আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত: পর্ব-১
নাইজেরিয়ান নারীবাদী লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বক্তা চিমামান্দা এনগোজি আদিচের লেখা We should all be feminists বইটি মূলত একটি বক্তৃতা, যা তিনি ২০১২ সালে দিয়েছিলেন। পরে ২০১৪ সালে এটি বই আকারে বেরোয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন। অনুবাদটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর পর্ব-১।।
শুরুর কথা
২০১২ সালের ডিসেম্বরে টেড-এক্সইউস্টন-এর বাৎসরিক এক কনফারেন্সে আফ্রিকার উপর দেওয়া আমার একটি বক্তৃতার সংশোধিত সংস্করণ এই লেখাটি। বিভিন্ন বিষয়ের বক্তারা আফ্রিকা ও আফ্রিকান বন্ধুদের অনুপ্রাণিত করতে অল্পকথায় বিস্তৃত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে আমি অন্য এক টেড কনফারেন্সে “একক গল্পের বিপদ” শীর্ষক একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। ওই বক্তৃতার বিষয় ছিল- স্টেরিওটাইপগুলো কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ করে রাখে, বিশেষত আফ্রিকা বিষয়ে। আমার কাছে মনে হয়, “নারীবাদী” শব্দটি ও নারীবাদের ধারণাটিও কিছু স্টেরিওটাইপ দ্বারা সীমাবদ্ধ। যখন টেড-এক্সইউস্টন কনফারেন্সের দুই আয়োজক আমার ভাই চাকস ও সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইক আমাকে বক্তৃতা দিতে অনুরোধ জানায়, আমি না করতে পারিনি। আমি ঠিক করলাম, সেখানে নারীবাদ নিয়ে বক্তৃতা দেব, কারণ এই বিষয়টি আমি গভীরভাবে ধারণ করি। আমার সন্দেহ ছিল, বক্তৃতার বিষয় হিসেবে এটি হয়ত জনপ্রিয়তা পাবে না, তবুও আমি জরুরি এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ শুরু করব বলে আশা করলাম। সেদিন সন্ধ্যায় আমি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার এমন অনুভূতি হলো, যেন পরিবারের সদস্যদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। উপস্থিত দর্শকরা সদয় এবং মনযোগী ছিল, কিন্তু একজন আমার বক্তৃতার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানালো। তবে বক্তৃতা শেষে দর্শকদের দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়ার বিষয়টি আমাকে আশাবাদী করে তুলেছিল।
আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত
আমার ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের একজন ছিল ওকোলোমা। আমাদের একই গলিতে ছিল তার বাসা এবং আমাকে সে একজন বড় ভাইয়ের মতো দেখাশোনা করে রাখতো। সে সময় আমার কোনো ছেলেকে পছন্দ হলে, আগে আমি এ বিষয়ে ওকোলোমোর মতামত জানতে চাইতাম। ওকোলোমো ছিল বুদ্ধিমান ও মজার একজন মানুষ। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে, দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এক বিমান দুর্ঘটনায় ওকোলোমো মারা যায়। ওর চলে যাওয়ায় আমি ঠিক কীরকম অনুভব করি তা এখনও ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। ওকোলোমো ছিল এমন একজন—যার সঙ্গে আমি তর্ক করতে পারতাম, মন খুলে হাসতে পারতাম এবং সত্যিকার অর্থে কথা বলতে পারতাম। সে-ই ছিল প্রথম ব্যক্তি যে আমাকে একজন “নারীবাদী” বলেছিল।
