December 23, 2024
অনুবাদফিচার ১সাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত: পর্ব-০২

নাইজেরিয়ান নারীবাদী লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বক্তা চিমামান্দা এনগোজি আদিচের লেখা We should all be feminists বইটি মূলত একটি বক্তৃতা, যা তিনি ২০১২ সালে দিয়েছিলেন। পরে ২০১৪ সালে এটি বই আকারে বেরোয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন। অনুবাদটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর পর্ব-২।।

নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের ভিন্ন হরমোন, ভিন্ন যৌন অঙ্গ ও ভিন্ন জৈবিক সামর্থ্য। নারীরা বাচ্চা নিতে পারে, পুরুষরা পারে না। পুরুষদের অধিক টেস্টোস্টেরন ও সাধারণত শারীরিকভাবে পুরুষরা নারীদের চেয়ে শক্তিশালী। পৃথিবীতে পুরুষদের চেয়ে নারীর সংখ্যা কিছুটা বেশি, বিশ্ব জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ নারী। তবে বেশিরভাগ ক্ষমতা ও সম্মান পুরুষদের দখলে। কেনিয়ার নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ওয়ানগারি মাথাই ব্যাপারটি সহজ করে বলেছিলেন, “আপনি যত উপরে যাবেন দেখবেন সেখানে নারীর সংখ্যা তত কম”।

সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচনে আমরা লিলি লেডবেটার আইনের* কথা বার বার শুনছিলাম। আকর্ষণীয় নামটির বাইরে চিন্তা করলে, এটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রে একজন নারী ও একজন পুরুষ একই যোগ্যতা নিয়ে একই কাজ যদি করে, তবে নারী কর্মীর তুলনায় পুরুষ বেশি বেতন পেত, কারণ সে একজন পুরুষ—ওই ব্যাপারটি নিয়ে আইন।

তাই আক্ষরিক অর্থে, পুরুষরা পৃথিবী শাসন করে। হাজার বছর আগে ব্যাপারটি বোধগম্য ছিল, কারণ সে সময় মানুষ এমন এক জগতে বাস করত যেখানে টিকে থাকার জন্য শারীরিক শক্তি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; শারীরিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তি নেতৃত্ব দিত। এবং সাধারণত পুরুষরা শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে (এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে)। আজ আমরা এক ভিন্ন জগতে বাস করি। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সবচেয়ে যোগ্য তার শারীরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়াটা জরুরি নয়। নেতৃত্ব দিতে যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন সেগুলো হলো—বেশি বুদ্ধিমান, বেশি জ্ঞানী, বেশি সৃজনশীল ও বেশি উদ্যোগী হওয়া। এবং এসব গুণাবলির জন্য কোনো হরমোন দায়ী নয়। একজন পুরুষ ততটুকুই বুদ্ধিমান, উদ্যোগী, সৃজনশীল হতে পারে যতটুকু একজন নারী পারে। আমরা বিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের লিঙ্গ সম্পর্কিত ধারণাগুলো খুব বেশি বিকশিত হয়নি।

বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, আমি নাইজেরিয়ার অন্যতম সেরা একটি হোটেলের লবিতে ঢুকছিলাম, প্রবেশ পথে এক নিরাপত্তাকর্মী আমাকে আটকালো এবং বিরক্তিকর সব প্রশ্ন করা শুরু করল। আমি যার কাছে যাচ্ছি তার নাম কী, তার রুম নম্বর কত? যার কাছে যাচ্ছি আমি কি তাকে চিনি; আমি কি তাকে চাবির কার্ড দেখিয়ে প্রমাণ দিতে পারব যে আমি হোটেলের একজন গেস্ট ইত্যাদি। কারণ স্বাভাবিক ধারণাটি হলো—একজন নাইজেরিয়ান নারী একা একটি হোটেলে প্রবেশ করা মানে সে যৌনকর্মী। কারণ একজন নাইজেরিয়ান নারী একা নিজে ভাড়া দিয়ে একটি হোটেলে রুম নিতে পারবে না। একজন পুরুষ আবার একই হোটেলে ঢুকলে সে হয়রানির শিকার হবে না। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় সে এখানে বৈধ কিছু করার জন্যই এসেছে।

লাগোসে আমি বহু নামীদামী ক্লাব বা বারে একা যেতে পারি না। আপনি যদি নারী হন আর সেসব জায়গায় একা যান, তাহলে আপনাকে তারা ঢুকতে দেবে না। আপনার সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে।

