স্ত্রী’র ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের সাহস স্বামীরা কোথায় পায়?
মেহেরুন নূর রহমান।। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে ৬৩% পুরুষ মনে করে স্ত্রী যদি তাদের সাথে সেক্স বা শারীরিকমিলনে রাজি না হয় তবে তাদের নির্যাতন করা যায়। ৬৩% একটি বড় সংখ্যা, তবে আমি অবাক হইনি। একটি বড় সংখ্যক পুরুষের কাছে শারীরিকভাবে স্ত্রীকে আঘাত করা স্বাভাবিক একটি বিষয়। অনেক পুরুষই এটা শুনে চিৎকার করে উঠতে পারেন এই বলে যে- ‘‘আমি তো মারি না!’’ হয়তো মারেন না কিন্তু এই বিষয়টি ঠিক অস্বাভাবিক নয় আপনার কাছে। রাগ হলে, বিরক্ত হলে বা স্ত্রীকে শাসন করতে গিয়ে দু’চারটা চড় থাপ্পড় স্বামীরা মারতেই পারে এরকম মনোভাব শিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেশিভাগ পুরুষের মধ্যেই থাকে। আর সেখানে শারীরিকভাবে মিলিত হবার জন্য রাজি না হওয়ার মতো ‘গর্হিত অপরাধে’র জন্য তাকে মারা যাবে এটা তো খুবই স্বাভাবিক। স্বামীর ডাকে সাড়া দিতে না চাওয়ার মত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের জন্য সে বরং মার খাওয়ারই পাত্র।
একবারও কি এসব গর্ধবের দল ভেবে দেখেছে শারীরিক মিলনের মত আনন্দদায়ক একটি ব্যাপারে স্ত্রীরা কেন রাজি হয় না? কেন তারা অনীহা প্রকাশ করে? কারণ খুব স্বাভাবিক। শারীরিক সমস্যা ছাড়া অনিচ্ছুক স্ত্রীদের একটি বড় সংখ্যার কাছে এটা আনন্দদায়ক নয় বরং অত্যাচার। বেশিরভাগ পুরুষই মনে করে যৌনমিলনে স্ত্রীর আবার শারীরিক আনন্দ কি? স্ত্রীরা তাদের সেবাদাসী এবং চাহিবামাত্র তারা তাদের সঙ্গে শোবার জন্য বাধ্য থাকিবে। আর না চাইলে মারধোর করে তদের বাধ্য করার অধিকার তাদের আছে।
আমাদের দেশের নারীপুরুষদের বড় অংশই মনে করে পুরুষের জন্মই হয়েছে খাওয়া-পরানোর নামে নারীদের উপর প্রভুত্ব করার জন্য আর নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের সেবা এবং বিনা বাধায় তাদের প্রভুত্ব মেনে নেবার জন্য। প্রতিবাদ করতে চাইলে মার খেতে হবে- এটাই কি স্বাভাবিক নয়? হাজার বছরের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাদের এই কথাই শিখিয়েছে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম তাদের শিখিয়েছে তারা উত্তম আর নারী অধম। তাদের শিখিয়েছে- স্ত্রী যে কোন অবস্থাতেই থাকুক না স্বামী চাইলে তার সাথে শুতে বাধ্য, না হলে তাদের গুনাহ/পাপ হবে। তাইতো মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত বলা ছেলেরাও সহজেই স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ড এর গায়ে হাত তুলতে পারে, প্রয়োজনে জোর করে সেক্স করতে পারে। দেবীকে পূজো করে কিন্তু ঘরে এসে লাঠি দিয়ে মেরে স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না।
কত সহজে ছোটবেলা থেকে আমরা আমাদের ছেলেদেরকে মেয়েদের উপর প্রভুত্ব করতে শেখাই। আমার পরিচিত শিক্ষিত এক মেয়েকে তার অতি ব্রিলিয়ান্ট ভাইয়ের সম্পর্কে বলতে শুনেছি শাসনের নামে তার বোনদের কী রকম অত্যাচার করতো, মারধোর করতো; তাদের চলাফেরা, বন্ধুবান্ধব নিয়ন্ত্রণ করতো। মেয়েটির পিতা জীবিত ছিলেন না, কিন্তু মা বেঁচে ছিলেন এবং তিনি ছেলের বিরুদ্ধে এসব ব্যাপারে খুব একটা প্রতিবাদ করতেন না। আসলে এটা তার কাছেও স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিলো। ভাই-ই তো বোনদের শাসন করবে, প্রয়োজনে মারবে, কাটবে। আজকে বোনদের, আর পরবর্তীতে স্ত্রীকে একইভাবে যখন তারা শাসন করে তখন মায়েরা ভাবে স্ত্রীদের এভাবেই হাতের মুঠোয় রাখতে হয় কারণ হয়তো এভাবে তাকেও তার স্বামী নিয়ন্ত্রণ করতো। মনে রাখা জরুরি, স্ত্রীর সাথে জোর করে যৌনসম্পর্ক স্থাপন তাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রক্রিয়া এবং তাকে মনে করিয়ে দেয়া তুমি কত ক্ষুদ্র এবং অসহায়। যুগ যুগ ধরে এভাবে মেয়েদের ডমিনেট করার, নিজের সম্পত্তি ভাবার, দমন করার প্রক্রিয়া চলে আসছে।
