November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীবাদ একটি স্বপ্ন, যে আমাকে লড়াই করার সাহস যোগায়

প্রিয়া দেব।। মেয়ে কিংবা ছেলে বলুন, আমাদের জীবন কেটে যায় না দেখতে দেখতে। পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণির চোখ ফোটার পর সে অভিযোজন করতে শেখে, লড়াই শেখে, নিজের মতো এগোতে শেখে। শুধু এই মানুষ নামক প্রাণিদের মধ্যেই বেশিরভাগের দেখার মতো চোখ কখনো ফোটে না। বিশেষ করে এ বঙ্গে তো সেই চোখ দুর্লভ বস্তু।

আমরা চোখ ফুটে নিজের মা’কে রান্নাঘরের মধ্যে আবদ্ধ দেখি, বছর বছর সন্তান জন্ম দিতে দেখি, আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে অনুষ্ঠান না হলে মা নামক বস্তুটিকে কখনো হাওয়া খেতে বের হতে দেখি না। আমাদের মায়েরা কোনো সন্ধ্যায় একা একা বের হয়ে নিজের জন্য প্রিয় ফুল কেনেন না, কিংবা ক্যাফেতে বসে প্রিয় আইসক্রিম একা খান না। আমাদের বাবারা বাড়ি ফিরতে দেরি হলে হয়তো কোনোদিন হাসতে হাসতে বলেন “পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো।”

আমাদের মায়েদের পুরনো বন্ধুরা হারিয়ে যায়, কিংবা কখনো তাদের সাথে দেখা হলেও বাবা নামক মানুষটির অনুমতি নিতে হয়। সন্ধ্যে নামার আগে বাড়ি ফেরার প্রতিজ্ঞা করে বের হতে হয়। আমাদের বাবারা সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে রাজনীতি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক জলবায়ু সব নিয়ে আলোচনা করেন, আমাদের মায়েরা আমাদের সন্ধ্যের জলখাবার দিয়ে সিরিয়াল দেখতে বসলে আমরা আধুনিকেরা বিরক্ত হই, কিন্তু মায়েদের জীবনে যে ওই একটাই অপশন বানিয়ে রাখা হয়েছে বিনোদনের, সে বিষয়টা আমাদের মাথায় আসে না। আমাদের পরিবারে মা বাবা দুজনই যদি কর্মজীবী হোন, তবে বাড়ি ফিরে আমাদের মায়েরাই ক্লান্ত শরীরে রাঁধতে বসেন, বাবারা আড্ডা দিয়ে ফিরে খেয়ে ঘুমোতে যান। আমরাও ভাবি ক্লান্তি শুধু বাবাদের হয়।

আমাদের আশেপাশে বিয়ের পর মেয়ে চাকরি করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করে পাত্রপক্ষের অনুমতির উপর। আমরা সেই অনুমতি পেলে পাত্রপক্ষকে দয়ালু ভেবে আহলাদে আটখানা হই, তবু মানুষ হিসেবে ওটা নিজের অধিকার তা ভাবতে পারি না।

আমাদের দেশের রাঁধুনী গুঁড়া মশলার মতো জনপ্রিয় প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে কোনো এক মাকে দিয়ে তার ছেলেকে বউ আনার ক্ষেত্রে বলানো হয় “যা নিজের জন্য রাঁধুনী নিয়ে আয়”, আমরা চ্যানেল বদলাই। আমাদের যুগ যুগ শেখানো হয় ইজ্জত সম্মানের মতো ভাররি ভারি বস্তু শুধু নারীদের থাকে। আপনার ধর্ম নামক স্পর্শকাতর বিষয়ে সবাই নারীর জন্যই নিয়ম খুঁজে পায়।

আমাদের প্রিয় বন্ধু বান্ধবেরা আদর্শ নারীবাদী মানেই চাকরি করবে, ঘর সামলাবে, শালীন থাকবে এসব ধারনাকে সযত্নে লালন করেন। আমরা তাদের বাহবা দেই, কিন্তু ভাবি না, নারী নামক প্রাণিটিও মানুষ, নারী কি করবে সেটা আমরা সমাজের নাকউঁচু মানুষেরা কেন বারবার ঠিক করে দেবে?

