December 23, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩

নারী ও পুরুষের সমতা

অনন্য আজাদ।। শুধু বাংলাদেশের নারীবাদী নয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নারীবাদীদের লিঙ্গ বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই প্রশ্নগুলি পুরুষেরা করে থাকে; তবে, নারীদের মধ্যেও এই নিয়ে বিভ্রান্তি লক্ষণীয়।

সমতা শব্দটি চমৎকার। যার অর্থ সাম্য বা অভেদ। কিন্তু এই সাম্য বা সমতা শব্দটি অনেকের কাছে অসম্মানের; যদি বিষয়বস্তু হয়ে থাকে নারী ও পুরুষের সমতা নিয়ে। লিঙ্গ সমতা নিয়ে ইউএনএফপিএ (UNFPA 2005) কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর প্রকাশ করেছে, যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের জানা জরুরি বোধ করছি বিধায় বাংলায় ভাবানুবাদ করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। সাধারণের বোঝার সুবিধার্থে সহজ শব্দ ব্যবহারের যথাযথ চেষ্টা করেছি।

উল্লেখ্য, ইউএনএফপিএ হচ্ছে জাতিসংঘের একটি সংস্থা; যা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা নামে পরিচিত। এই সংস্থার একটি লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি শিশুর জন্ম যেন নিরাপদে হয় এবং প্রতিটি জীবনের সম্ভাবনা যেন পূর্ণ হয়। অর্থাৎ ইংরেজিতে জেন্ডার ইকুয়ালিটি এখানে প্রাধান্য পায়।

পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ বা জীবন সমান- এটাই মানবাধিকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কেউ বেশি পাবে, আর  কেউ কম পাবে- এমন ধারণা অস্বীকার করাই সমতা।

প্রথম প্রশ্ন:  লিঙ্গ বলতে কী বোঝায়?

লিঙ্গ শব্দটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক গুণাবলী এবং পুরুষ বা নারী হওয়ার সাথে সম্পর্কিত সুযোগগুলি বোঝায়। বেশিরভাগ সমাজে পুরুষ বা নারী হওয়া কেবল বিভিন্ন জৈবিক এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের বিষয় নয়। তাদের পোশাক কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, আচরণ করা উচিত বা কীভাবে কাজ করা উচিত সে সম্পর্কে পুরুষ এবং নারীরা বিভিন্ন প্রশ্নের ও আশার মুখোমুখি হন। সম্পর্ক যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে ধরা হয়; এবং তা যদি পরিবার, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাজের ক্ষেত্র হয়ে থাকে, তাহলে নারী ও পুরুষ উভয়েই উপযুক্ত প্রতিভা, গুণাবলী এবং আচরণের প্রতিফলন ঘটে, শুধু পুরুষের নয়। লিঙ্গ এমনভাবে যৌনতার থেকে পৃথক করা হয় যে এটি জৈবিকের চেয়ে প্রকৃতির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য এবং উপাদান, ধারণা, অন্য বিষয়গুলি- পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে ভূমিকা রাখে এবং  উভয়েরই উপর প্রত্যাশা তৈরি করে; তবে সময়ে সাথে সাথে সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয় । তবে লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যগুলি সামাজিকভাবে নির্মিত হয় এর অর্থ হল তারা এমনভাবে পরিবর্তিত হতে পারে যা একটি সমাজকে আরও ন্যায় ও ন্যায়সঙ্গত করে তুলতে পারে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন: জেন্ডার ইক্যুইটি (GENDER EQUITY), লিঙ্গ সমতা এবং নারী ক্ষমতায়ন কী?

জেন্ডার ইক্যুইটি হ’ল নারী এবং পুরুষদের সাথে ন্যায্য হওয়ার প্রক্রিয়া। ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য, কৌশলসমূহ এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাগুলি নারীদের ঐতিহাসিক এবং সামাজিক অসুবিধাগুলির পর্যবেক্ষণে ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে নারী এবং পুরুষেরা একই স্থানে অবস্থানে করে আর কাজ করতে বাধা না দেয়।

ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সমতা বাড়ে। লিঙ্গ সমতার জন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিকভাবে সম্মান প্রদর্শন, সুযোগ, সংস্থান এবং পুরষ্কারের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। যেখানে লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান সেখানে সাধারণত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থাগুলিতে নারীরা বঞ্চিত বা সুবিধাবঞ্চিত। সুতরাং লিঙ্গীয় সমতা প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল নারীর ক্ষমতায়ন, ভারসাম্যহীনতা চিহ্নিতকরণ ও প্রতিকারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা এবং নারীদের নিজের জীবন পরিচালনার জন্য আরও স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। লিঙ্গ সমতা মানে এই নয় যে, পুরুষ ও নারী একই হবে; কেবল সুযোগ ও জীবন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাদের যেন লিঙ্গের উপর নির্ভর করতে না হয় বা বাধাও না পড়ে। লিঙ্গীয় সাম্য অর্জনের জন্য ব্যক্তিগত এবং পাবলিক স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নারীর ক্ষমতায়নের প্রয়োজন, এবং নিশ্চিত করতে হবে যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থানগুলিতে পুরুষেরাই অধিষ্ঠিত নয়, বরং নারী এবং পুরুষ উভয়ই যেন উৎপাদনশীল এবং ব্যক্তি জীবনে সমান অংশীদার হিসাবে সম্পূর্ণরূপে অংশ নিতে পারে।