শিক্ষিত তথাকথিত এনলাইটেন্ড, নারীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলা পুরুষদের মগজেও দেখেছি নারী বিষয়ে ঘন অন্ধকার। তারাও খুব গোপনে মনে করে তারা শ্রেষ্ঠ এবং নারীরা ঊন, তা সে যত শিক্ষিত বা একমপ্লিশড হোক না কেন। তারা সেবা পাবার যোগ্য এবং নারীদের দায়িত্ব তাদের সেবা করা ইনক্লুডিং সেক্স। এবং শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে মেয়ের তৃপ্তি ধর্তব্যের বিষয় নয়।
কথা হলো আপনি আপনার স্ত্রীর আচরণে বা কথায় বিরক্ত হতে পারেন, তার কোন কাজ অন্যায় হতে পারে, আপনার মনমত নাও হতে পারে, আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন কিন্তু তাই বলে আপনার স্ত্রীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা দুঃসাহস আপনাকে কে দিলো? আপনাকে কে অধিকার দিলো অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীকে জোর করে মেরেধরে যৌনমিলনে বাধ্য করার? আপনার অনেক আচরণও আপনার স্ত্রীকে বিরক্ত করতে পারে, আমি শিওর আপনার অনেক কার্যক্রমে সে হয়রান পেরেশান হয়। তখন সে কী করে? রাগ করে, ঝগড়া করে কিন্তু ৯৯% ক্ষেত্রে আপনাকে সে শারীরিকভাবে আঘাত করার কথা ভাবে না। এমন হতে পারে আপনার স্ত্রী শারীরিক মিলনে ইচ্ছুক কিন্তু আপনার ইচ্ছা হচ্ছে না, তাই বলে সে কি আপনাকে মেরেধরে বাধ্য করে? এমনটি সে ভাবতেই পারে না তবে আপনি কেন ভাবেন? আর কত নিজেকে এভাবে শ্রেষ্ঠ ভাবা! ভালো করে জেনে দেখুন আপনাকে আপনার স্ত্রী হয়তো অধমের অধম ভাবে।
আমার প্রিয় এক ছোট বোন সে তার ১২ বছরের বিবাহিত জীবনে ভয়ঙ্কর রকমের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে স্বামী দ্বারা। এছাড়া মৌখিক হিমিউলেশন, ইনফিডালিটি এসবও ছিল। মেয়েটি অবশ্য একসময় সেই নরক থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে । দীর্ঘাঙ্গী সেই মেয়ের স্বামীর ছবি দেখেছিলাম, তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা রোগা পাতলা একটা লোক। একবার তার অত্যাচারের গল্প শুনে শিউরে উঠে বলেছিলাম তুমি কেন দাওনি এক লাত্থি? দুজন মারামারি করলে তো তুমি জিততে। মেয়েটি বলেছিলো, এটা সত্যি আপা, কিন্তু স্বামীকে কি মারা যায়? সেটাই, স্বামীরা স্ত্রীদের নানা বাহানায় মারবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু স্ত্রীদের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ। ভাববেন না আমি এখানে স্ত্রীদের স্বামীদের মারার জন্য উৎসাহিত করছি। শারীরিক ভাবে আঘাত করা, সে স্বামী বা স্ত্রী যেই করুক না কেন গর্হিত অপরাধ এবং অন্যায়। আমি এখানে আমাদের সমাজের দ্বিচারিতার কথা উল্লেখ করলাম মাত্র।
শারীরিকভাবে আঘাত করা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর আপনার সাথে আপনার স্বামী যদি জোর করে শারীরিক সম্পর্কে স্থাপন করে তবে সেটা যৌন নির্যাতন। এটি আপনাকে দমন করার, আপনার উপর আধিপত্য বজায় রাখার পন্থা। আপনি এসবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। আপনার শরীর, আপনি না চাইলে কারো স্পর্শ করার অধিকার নাই, সে যেই হোক না কেন। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের অধিকার জানুন। আর কত অত্যাচারিত হয়ে, হিউমিলিয়েটেড হরে বেঁচে থাকা? সাহসী হোন, প্রতিবাদ করতে শিখুন। জীবন চলমান, কেউ কারো জন্য অবশ্যম্ভাবী নয়। সংসারের প্রয়োজনে কম্প্রোমাইজ করুন, কিন্তু মনে রাখবেন, নিজেকে ছোট থেকে ছোট করে বেঁচে থাকা জীবন নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]