তখন আমার বয়স ১৪, একদিন আমরা তার বাসায় ছিলাম। সেখানে নানা বিষয়ে তর্ক করছিলাম আমরা। আমাদের পড়া বইগুলো থেকে পাওয়া অর্ধ সেদ্ধ জ্ঞান নিয়ে তর্কযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া আরকি। তবে তখন ঠিক কী নিয়ে বিতর্ক করছিলাম তা এখন আর আমার মনে নেই। কিন্তু আমার মনে আছে যেটা তা হলো—আমি তর্ক করেই যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে ওকোলোমো আমার দিকে তাকালো এবং বললো—‘‘তুমি কি জানো, তুমি একজন নারীবাদী’’। তার এই কথাটি মোটেও প্রশংসা-সূচক ছিল না। সে এমন স্বরে আমাকে কথাটা বলেছিল, যেভাবে কেউ কাউকে বলে “তুমি সন্ত্রাসীদের সমর্থক”।
আমি তখন নারীবাদী কথাটার অর্থটা কী তাও জানতাম না। আমি এটাও চাইছিলাম ওকোলোমো যেন বুঝতে না পারে আমি নারীবাদী কথাটার অর্থ জানি না। তাই আমি বরং ওর কথাটা অবহেলা করে তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ঐদিন বাড়ি ফেরার পর আমি প্রথম যে কাজটি করব বলে ঠিক করলাম—তা ছিল ডিকশনারি খুলে ‘নারীবাদী’ শব্দটার অর্থ জানা।
এখন কিছু বছর পরে আগানো যাক।
২০০৩ সালে আমি পার্পল হিবিসকাস নামক একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। উপন্যাসের বিষয় ছিল এক পুরুষ, যে বউ পেটাতো। উপন্যাসের শেষে তার পরিণতি ভালো হয়নি। নাইজেরিয়ায় আমি যখন বইটির প্রচারণা করছিলাম তখন এক সাংবাদিক ভদ্রলোক আমাকে কিছু উপদেশ দিতে চাইলেন। (আপনারা হয়ত জানেন নাইজেরিয়ানরা উপদেশ দিতে সবসময় খুবই আগ্রহী থাকে)।
তিনি আমাকে বললেন, লোকজন উপন্যাসটিকে নারীবাদী উপন্যাস বলছে। এবং তিনি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে আমাকে উপদেশ দিলেন—আমি যেন নিজেকে কখনও নারীবাদী না বলি, কারণ যেসব নারী স্বামী না পাওয়ার কারণে অসুখী—তারাই নারীবাদী হয়।
সুতরাং আমি নিজেকে একজন “সুখী নারীবাদী” বলব বলে ঠিক করলাম।
এরপর নাইজেরিয়ার এক নারী, অ্যাকাডেমিক, আমাকে বললেন—নারীবাদ আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। নারীবাদ অ-আফ্রিকান। তখন আমি নিজেকে মাত্র নারীবাদী বলা শুরু করেছিলাম, কারণ আমি পশ্চিমা বইপত্র পড়ে প্রভাবিত হয়েছি। (এ বিষয়টি আমাকে আনন্দিত করে, কারণ আমার শুরুর দিকের বেশিরভাগ পড়াশুনা ছিল অ-নারীবাদী: আমি ১৬ বছর বয়েসের আগেই মিলস অ্যান্ড বন-এর প্রকাশিত প্রত্যেকটি রোমান্স পড়ে শেষ করেছিলাম। যখনই আমি ক্লাসিক ফেমিনিস্ট টেক্সট সম্বলিত নারীবাদী বইগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম, আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। এসব বই পড়া শেষ করতে সংগ্রাম করতে হতো।)
যাইহোক, যেহেতু নারীবাদ অ-আফ্রিকান, তাই আমি ঠিক করলাম আমি নিজেকে এখন থেকে “সুখী আফ্রিকান নারীবাদী” বলব। তারপর আমার এক প্রিয় বন্ধু আমাকে জানালো—নিজেকে নারীবাদী বলার অর্থ হলো—আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। তখন আমি ঠিক করলাম এখন হবো “একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী যে পুরুষদের ঘৃণা করে না”। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি ছিলাম “একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী যে পুরুষদের ঘৃণা করে না এবং যে লিপ গ্লস পরতে পছন্দ করে এবং যে পুরুষদের জন্য নয় বরং নিজের জন্য হাই হিল পরে”।