আমরা সব দেখে যাই, আমাদের চোখ ফোটে না। এমন এক বঙ্গে আমার চোখে নারীবাদ কি হতে পারে বলুন তো? আমি প্রতিনিয়ত ধারনাকে বদলাতে দেখি, মানুষের রং বদলাতে দেখি। একটা সময় খুব ন্যাকা ন্যাকা ভাবগাম্ভীর্যের সাথে আমি বলতাম “আমি মানুষবাদী”। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, যে পৃথিবীতে এই নারী নামক প্রাণিকে মানুষই বিবেচনা করা হয় না, সে পৃথিবীতে মানুষবাদী হয়ে লাভটা কী? আসলেই লাভ নেই, পৃথিবী নারীদের একবিন্দু নয়, কখনো ছিলো না।যুগে যুগে লড়াই করে জায়গা তৈরি করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে নিয়ম বানানোর হর্তাকর্তা পুরুষদের সাথে, লড়াই করতে হয়েছে নিয়মকে গভীরভাবে অন্তরে ধারণ করা প্রভুভক্ত নারীদের সাথে, লড়াই শেষ হয়নি।

নারীরা আজো মানুষ নয়। আমরা এখনো ধারণা নিয়ে, নিজেদের স্ট্যান্ড নিয়ে, নিজেদের আওয়াজ নিয়ে বিভ্রান্ত। আমরা এখনো নিজেরা নিজেদের মানুষ ভাবতে পারি না। এ পৃথিবীতে নারী হিসেবে নিজের জীবনকে নিজের মতো গুছিয়ে নিতে হাজারখানেক বাঁধা আমরা আজো পাই। আমরা ভেঙে পড়ি, আমরা হতাশ হই। তবু এই মৃতপ্রায় উপত্যকায় “নারীবাদ” শব্দটা আমাকে স্বপ্ন দেখায়। আমি খুব সাধারন মানুষ, আমি নীলনদের তীরে বসে ব্ল্যাক কফি খেয়ে বাকি জীবন পার করার অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি।

আমি বিশ্বাস করি এ স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা একজন নারী হিসেবে আমি নারীবাদ থেকেই পেয়েছি। আমি গুটিসুটি পায়ে মাথা নিচু করে স্কুলে যাবার সময়ে যখন কয়েকজন নারীর বলিষ্ঠকন্ঠে মিছিলে “আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত” শব্দ শুনেছি, আমি বিশ্বাস করি নারীবাদ তখন থেকে আমাকে চোখ খুলে দেখতে শিখিয়েছে। একজন নারী হিসেবে আমার চোখে নারীবাদ একটি স্বপ্ন, যা আমাকে এই পৃথিবীতে মানুষের দাম নিয়ে সব ভণ্ড নিয়ম ভেঙে এগোতে শেখায়। একটি অস্ত্র, যা আমাকে চিরচেনা শেকল ভাঙতে শেখায়। একটা সাহস, যা এই প্রতিকূল পৃথিবীতে লড়াই করতে বলে। বদল একদিন আসবে, হয়তো দেরিতে, কিন্তু লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহসটা নারীবাদই শিখিয়েছে আমাকে।

আমি আজকাল যখন পরিচিত মেয়েদের “স্বামীর একটু ভালোবাসা পেলে ঘর সংসারের সব কাজ উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব” বিষয়ক আবেগময় পোস্ট দেখি, তখন অবাক হই, আমার ভেতরে থাকা কেউ একজন প্রতিবাদ করে চিৎকার করে বলে “কাজ কারো একার হয় না, যতো ভালোবাসাই থাকুক না কেন।” এই যে যুগ যুগ ধরে চোখে রাখা সস্তা আবেগের চশমা আমি খুব সহজে খুলে ছুড়ে ফেলতে পেরেছি, তার জন্য একমাত্র নারীবাদের ভূমিকা রয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি আমি এ সমাজের চোখ না ওঠা একজন, সমাজের শেকলে আবদ্ধ মানুষ ছিলাম। নারীবাদ আমাকে সেই শেকল ভেঙে নিজেকে মানুষ চিন্তা করতে শিখিয়েছে। আর এ চিন্তার চেয়ে সুন্দর কিছু কী হতে পারে? আমার চোখে নারীবাদ শব্দটি পৃথিবীর প্রথম সূর্যাস্তের মতোই শুভ্র সাহসী, যে শব্দ  একটা অর্ধেক জনসংখ্যাকে মানুষের দাম দিতে এতোটা লড়াই আজ অব্দি করে এসেছে, সে জিনিসের চেয়ে ভালো কিছু আমার মতো সাধারণ মানুষের চোখে কিছুই হতে পারে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]