আলেয়া জুড়ে জুড়ে আলোর স্তুপ
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের জন্মলগ্ন থেকেই মনে হয়েছিলো, নিঃসংকোচে লেখালেখির জন্য আরো এক চিলতে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলো। সেই জায়গা থেকে এক বছরে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নিরাশ তো করেইনি বরং ঋদ্ধ করেছে, স্বাধীন চিন্তা-চেতনার দুয়ার উন্মোচন করেছে একের পর এক। অশিক্ষা, কুসংস্কার, সংকীর্ণতা ও মানসিক দৈন্যকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যত বেশি সোচ্চার হওয়া যায়, যত শামিল হওয়া যায়, সম অধিকার সম্পন্ন সভ্য ও মানবিক পৃথিবীর পথে ততোটাই অগ্রযাত্রা।
সেইদিক বিবেচনায় ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর আমাদের জন্য স্বপ্নের অভিযাত্রায় নিঃসন্দেহে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রথম দিকে ঘরে থাকার টানা কয়েক মাস পার করে ততোদিনে প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া শুরু করেছি। করোনাকালীন অবসর বলে কিছু নেই আমার। বাড়ির অন্য সদস্যরাও ঘরের কাজকর্ম করতে চেষ্টা করেছে তারপরও সাংসারিক দায়ভার আর ঝুট-ঝামেলা আমার পায়ে-পায়ে হেঁটেছে। সেই সাথে চতুর্দিক থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিগত বিপদ-আপদ, ঝড়ঝাপটা ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে আমাকে। দায়িত্ব এড়াতে না পারার দায়ে দায়িত্বশীল এক কঠিন জীবন আমার। যৎসামান্য লেখালেখি আর জানালার ক্যানভাসে রঙতুলির নিজস্ব জগতেই আমার নিত্য আসা-যাওয়া। সেখানটাতেই কখনো শ্যাওলা জমে, কখনো ঘন কুয়াশা।
হাল না ছাড়ার শপথে অবিচল রয়ে যাই তবু।
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক লিখতে উৎসাহিত করেন প্রায়শই। ভাবছিলাম বৈশ্বিক মহামারীতে ঘরে থাকা-না থাকা অনলাইন-অফলাইনে মোটামুটি ২৪ ঘন্টা-৭ দিন-৩৬৫ দিন কর্মরত নারীর দৈনন্দিন নিয়েই লিখব।
আমার একটু আধটু আঁকাআঁকির স্টুডিও ঘরখানাও অপেক্ষায় পড়ে থাকে। মনের জানালাগুলোয় মনে মনে নানান রঙে আঁকি। আজকে যা উজ্জ্বল রঙে রাঙাবো ভাবি কাল তা ধূসর মনে হয়।
দিনগুলো পার হতে থাকে নিদারুণ অনিশ্চয়তায়, অক্লান্ত পরিশ্রমে। ছেদ পড়ে লেখালেখির অভ্যাসে। মনে হয় দূরপাল্লার বাসের গায়ে লেখা “বিরতিহীন সার্ভিস” শব্দটা নিজের জীবনে সেঁটে গিয়েছে অজান্তে।
আচমকা কিছু গালিগালাজের আওয়াজ ভেসে আসে কানে… “শুয়োরের বাচ্চা! কী করবি কর! নিজের পকেট থেকে আর একটা পয়সাও তোকে আমি দেবো না।’
বারান্দায় বসেছিলাম। আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাট থেকে কান্না জড়ানো নারীকণ্ঠের চিৎকারটা ভেসে এলো। পুরুষকণ্ঠও ছিল। নিচু স্বরে কথা বলছিলো সে।
এমনকি, খুব ভুল না হলে বিক্ষিপ্তভাবে ধাক্কধাক্কির আওয়াজ শুনেছি দু’একবার। কোন বাড়ি থেকে তা বোঝা যায় না। সংসারের ছোটখাটো কোনো বিষয়ে আমারও মনটা বিক্ষিপ্ত ছিলো সেদিন। সেই মুহূর্তে চিন্তাটা ধাবিত হয়েছিলো বাতাসে ভেসে আসা আবার ইটের দেয়ালে মিশে যাওয়া চাপা আর্তনাদে।
মহামারীতে জর্জরিত পৃথিবীতেও নারীর প্রতি সহিংসতা থেমে থাকেনি। কিছুদিন আগে বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে –
“কোভিড ১৯-এর আক্রমণের শুরুতে নারীর অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে জরিপ করে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। ব্র্যাকের জরিপের তথ্যানুযায়ী ৯১ শতাংশ নারী বলছেন, বাসায় তাদের কাজের চাপ বেড়েছে। ৮৯ ভাগ নারী বলছেন অবসর বলে কিছু নেই। সারা দিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। গৃহস্থালীর কাজ, বয়স্কদের সেবাযত্ন, ছোটদের খেয়াল রাখাসহ যারা সচরাচর বাসায় থাকেন না তাদেরও দেখভাল করতে গিয়ে নিজের সময় বলে কিছু থাকছে না। জরিপে তৃণমূল থেকে নেওয়া তথ্য বলছে এ সময়ে সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯১ ভাগ নারী ও কন্যাশিশু। ৮৫ ভাগ নির্যাতনকারী ঘরের মধ্যেই ছিল।”
সেই প্রতিবেদনে আরো লেখা হয়েছে –
“পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, বিদায়ী বছরে দেশে লকডাউনকালে উল্লেখযোগ্য হারে নারীরা শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার খবর এসেছে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহও থেমে থাকেনি। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কয়েক দফা জরিপে জানায়, এমন অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে যারা আগে কখনও নির্যাতনের শিকার হয়নি।
নভেম্বরের শেষে দেশের ৫৯ জেলার ১০ লাখ নারীর অংশগ্রহণে করা এক জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ হাজার নারী পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী প্রথমবারের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সংস্থাটি জানিয়েছে, লকডাউন চলাকালে নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। জরিপে দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বেশি।”
থমকে গেছে পৃথিবী তবু থেমে থাকেনি ধর্ষণ, বেড়েছে সহিংসতা, পারিবারিক নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ। থামেনি ভিকটিম ব্লেমিং গেইম। সক্রিয় অপরাধীর সাথে এক কাঠি সরেস রয়ে গেছে অপরাধের ধারক-বাহক সমাজের মানসিকতা। যাদের কাজ ধর্ষণের কারণ হিসেবে হরদম নারীর পোশাক, নারীর চলাফেরা, আচরণ, বাবা – মা, পরিবার, প্রেমের সম্পর্ক ইত্যাদির দিকে আঙুল তোলা। ভাষার মাসের প্রথম প্রহরে ধর্ষণ-হত্যার পর ফুল বিক্রেতা কিশোরী মেয়েটির নগ্ন-নিথর দেহ পড়ে থাকে শহীদ মিনারের পেছনে।
জরিপের ৯১, ৮৯ বা ৪০ শতাংশের মধ্যে কোথাও না কোথাও আমাদেরকে পড়ে থাকতে দেখে পুরুষতন্ত্র তার বিকট দন্ত বিকশিত করে কদাকার অট্টহাসি হাসে। প্রতিরোধ, প্রতিকার ও পরিত্রাণের পথ খুঁজে পেতে যারা সামনে এসে বুক টান করে দাঁড়িয়ে যায়-তাদের কপালে চরিত্রহীন, নারীবাদী, বেশ্যা তিলক এঁটে একঘরে করা সমাজের পুরনো চরিত্র।
ভাবি, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের জন্য লেখাটা এবার ঠিক লিখে ফেলবো।! ভাবি, কী হবে লিখে? আবার ভাবি, অসাধ্য সাধন কিছু না হলেও লিখবো। আলোর স্তুপের আশায় আলেয়াগুলো জমিয়ে রাখি সযতনে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]