অবশ্যই এর বেশিরভাগই ছিল আসলে ব্যঙ্গাত্মক, তবে এসব ব্যাঙ্গ যা প্রকাশ করে তা হলো—নারীবাদী শব্দটি তল্পিতল্পাসহ কত ওজনদার, নেতিবাচকভাবে ভারী। যেমন নারীবাদী হলে আপনি পুরুষদের ঘৃণা করেন, আপনি ব্রা অপছন্দ করেন, আপনি আফ্রিকার সংস্কৃতি ঘৃণা করেন, আপনি মনে করেন দায়িত্বশীল জায়গায় সবসময় নারীদেরই থাকা উচিত, আপনি মেক-আপ করেন না, আপনি শেভ করেন না, আপনি সবসময় রেগে থাকেন, আপনার সেন্স অব হিউমার নেই, আপনি সুগন্ধি ব্যবহার করেন না ইত্যাদি।
এখন আমার ছোটবেলার এক গল্প বলি।
আমি তখন দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ইউনিভার্সিটির টাউন এনসুসুক্কার এক প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম। আমার শিক্ষক বছরের শুরুতে আমাদের বললেন, তিনি একটি পরীক্ষা নেবেন, এবং যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে সে-ই হবে ক্লাসের ক্যাপ্টেন। ক্লাসের ক্যাপ্টেন হওয়া কিন্তু বড় ব্যাপার। আপনি যদি ক্লাসের ক্যাপ্টেন হয়ে হয়ে যান তবে যারা চিৎকার-চেঁচামেচি করে তাদের নাম লিখে রাখতে পারবেন, এই কাজটি এমনিতেই যথেষ্ট ক্ষমতার কাজ, তার উপর আমাদের শিক্ষক ক্যাপ্টেনকে ক্লাসে টহল দেওয়ার সময় হাতে রাখার জন্য একটি বেতও দিতেন। তবে অবশ্যই এই বেতটি ব্যবহার করার অনুমতি থাকত না। এই বেতটি ৯ বছর বয়েসি আমার কাছে উত্তেজনার বস্তু ছিল, ফলে এটির দিকেই ছিল আমার আগ্রহ। এবং আমি ওই পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেলাম।
তারপর, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার শিক্ষক বললেন, ক্লাসের ক্যাপ্টেন একজন ছেলেকেই হতে হবে, তিনি নাকি আগের বার এ ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে ভুলে গিয়েছিলেন; কারণ তিনি ভেবে নিয়েছিলেন বিষয়টি সবার কাছেই স্পষ্ট ছিল। ওই পরীক্ষায় একটি ছেলে দ্বিতীয় হয়েছিল এবং সে ক্লাসের ক্যাপ্টেন হবে।
এর চেয়ে মজার বিষয়টি হলো ওই ছেলেটি ছিল মিষ্টি-কোমল এক ছেলে, হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে টহল দিতে কোনো আগ্রহই তার ছিল না। বিপরীতে এই কাজটি করতে আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনো অভাব ছিল না।
কিন্তু আমি মেয়ে, সে ছেলে; তাই সেই হলো ক্লাসের ক্যাপ্টেন।
আমি কখনোই ওই ঘটনাটি ভুলিনি।
আমরা যদি কোনো কাজ বার বার করতে থাকি তবে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কোনো জিনিস যদি আমরা বার বার দেখতে থাকি, তবে তা স্বাভাবিক লাগে। যদি সবসময় শুধু ছেলেদেরই ক্লাসের ক্যাপ্টেন বানানো হয় তবে এক সময় আমাদের মনে হবে, এমনকি অবচেতনভাবে, যে ক্লাসের ক্যাপ্টেন সবসময় কোনো ছেলেই হবে। কোনো কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ পদে যদি আমরা পুরুষদের দেখতেই থাকি তবে কোনো কর্পোরেশনের প্রধান পদ কেবলই পুরুষদের জন্য এটাই ‘স্বাভাবিক’ মনে হবে।
