা যাবে না।
মিথ: শরীর দেখা যায় এমন পোশাক পরে মূলত নারীরাই পুরুষদের প্ররোচিত করে।
ফ্যাক্ট: একজন নারী কী পরেছে বা তার আচরণ কী—তার দ্বারা এটা বোঝায় না যে, সে সম্মত কি না। যদি যৌনক্রিয়ায় সম্মতি না থাকে, তবে এটা ধর্ষণ। আর ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষকই একমাত্র দায়ী।
মিথ: কোনো পুরুষ একবার যৌন উত্তেজনায় তাড়িত হলে সে যৌন সঙ্গম না করে পারে না।
ফ্যাক্ট: নারীরা যেমন পারে, পুরুষরাও যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যৌন সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ধর্ষণ করার প্রয়োজন নেই। ধর্ষণ হলো মূলত কাউকে নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত একটি কর্মকাণ্ড। এটিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা বা এর পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করানো যাবে না।
মিথ: কিছু নির্দিষ্ট জাতি ও ব্যাকগ্রাউন্ডের পুরুষরাই যৌন নির্যাতক হয়ে থাকে।
ফ্যাক্ট: কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোত্রভেদে ধর্ষক হয় না। ধর্ষক হতে পারে যে কোনো পেশার, যে কোনো জাতির, যে কোনো বর্ণ, ধর্ম, বয়স, সামাজিক শ্রেণি বা অর্থনৈতিক অবস্থানের।
মিথ: পুরুষরা ধর্ষণের শিকার হয় না।
ফ্যাক্ট: পুরুষরাও ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তবে যৌক্তিক কারণেই ধর্ষণ সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের উপর বেশি মনোযোগ যায়। আমরা অবশ্যই স্বীকার করি, পুরুষরাও ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে এবং তাদের জীবনে এর প্রভাব নারীদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আমরা বিশ্বাস করি, যৌন নির্যাতনের শিকার প্রত্যেককে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
মিথ: নারীরা যৌন নির্যাতন করে না।
ফ্যাক্ট: নারী ও শিশুদের উপর বেশিরভাগ যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ পুরুষরাই করে থাকে। তবে কিছু নারীও অন্য নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন করে থাকে।