September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারী বলে যে বাধা আসবে তা উপড়ে ফেলাই আমার নারীবাদ

সুমাইয়া অনন্যা।। ২০১৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখ। স্কুলের এক বন্ধু ফোন দিয়ে বললো, তোর সাথে জরুরি কথা আছে। আজকেই দেখা কর!

সে জানালো, তুই যদি “ক” এর প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হস তাহলে তোর কি ভিডিও নাকি আছে সেটা ভাইরাল করে দিবে; এই দেখ স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে!

মুহুর্তেই আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো, অন্ধকার হয়ে গেলো সব।

আমি তো কিছুই করিনি!

কোনো ছেলে বন্ধুর সাথেই ভয়ে কথা বলিনি কখনো কারণ আমি তখন জানি ছেলে বন্ধু হওয়া ভালো না! আমি তো মাটির দিক তাকিয়ে রাস্তায় চলা মেয়ে ছিলাম যে কোনো টিজিং শুনলেও চুপচাপ চলে আসতো সেখান থেকে।

আমি তো সেই মেয়ে ছিলাম যে পথে কারো দ্বারা হ্যারেজমেন্টের শিকার হলে আগে বাড়িতে গিয়ে বলে দিতাম, মা’কে বলতাম।

আমি তো সেই মেয়ে ছিলাম যে দিনরাত পড়াশোনা আর ফলাফল ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝতাম না। আমি তো সমাজের ইচ্ছা, চাওয়া পাওয়ার মতই ভালো মেয়েটা ছিলাম তবে আমি কেন? আমার সাথে এসব কেন?

এই প্রশ্নগুলো আমি তখন করেছিলাম কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।

যা পেয়েছি, যা দেখেছি তা হলো কয়েকদিনের মাথায় সকল সত্য মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, সকল বিশ্বাস ভেঙে যেতে পারে; পরিবারের, সমাজের সক্কলের সক্কলের!

আমি সেদিন মরে যেতে চেয়েছিলাম।

কতটুকু বয়স তখন? ১৫বছর।

মা বলেছিলো, “তোমাকে বাঁচতে হবে, অনেক যুদ্ধ করতে হবে, অনেক উত্তর দিতে হবে, তোমাকে টিকে থাকতে হবে। আমার জন্য বাঁচো, নিজের জন্য বাঁচো!”

সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম, বেঁচে উঠতে চেয়েছিলাম।

সেদিন থেকে নম্র ভদ্র বাধ্য মেয়ে থেকে আমি মুখরা হয়েছিলাম আসলে।

কত কি প্রশ্ন মাথায় এসেছে, উত্তর খুঁজেছি আমি। আমার উত্তরগুলো দিতে পারে এমন মানুষ বা জায়গা খুঁজেছি হন্যে হয়ে। এরপর রোকেয়া পড়েছি, তসলিমা পড়েছি, মালেকা বেগম পড়েছি। এরপরও আরো কত কত প্রশ্ন মাথায় জেঁকে বসেছে আর ততদিনে আমি আমাকে চিনে ফেলেছি।আমার কাজ কী, কী করবো আমি, কীভাবে করবো, কী ইচ্ছা ইত্যাদি ইত্যাদি নিজের জন্য কীভাবে বাঁচবো সব জানা।

মেরি ওলস্টোনক্রাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল পড়ে উদারনৈতিক নারীবাদ জানলাম; মিটেল ফায়ারস্টোন, কেট মিলেট পড়ে জানলাম আমূল নারীবাদ। রেবেকা ওয়াকার কিংবা বন্দরা শিবা কেউ  বাদ যায়নি এই জানার জায়গা থেকে। তবুও আমার জানা হয়নি, কত কি জানা বাকি!

যট্টুক জেনেছি তার সারাংশ হতে পারে এমন, নারীবাদ এমন একটি বাদ বা মতবাদ যা সমাজবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট, যেখানে নারী অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে, পুরুষের সমান অধিকার, মানুষের অধিকার।

এই নারীবাদ নারীদের আন্দোলন নয়, নারীদের জন্য আন্দোলন। নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

একজন মানুষ হিসেবে নারীর তার পরিপূর্ণ অধিকারের দাবি হল নারীবাদ।

জৈবিক পার্থক্যের বাইরে গিয়ে জেন্ডারগত পার্থক্য সৃষ্টি করা; সৃষ্টি করা নারীসুলভ পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য।

এই নারীত্ব, পৌরুষত্ব সৃষ্টি করে তারপর কত কি চাপায়ে দেয়া যেমন, নারীই সন্তান পালন করবে, ঘর সামলাবে,  গৃহপালিতও হয়ে যাবে এইগুলা নিয়েই মূলত কথা বলে নারীবাদ।

বিশ্বজুড়ে যে বিদ্যমান এই লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাগ পুরুষের উপর রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এসব সামাজিক পরিমণ্ডলের দায়িত্ব অর্পন করে এবং নারীকে গোটা সংসারের বোঝা বহনকারী বিনা মজুরির বাদিগিরির দিকে ঠেলে দেয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ। নারীবাদ বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামো, আইন-কানুন, রীতি-নীতি যা নারীকে বশ্য, অধীনস্ত ও হীন করে রাখে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নারীবাদ হলো একটি সামাজিক আন্দোলন যা নারীর গৎবাধা ভূমিকা ও ইমেজের পরিবর্তন, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিলোপ এবং পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার অর্জনের প্রয়াসী।

নারীর স্বাধীনতা অর্থবহ করার লক্ষ্যে যে আন্দোলন, যুক্তি ও তত্ত্ব বিভিন্ন চিন্তবিদগণ প্রদান করেছেন তাকে সাধারণভাবে নারীবাদ আখ্যা দেয়া যায়।

মূলত এইগুলাই আমরা পড়েছি, জেনেছি বহু আগে কারণ সব বই এই কথাই বলে, নারীবাদ সংক্রান্ত বইয়ের মূল বিষয়বস্তুই এগুলা।

কিন্তু প্রসঙ্গ ছিলো, আমার চোখে নারীবাদ কী?

আমার চোখে নারীবাদ হচ্ছে নারী পরিচয়ের আগে মানুষের পরিচয়ে যথাযথ সম্মান নিয়ে নিজের মত বাঁচা, নিজের জন্য বাঁচা যা অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। এই নিজের মত বাঁচার জীবনে শুধুমাত্র আমি নারী বলে যেসব বাধা আসবে তা উপ্রে ফেলা কিংবা তা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা, যুদ্ধ করা।

নিজের জন্য যুদ্ধ করতে করতে হাসতে হাসতে বাঁচা।

যুদ্ধে ক্লান্ত না হয়ে হাসতে হাসতে চোখেমুখে স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার এই জার্নিতে মত্ত হওয়া।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]