তৃতীয় প্রশ্ন: লিঙ্গ সমতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সমতা উন্নয়নের সাথে অন্তর্নিহিত এবং এটি সকলের জন্য মানবাধিকার উপলব্ধির অতীব জরুরি বিষয়। লিঙ্গ সমতার সামগ্রিক লক্ষ্য এমন একটি সমাজ- যেখানে নারী ও পুরুষ জীবনের সকল ক্ষেত্রে একই সুযোগ, অধিকার এবং দায়িত্বশীলতা উপভোগ করবে। উভয় লিঙ্গ নিজেদের প্রতিভা শক্তি এবং প্রভাবের বিতরণে সমানভাবে কাজের ভাগ করতে সক্ষম হলে পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে সমতা বিদ্যমান হবে; কাজের মাধ্যমে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্থিক স্বাধীনতার সমান সুযোগ থাকলে; শিক্ষায় সমান সুযোগ এবং ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ এবং প্রতিভা বিকাশের সুযোগ উপভোগ করলে; বাড়ি এবং শিশুদের জন্য দায়বদ্ধতা ভাগ পাবে। যা দুটি মানুষের সমান অবদানে কয়েকটি প্রাণ সম্মান মর্যাদা পাবে। এবং কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়িতে উভয়ই জবরদস্তি, ভয় দেখানো এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।

লিঙ্গ সমতা গুরুতর বা জটিল কারণ এটি নারী ও পুরুষদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে যা তাদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তাদের স্বামী বা স্ত্রী ও পরিবারগুলির ক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা অনেক সমাজের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। বিবাহের সময় বয়স, জন্মের সময়, গর্ভনিরোধের ব্যবহার এবং ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলি পরিত্যাগ ও সমালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত  গ্রহণে লিঙ্গ সমতার অর্জন লাভ করা সম্ভব।

চতুর্থ প্রশ্ন: লিঙ্গ সমতা কি পুরুষদের জন্য উদ্বেগজনক?

লিঙ্গ সমতার অর্জন মূলত পুরুষ এবং নারী উভয়ের পরিবর্তনকেই বোঝায়। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং বৃহত্তর সমাজসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকার ও দায়িত্বের পুনঃনির্ধারণের ভিত্তিতে আরও ন্যায়সঙ্গত সম্পর্ক তৈরি করা দরকার। সুতরাং পুরুষদের সামাজিক পরিচয়ের একটি দিক হিসাবে লিঙ্গকে অবহেলা না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতাকে প্রকৃতপক্ষে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, কারণ পুরুষের গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যগুলিকে আদর্শ হিসাবে বিবেচনা করে এবং নারীদের ক্ষেত্রে আদর্শের একটি প্রকরণ বা উপায় হিসাবে বিবেচনা করে।

তবে পুরুষদের জীবন যেমন লিঙ্গ দ্বারা জোরালোভাবে প্রভাবিত হয় তেমনি নারীদেরও। তবে সমাজ, ধর্ম তা স্বীকার করে না বা করতে চায় না।

পুরুষতন্ত্রের ধারণাগুলি পুরুষদের উপর একদিকে চাপ সৃষ্টি করে আর অন্যদিকে বীরত্ব হিসেবে দেখানো হয়। যার ফলে সমাজে পিতা, স্বামী বা পুত্র হিসাবে পুরুষদের প্রত্যাশা মাত্রাতিরিক্ত। পুরুষদের নারীদের প্রতি প্রেম ও যত্নশীল ভূমিকার চেয়ে তাদের পরিবারের বৈষয়িক চাহিদার প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য প্রায়শই প্রত্যাশা করা হয়। পরিবার এবং স্কুলগুলিতে সামাজিকীকরণের চিত্র উপস্থাপন করে তরুণ পুরুষদের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণের আচরণকে উৎসাহ দেয় এবং মিডিয়া স্টেরিওটাইপগুলির মাধ্যমে আরও জোরদার করা হয়। সুতরাং পুরুষেরা যেভাবে তাদের জীবনচক্র পরিচালনা করে থাকে তার ফলস্বরূপ নারীদের তুলনায় তারা আরও বেশি করে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে ওঠেন। এই ঝুঁকিগুলির মধ্যে দুর্ঘটনা, সহিংসতা, মিথ্যে বলা, পরকিয়া এবং নানা ধরণের মাদকসেবন, অ্যালকোহল গ্রহণ উল্লেখযোগ্য। শুধুমাত্র একদিকে কেন্দ্রভূত হওয়ার কারণে পুরুষেরা অন্যদিকে দৃষ্টি দিতে আগ্রহী হয় না। তবে তাদের উচিত যে, শিশুদের স্বাস্থ্য এবং তাদের নিজস্ব এবং তাদের পার্টনারদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উদাসীন। এই দায়িত্বগুলো চিহ্নিত করা এবং সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ আদানপ্রদান লিঙ্গের সমতা ও সাম্যতার ক্ষেত্রে জরুরি।

লিঙ্গ সমতা কেবল নারী ও পুরুষের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং প্রয়োজনের সাথেই সম্পর্কিত নয়, বরং তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কমূলক সম্পর্ক নিয়েও উদ্বিগ্ন।

মূল নথি: UNFPA (2005)