বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ, ধর্ষককে বিয়ে!
লীনা দিলরুবা শারমিন।। ধর্ষণের সংজ্ঞা মনে আছে আপনাদের? যদি কেউ অনুমতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে অথবা যৌন অনুপ্রবেশ করতে চেষ্টা করে তাহলে সেটা ধর্ষণ। শুভঙ্করের ফাঁকি এ সংজ্ঞায় উল্লেখ করা আছে, আপনার অমতে যোনিপথে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলে সেটিকে ধর্ষণ বলা হবে না। শিশ্ন বা ডিলডো দিলে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে উইকিপিডিয়ায় খুঁজে দেখুন!
গল্পের খাতিরে আমরা ধরে নেই- মেয়েটির নাম গোলাপ। বয়স ১৪ বছর। গোলাপ ক্লাস এইটে পড়ে। বাবা মা বাসায় না থাকলে ছোট চাচা গোলাপের যোনিপথে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়। গোলাপের নানীও তাকে যৌন হয়রানি করে। রাতে বুকে হাত দেয়, পায়জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়। বলুন তো আমাদের গোলাপ ধর্ষিত কি না?
বাংলাদেশে গোলাপের সংখ্যা কত জানেন? আমি জানি না! অনেক খুঁজেও কোনো সংখ্যা বা রিসার্চ পেলাম না। গোলাপরা কখনো থানায় গিয়ে মামলা করে না। বাড়িতে বলতে পারে না। চাইলেও নিজের চাচা বা নানীকে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে নিজের প্রতি এই অন্যায়টা থামাতে পারে না। গোলাপরা সহ্য করে। অনন্তকালের মতো মুহূর্ত আর মিনিটগুলো দাঁত চেপে পড়ে থাকে।
কখনো বাসে উঠেছেন, ভিড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন বা আপনার কি গুলিস্তান- ফার্মগেট যাওয়া আসা ছিল? অযাচিত স্পর্শগুলোর কথা ভুলতে পেরেছেন? অথচ এসবের বিরুদ্ধে কোনো আইন আছে কি না তা আমাদের কারোই জানা নেই! বিচারের আশা তো করছি-ই না!
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতোদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নতুন অধ্যাদেশে ৯(১) ধারাটি সংশোধন করে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনা হয়েছে। সেই সঙ্গে ৯/৪ ধারাতেও সংশোধন আনা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশে ১৯৭১ সালে গণধর্ষণের এমন বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটেছে, সে দেশে এতদিন লাগলো এই সামান্য আইনটি পাশ করতে? কত শতাংশ মানুষ বিচার পায়?
বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ বা উত্তরে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে তারও কিন্তু সমাজের ওপরের দিকে থাকা মানুষের সমান অধিকার। অন্তত কাগজে কলমে সংবিধানে তাই লেখা আছে। অথচ, বাংলার পক্ষপাতী টইটুম্বুর সমাজ তাদের ঘটনা জানার দিন থেকেই পরিবারটিকে হেয় প্রতিপন্ন করে। পড়ালেখা বন্ধ, বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ, সমাজের নানা নোংরা আদিরসাত্মক উক্তি…পরিণতি ভয়ংকর, এমনকি আত্মহত্যাও হতে পারে!
এই যে মানুষ ভাবে নারীর সম্মান তার যোনিতে, ধর্ষণ হলে সম্মান চলে যাবে তেমন কিছু মানুষের রক্ষা কবচও তার যোনিপথ। সম্প্রতি একটা ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ঝড় তুলেছে। যা বুঝলাম, এক বিখ্যাত ‘নারীবাদী’ বিবাহিত আপা প্রেমিকের সাথে শারীরিক সম্পর্কে গিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছেন এবং লোকে বলাবলি করছে এই আপা এখন ধর্ষককেই বিয়ে করতে চাইছেন। এই তথ্য তার এক সময়ের অতি কাছের বান্ধবী নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির পর এখন ফাঁস করে দিয়েছেন। এই কাছের বান্ধবী আবার ওই ধর্ষণ মামলার এক নাম্বার সাক্ষী এবং বন্ধুত্ব থাকাকালে তিনি এই সম্পর্ক খুবই আদর যত্ন দিয়ে সমর্থন করেছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক, সচ্ছল, সাবলীল মানুষ যখন নিজেকে নারীবাদী বলে ধর্ষককে বিয়ে করতে উঠেপড়ে লাগে তখন আমাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে সমস্যা হয়। মানুষ আমাদের বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ, টক শো সেলিব্রিটি না এমন অনেক মানুষ কিন্তু একটা রিকশায় উঠলেও গল্পচ্ছলে রিকশাওয়ালাকে বোঝায় কেন বাল্যবিয়ে খারাপ, কেন যৌতুক খারাপ! কেন স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা যাবে না।
শারীরিক সম্পর্ক করতে ইচ্ছা করলে করবেন, না করলে করবেন না। বিয়ের ব্যাপারটাও তাই। কিন্তু বিয়ে না করলে এক সময় উপভোগ করা যৌন সম্পর্ককে পুঁজি করে মামলা করার আগে দশবার চিন্তা করবেন। ওই যে বললাম, আপনাদের থেকে যদি ধর্ষককে বিয়ের শিক্ষা আসে তাহলে আমরা আর ধর্ষককে জেলে ঢোকানোর চেষ্টা করতে পারি না। মানুষ নারীবাদকে ভুলভাবে দেখে।
বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক অন্যায় তবে বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক উপভোগ করে এখন মামলা করে আবার তাকেই বিয়ে করতে চাওয়াটা কিন্তু প্রশংসনীয় না। আবার এক সময় পরকীয়াতে সহায়তা করে এখন ঝগড়া বলে তাকে সমাজে ছোট করে ফেলাটাও অন্তত কোনো নারীবাদী আচরণ না।
লম্বা পোশাক পরলে, বাচ্চা মানুষ করলে, রান্না করলে বা মাথায় কাপড় দিলেই মানুষ নারীবাদী হতে পারে না এমন প্রচুর লেখা দেখি। আমি তো বলি নারী হয়ে আরেক নারীর থেকে সুবিধা পাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে দুই হাত দেখে নেয়াটাই বরং নারীবাদীত্ব না। আপনি কী পরবেন, কী খাবেন, কার সাথে কীভাবে শুবেন এগুলা যদি একটু সামলে চলতে না পারেন তাহলে আই ওয়াশ দিয়ে সুবিধার জন্য অন্তত নারীবাদটা ব্যবহার করবেন না প্লিজ।
নারীবাদী মানেই পুরুষবিদ্বেষী না। আবার নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করা বা অসুবিধা হলেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়াও না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]