December 3, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নারীর ঐতিহাসিক সংকটের সুলিখিত রূপ

সেঁজুতি জাহান জিনাত।। প্রত্যেকটি মানুষই নিজেকে একজন আলাদা মানুষ মনে করে থাকে। এই মনে করা দোষের না।  কিন্তু এটা যে প্রতিটি মানুষই মনে করতে পারে, সেটা হৃদয়ে জায়গা না দেওয়াটা দোষের।

‘ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর’ এ নারীরা অবলীলায় তাদের কথাগুলো বলেন। মানে,  বলতে পারেন আর কি। তারা যে ঐতিহাসিক সামাজিক সংকটগুলোকে অনুভব করতে পারেন, সেগুলো অনুভব করে এই প্লাটফর্মে  তার একটি সুলিখিত রূপ দিতে পারেন এটা মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট হয়।

নারীর কণ্ঠ হবে পুরুষের চেয়ে নিচে। তা হোক না, যদি সেটা আপসে হয়। কিন্তু জোর করে হ্যাজিমনি তৈরি করে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য তৈরি করার দরকার নাই তো।

আমাদের দেশের অফিস আদালতগুলোতে এখনও একটা দারুণ ‘অফ দ্যা রেকর্ড’ কথা চালু আছে। একজন নারী কলিগ কর্তব্যকাজের ব্যাপারে কিছুতেই একজন পুরুষ কলিগের বিকল্প হতে পারেন না। মানে ঘর সংসার সামলানোর কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা তারা কিছুতেই করতে পারবেন না। কথাটা অবশ্য ‘পারবেন না’ নয়, বরং বলা উচিৎ কিছুতেই পারতে দেওয়া যাবে না।

ভেতরে সেই প্রতিভা থাকলেও তার ভেতরে নানাপ্রকারের হীন বোধ সৃষ্টি করে সেই প্রতিভাকে বিনষ্ট  করে দিতে হবে, যেকোনো মূল্যে। কেননা, তারা জন্মগতভাবেই ‘কমবুদ্ধি’র প্রাণী। এমন দৃষ্টিভঙ্গি এমন কি অতি উচ্চ শিক্ষিত পুরুষ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আছে।

নারীরা আবার গবেষণা করতে পারে নাকি?  তাদের হাতে কলমের কালির দাগের চেয়ে হলুদের দাগই শোভা পায় বেশি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক নারী শিক্ষকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের অভিযোগ তাঁরা সংসার সন্তানের জন্য নিজের কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছেন।

আবার এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁদের চিন্তা বা গবেষণাকে অনেক ক্ষেত্রেই  গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাঁরা পড়াশোনা বা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মাঝবয়সের অনেক পরে নিজের পরিশ্রমের সম্মাননা পেয়েছেন। তাও যেন পুরুষের করুণাযোগে!

সাহিত্যের ক্ষেত্রে আসি। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেই দেখে থাকি অনেক প্রতিষ্ঠিত পুরুষ কবি, গল্পকার বা সাহিত্য সমালোচক কোনো কোনো নারী কবির কবিতা নিয়ে কটাক্ষ করে পোস্ট দিচ্ছেন: ‘অমুকের কবিতার চেয়ে চেহারা বেশি আকর্ষণীয়।’

অথচ অনেক নিম্ন ক্যাটাগরির কবিকেও তো তারা মাথার উপরে উঠিয়ে উল্টিয়ে পালটিয়ে চলতি সাহিত্যের প্রথম সারিতে জায়গা করে দিচ্ছে।

এমনটা কেন ঘটছে এই বঙ্গ দেশে?