আমি সবসময় একটি ভুল করে থাকি তা হলো, আমার নিজের কাছে যা প্রতীয়মান তা অন্যদের কাছেও একইভাবে প্রতীয়মান বলে ধরে নেই। যেমন আমার মেধাবী ও প্রগতিশীল বন্ধু লুইসের কথাই ধরুন। আমরা দুইজন কথাবার্তা বলার সময় সে আমাকে বলে, ‘‘তুমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছো—নারীদের জন্য অনেক কিছু কঠিন, কিন্তু আমি তো তা এমন দেখি না। এটা হয়ত আগে হতো, কিন্তু এখন আর নয়। নারীদের জন্য এখন সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে’’। আমি বুঝি না, এইসব প্রমাণিত বিষয়গুলোও কীভাবে তারা না দেখে পারে।
আমি নাইজেরিয়ায় বাড়িতে যেতে ভালোবাসি। আমার বাড়িটি দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক শহর লাগোসে, সেখানে সময় কাটানো আমার পছন্দের। মাঝে মাঝে সন্ধেবেলায় যখন তাপমাত্রা ও শহরের ব্যস্ততা কিছুটা কমে তখন বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে যাই। এমন এক সন্ধ্যায় আমি ও লুইস কিছু বন্ধুর সঙ্গে বের হয়েছিলাম।
লাগোসে একটি চমৎকার ব্যাপার আছে: কিছু প্রতিষ্ঠানের বাইরে দেখা যাবে উদ্যমী যুবকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা দারুণ নাটকীয়ভাবে এসে আপনার গাড়িটিকে পার্ক করতে সাহায্য করবে। লাগোস হলো দুই কোটি নাগরিকের এক মহানগর যে শহরের মানুষ লন্ডনবাসীদের চেয়েও কর্মচঞ্চল, নিউইয়র্কবাসীদের চেয়েও বেশি উদ্যোগী মনোভাবের। তাই এখানে নানা ধরনের জীবিকা নির্বাহের উপায় নিয়ে আসে মানুষ। বেশিরভাগ বড় শহরের মতোই সন্ধেবেলায় এখানেও পার্কিং খুঁজে পাওয়া কঠিন, তাই এই যুবকরা পার্কিংয়ের জন্য জায়গা খুঁজে দেওয়ার কাজটি করে এবং এটি তাদের একটি ব্যবসা। এমনকি যখন পার্ক করার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে তখনও এরা এসে এমন নাটকীয় আচরণ করবে পাশাপাশি আপনি ফিরে আসা পর্যন্ত গাড়িটি দেখাশোনার প্রতিশ্রুতি দেবে, যেন আপনি তাদের হাতে গাড়িটি সপে দেন। আমাদের গাড়ির জন্য পার্কিং স্পট খুঁজে দিয়েছিল এমন এক লোকের নির্দিষ্ট এক নাটকীয় ভঙ্গীতে ওই সন্ধ্যায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। যখন আমরা ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বের হলাম তখন ওই লোকটিকে আমি বখশিশ দিতে চাইলাম। আমি ব্যাগ খুললাম, টাকা বের করার জন্য ব্যাগের ভেতর হাত দিলাম, এবং আমি টাকাটা তার হাতে দিলাম। লোকটি খুশি হলো—আমার হাত থেকে টাকা নিয়ে সে লুইসের দিকে তাকালো এবং কৃতজ্ঞ হয়ে তাকে বললো, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’।
লুইস আমার দিকে তাকালো, আশ্চর্য হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘সে আমাকে কেন ধন্যবাদ জানালো? আমি তো তাকে টাকা দেইনি’’। তারপর আমি লুইসের চেহারায় দেখলাম সে এবার বুঝতে পেরেছে। পার্কিংয়ের লোকটির বিশ্বাস ছিল যে, আমার কাছে যে টাকাই আছে তা আসলে এসেছে লুইসেরই কাছ থেকে। কারণ লুইস একজন পুরুষ।
[চলবে]