এরকম আমার এক পুরুষ বন্ধু ছিল, যে ক্লাব এলাকায় যেত ও সেখানে অপরিচিত নারীদের জড়িয়ে ধরে ক্লাবে ঢুকত। কারণ ওই অপরিচিত নারীরা একা ক্লাবে ঢুকতে পারবে না, তাই তার সঙ্গে একজন পুরুষ দরকার, আমার বন্ধুটি তাদের ক্লাবে ঢুকতে সাহায্য করত। একা একজন নারীকে ক্লাবে ঢুকতে হলে তার সাহায্য চাওয়া ছাড়া তাদের উপায় ছিল না।

যতবার আমি নাইজেরিয়ার কোনো রেস্তোরায় পুরুষের সঙ্গে যেতাম ততবারই আমার সঙ্গে থাকা পুরুষটিকে ওয়েটাররা অভ্যর্থনা করত, কিন্তু আমাকে করত না। এই ওয়েটাররা হলো সমাজেরই সৃষ্টি। তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং আমি জানি এরা কোনো ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে তা করত না, কিন্তু কোনো কিছু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বোধগম্য হওয়া আর আবেগে আঘাত লাগার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রত্যেকবার তারা যখন আমাকে অভ্যর্থনার ক্ষেত্রে অবহেলা করে, আমি নিজেকে একজন অদৃশ্য মানুষ মনে করি। আমি বিব্রতবোধ করি। আমি তাদের বলতে চাই, আমি পুরুষদের মতোই একজন মানুষ, তাদের মতোই একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। এগুলো ছোট ছোট ব্যাপার, কিন্তু মাঝে মাঝে এসব ছোট ব্যাপারই বড় আঘাত দেয়।

কিছুদিন আগে আমি লাগোসে একজন যুবতি নারী হওয়ার মানে কী— সে ব্যাপারে এক প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এ নিয়ে আমার এক পরিচিতজন আমাকে বলেছিলেন, প্রবন্ধটি নাকি খুবই ক্ষুব্ধ একটি লেখা। লেখাটিকে এত রাগী রাগী করা উচিত হয়নি আমার। কিন্তু আমি তার মতামতে কোনো কৈফিয়ত দেইনি। অবশ্যই এটি একটি ক্ষুব্ধ প্রবন্ধ ছিল। জেন্ডার এখন যেভাবে সমাজে কাজ করছে তা এক গুরুতর অবিচার। আমি ক্ষুব্ধ। আমাদের সবারই ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। ইতিবাচক পরিবর্তন আনার পক্ষে ক্ষোভের এক লম্বা ইতিহাস আছে। তবে একইসঙ্গে আমি আশাবাদীও, কারণ আমি মানুষের সক্ষমতার উপর গভীরভাবে বিশ্বাস রাখি, যে তারা নিজেকে আরও উন্নততর করে গড়ে তুলবে।

কিন্তু ক্ষোভের বিষয়ে বলি। ওই পরিচিতজনের স্বরে আমি যে সতর্কতার আঁচ পেয়েছিলাম তাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তার ওই মন্তব্যটি যতটা না আমার প্রবন্ধটি নিয়ে তার চেয়ে বেশি আমার চরিত্র নিয়ে তিনি করেছিলেন। তার কথার স্বরে বুঝাতে চেয়েছেন, ‘ক্ষোভ’ অনুভূতিটি নারীদের থাকা ভালো নয়। আপনি যদি নারী হন তবে ক্ষোভ প্রকাশ করা যাবে না, কারণ এটা হুমকিস্বরূপ। আমার এক আমেরিকান বন্ধু আছে, যে এক ম্যানেজার পদে চাকরি পেয়েছিল। এই পদটিতে আগে একজন পুরুষ চাকরি করতেন। তার পূর্বসূরি ওই পুরুষ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পরিচিত ছিল। তিনি কট্টর এবং বিশেষ করে কর্মীদের সময়সূচী মেনে চলার ব্যাপারে খুবই কঠোর ছিলেন। আমার বন্ধুটি তার জায়গায় কাজ শুরু করল, এবং ধারনা করল সে আগের জনের মতোই কঠোর, কিন্তু সম্ভবত কিছুটা দয়াবানও ছিল— কারণ কর্মীদেরও পরিবার আছে এই কথাটি আগেরজন বুঝতে চাইতেন না। ম্যানেজার হিসেবে মাত্র এক সপ্তাহ কাজ করার পর আমার বন্ধু এমন একজন কর্মীকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসলো যে টাইম শিটে জালিয়াতি করেছিল। এই কর্মীকে এভাবে শৃঙ্খলায় আনার কাজটি তার পূর্বসূরিও করতেন। কিন্তু টাইম শিটে জালিয়াতি করা কর্মীটি নতুন ম্যানেজারের কাজের ধরণ নিয়ে টপ ম্যানেজমেন্টে অভিযোগ করে বসলো। কর্মীটি তার অভিযোগে বললো, নতুন ম্যানেজারের সঙ্গে কাজ করা কঠিন কারণ সে আগ্রাসী এবং কঠোর। তার অভিযোগের সঙ্গে অন্য কর্মীরাও একমত হলো। তারা বললো, তারা আশা করেছিল, নতুন ম্যানেজার তার কাজের ক্ষেত্রে নারীসুলভ ধরন নিয়ে আসবেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।