কারণটা পরিষ্কার।  আমরা নারীকে গৃহকর্মেই দেখে অভ্যস্ত। টুকটাক স্মার্ট লেডিদের একটু আধটু ভালো লাগলে তাদেরকে উপভোগের তাড়নায় হালকা গুরুত্ব দিয়ে পরে কার্যসিদ্ধি হলে বা না হলেও তাকে বেহুদাই বাজারে (বাজারি-বালিকা খেতাব তুলে) পাঠিয়ে দিয়ে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সৃষ্টি-স্রোতে এসে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। আহা, এই দেশে ধর্মতন্ত্র আর পুরুষতন্ত্রের ভাষায় কথা বলার মতো এমন সামাজিক আরাম যেন আর কিছুতেই নাই!

আরও মজার ব্যাপার হলো, এগুলো কেবল পুরুষেরাই করছে তা নয় কিন্তু, এর জন্য নারীদের হীনম্মন্য দশাও অলক্ষ্যে অনেক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে একজন নারী সাহিত্যিকের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার সংগ্রাম একজন পুরুষের চেয়ে শতকোটি গুণ বেশি। পুরুষ সাহিত্যিককে ফাইট করতে হয় তার প্রতিভা আর চর্চা নিয়ে। নারী সাহিত্যিককে ফাইট করতে হয় খোদ অস্তিত্ব নিয়ে। আপনি একটি উদাহরণ দেখাতে পারবেন না যেখানে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সাহিত্য-স্রোতে কোনো নারী সাহিত্যিককে তার নারীত্বের বাইরে গিয়ে অবলীলায় শুধু তার প্রতিভার ফাইট করতে হচ্ছে। একজনকেও পাবেন না। সামনে সামনে কতো প্রশংসা করতে দেখবেন, অথচ প্রতিষ্ঠার জায়গাতে গিয়ে আপনার যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে এগিয়ে রাখবে। আপনি কী কী পড়েছেন, কী কী পড়েন নাই, আপনার লেখনী ক্ষমতায় কার প্রভাব আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠিত নারী সাহিত্যিকদের নাম না নিলেই যেন সাহিত্যের মুক্তি- এমন একটি প্রবণতা আছে এই দেশে।

১২০০ সালের খনা বা লীলাবতী নামের যে নারীটি জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ জ্ঞানার্জন এবং প্রয়োগ করে নিজের জিহ্বা এবং জীবন হারিয়েছেন, খনার ভেতরের সেই নারী সত্তাটি এখনও নিজের জিহ্বার জন্য ঝুঁকির মধ্যে বাঁচেন।

১২০০-২০২১ এর মধ্যে ৮২১ বছর। ৮০০ বছরে আট রত্তিও পাল্টায়নি এই বাংলার সমাজ বা সভ্যতা।

রবীন্দ্রনাথ যেই ‘সভ্যতা’কে ‘সদাচার’ বলে বাঙালির ইউরোপীয় দাস-বৃত্তির চরম ও করুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে আফসোসে আফসোসে শেষ হয়ে গেছেন। জীবনের ৮০ বছরে উপনীত হয়ে আত্মখেদ জাহির করেছেন বিভিন্ন লেখায়। সেই ‘সভ্যতার সংকট’ আমরা জিনেটিক্যালি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের ঐতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়মিত গতিধারায়।

কবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘নারী মুক্তি’ হবে তা নিয়ে আমি এখনও সন্দিহান।

জানি আমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই লেখার জন্য আমাকেও বঙ্গের নানা কুতুবের তৈরি করা বাংলা অলঙ্কারের অনেক কিসিমের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ব্যাজস্তুতির অনাসৃষ্টি-বর্জ্য ভোগ করতে হবে। তা হোক। তবু এই প্লাটফর্মে এসে নারীরা তাদের কথাটা বলুক।

বদ্ধ, হীন, দাসবৃত্তিক, বন্ধ্যা সেই অনাসৃষ্টির কর্ণকুহরে যদি একটুও এই আওয়াজ পৌঁছে তো তাই হবে এক নিরুপায় ইতিহাস সৃজন।

‘ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর’ এর এক বছরের যাবতীয় লেখা টিকে থাক আগামী ১০০০ বছরের গহ্বরে। শুভকামনা ‘ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর’ এর জন্য।