যে কাজের জন্য একজন পুরুষ প্রশংসিত হয়েছিল ঠিক একই কাজের জন্য একজন নারীকে প্রশংসা করার মতো ইচ্ছা তাদের কারো হলো না।

আমার আরেক বন্ধু ছিল, সেও একজন আমেরিকান নারী, সে বড় অঙ্কের বেতনে বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করত। সে তার দলের দুই নারীর একজন। সে আমাকে বলেছিল, একবার এক মিটিংয়ে বসের আচরণ তার নিজেকে মানসিকভাবে ছোট ভাবতে বাধ্য করছিল, কারণ বস তার যে কোনো মন্তব্য বা পরামর্শ অবহেলা করে যাচ্ছিলেন, অথচ একই পরামর্শ বা মন্তব্য যদি কোনো পুরুষ করে তবে বস তার প্রশংসা করছিলেন। সে এ ব্যাপারে মিটিংয়ে কথা বলতে চাইছিল, বসকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করে মিটিং শেষে বাথরুমে গিয়ে কাঁদছিল। তারপর ক্ষোভ প্রশমন করতে আমাকে ফোন করে এ ঘটনাটি বলেছিল। সে ওই মিটিংয়ে প্রতিবাদ করতে চাইছিল কিন্তু করেনি, কারণ তাকে কেউ আগ্রাসী মনে করুক সেটা সে চাইত না। সে তার বিরক্তি দমন করে রেখেছিল।

আমার ওই বন্ধু ও আরও বহু আমেরিকান বন্ধুদের যে বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় তা হলো– তারা অন্যদের পছন্দসই হওয়ার জন্য কত আগ্রহী। তারা এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছে যে, তাদের ‘পছন্দসই’ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই ‘পছন্দসই’ বৈশিষ্ট্যটি একটি নির্দিষ্ট ব্যাপার, আর এই নির্দিষ্ট ব্যাপারটির মধ্যে রাগ দেখানো, আগ্রাসী হওয়া বা জোর গলায় দ্বিমত জানানো অন্তর্ভুক্ত নয়।

আমরা মেয়েদের প্রচুর সময় দিয়ে এটা শেখাই যে, ছেলেরা তাদের নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তবে উল্টোটা কিন্তু হয় না। আমরা ছেলেদের ‘পছন্দসই’ হওয়ার ব্যাপারে মন দিতে তাগিদ দেই না। আমরা মেয়েদেরকে ক্ষুব্ধ না হওয়া, আগ্রাসী না হওয়া বা কঠোর না হওয়ার শিক্ষা দিতে প্রচুর সময় ব্যয় করি। মেয়েদেরকে এসব শিক্ষা দেই, আবার ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তাদের প্রশংসা করি। বিশ্বজুড়ে প্রচুর ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ আছে যেগুলোতে ছেলেদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে মেয়েদের কী কী করতে হবে, কী না করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে ইত্যাদি শেখানো হয়। বিপরীতে নারীদের সন্তুষ্ট করতে হলে ছেলেদের কী করতে হবে সেরকম নির্দেশনা খুব কমই আছে।

আমি লাগোসের একটি কর্মশালায় শিক্ষকতা করছিলাম এবং সেখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক যুবতী আমাকে বললেন, তার এক বন্ধু তাকে বলেছে আমার ‘নারীবাদী কথা’ না শুনতে, কারণ এতে সে যা শিখবে তাতে তার বিয়ে ভেঙে যাবে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার, এমনকি কখনোই বিয়ে না হওয়ার এই হুমকিটি আমাদের সমাজে পুরুষদের চেয়ে নারীদের বিরুদ্ধে অনেক বেশি ব্যবহার করা হয়।

[চলবে]

*অনুবাদকের মন্তব্য: তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রথম স্বাক্ষরিত বিলটি ছিল লিলি লেডবেটার ফেয়ার পে অ্যাক্ট। এ আইনের মাধ্যমে সেদেশে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য দূর করা হয়। 

পর্ব-১: আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত: পর্ব-১