November 2, 2024
কলামফিচার ৩

জৈবিকতা ও নারীর প্রধান ভূমিকা

শাহরিয়ার সামস সামি।। শুধুই কি সন্তান উৎপাদন ও জৈবিক কর্মকাণ্ড  নারীর প্রধান কাজ? সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে জীব তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, শুধু এ নিরিখে কি নারী জন্ম এবং সত্তার প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয় জৈবিকতায়?

এ প্রশ্ন এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, এখনো, যখন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত  বা উর্ধ্বতন একজন নারীর শিক্ষা বা কর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠে বিয়ে বা এর পরবর্তী সন্তান উৎপাদন সংক্রান্ত আলোচনা। যেন নারীর জৈবিক জীবনের শাশ্বত প্রকাশই তার প্রধান কাজ; জৈবিক অর্জনের তুলনায় অন্য সকল অর্জনই তুলনামূলক গৌণ। হ্যাঁ, পুরুষকেও যেতে হয় এ প্রশ্নের ভিতর দিয়ে, তবে তা গৌণার্থে এবং সংখ্যায় খুবই অল্প ।

নারীর প্রধান কাজ সন্তান উৎপাদন কিনা, এ ডিসকোর্সের প্রধান উপাদান মানব সভ্যতার ইতিহাস ও জেন্ডারভিত্তিক পরিচয় ও ভূমিকা বিশ্লেষণ। সে সাথে নিরুপণ হওয়া জরুরি লিঙ্গ বৈষম্যহীন মানবসত্তার বিকাশের প্রয়োজনীয়তা।

কৃষি বিপ্লবের পরে কায়িকভাবে শক্তিশালী পুরুষ জৈবিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শ্রম দান করে সম্পদ আহরণ, উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। কৃষিকাজের বিকাশ ও অর্জিত সম্পদের প্রতুলতা মানুষকে পূর্বের যাযাবর বা বন্য জীবনের তুলনায় কিছু বাড়তি সময় দেয়। সে সময়ের সর্বাধিক ব্যবহারে পরিবর্তিত সমাজে কিছু চিন্তাশীল মানুষের আবির্ভাব ঘটে। নানাবিধ চিন্তা ও কর্মের সন্নিবেশের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতিকে জয় ও নিজেকে বিকশিত করে বা করার সুযোগ পায়। পুরুষ এর পূর্ণ সুযোগ নেয়, বিকশিত হয় এবং সমাজে তার কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।

প্রকৃতিগতভাবে নারী-পুরুষ লিঙ্গ সাম্যহীন। তাই কৃষি বিকাশে যে কায়িক শ্রম প্রয়োজন ছিল, জৈবিক সীমাবদ্ধতার কারণে নারী তার পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারেনি। নারীর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ  হয়ে যায় ঘরের আঙ্গিনায় অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন, লালন-পালন ও গৃহস্থালির কাজে। ফলশ্রুতিতে মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার চিরাচরিত আকাঙ্ক্ষার নিমিত্তে পুরুষের কায়িক শক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তার ক্রমবর্ধমান উপযোগিতা কর্তৃত্ববাদী  শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। জৈবিকতার বাইরেও সমাজ বিকাশে মূল ভূমিকা যা পুরুষের ক্ষমতাকে আরো নিষ্কন্টক করে তোলে। তদানুসারে, আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বা সমাজে নারীর প্রভাব হ্রাস পেয়ে ধীরে ধীরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে রূপ নেয়। দার্শনিক সিমোন ডি বোভোয়্যার মনে করেন, লিঙ্গসাম্যহীনতার এ জায়গায়ই নারীর পরাজয় সূচিত হয়।

ক্রম-বিকশিত সভ্যতায় নারীর মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা, কর্ম ও অর্জন আবর্তিত, বিবর্তিত ও বিলীন হয় পুরুষের আরোপিত আচার-ব্যবস্থা ও অর্জনে। নারীর মনুষ্য সত্তার বিকাশ ব্যহত হয়।তাছাড়া, সামাজিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি জৈবিকতার কর্তৃত্বও পুরুষ প্রতিষ্ঠা করে বা যা আগে থেকেই বিদ্যমান। জৈবিক কারণে কর্তৃত্ববাদী ও সার্বভৌম সত্তার পুরুষ নারীর জৈবিক ইচ্ছা, স্বাধীনতা ও  কর্মকাণ্ডের বিকাশ হতে দেয়নি, বরং শৃঙ্খলবদ্ধ করে রাখে। সাথে আরোপ করে বিভিন্ন ডগমা ও ট্যাবু। ‘সতীত্ব’ রক্ষা নামক ট্যাবুতে নারীর যোনির স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু পুরুষকে এরূপ কোন ট্যাবুর ভিতর দিয়ে যেতে হয় না।

সার্বিক বিবেচনায়, এহেন পরিস্থিতিতে ‘সহযোগী’ হওয়ার পরিবর্তে নারীর ভূমিকা হয়ে উঠে দাসীরূপ বা নিছক একটা রক্ত-মাংসের মানুষরূপী দেহ যার কাজ পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান উৎপাদন।

যুগের পর যুগ পিছিয়ে পড়া নারীর মনস্তাত্ত্বিক ও ভূমিকার বড় পরিবর্তন শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে বিভিন্ন পেশা, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে; সূচিত হয় নারীবাদ আন্দোলন। এর পিছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আধুনিক সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিতে জীবনযাত্রার আধুনিকায়ন; যুদ্ধ-বিগ্রহ,সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশলের ফলে সৃষ্ট সামজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক অসংগতির উত্তরণের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও তদানুসারে অংশগ্রহণ এবং জন্ম-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, ফলে প্রাপ্ত সময় নারীকে মনস্তাত্ত্বিক ও ভূমিকাগত এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। নারী নিজেকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে এবং আদতে নিজের পরিচয়, ভূমিকা, বিকাশ ও অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠে। নারীর-পুরুষের সমতাভিত্তিক সুযোগ, বিকাশ ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীর মানব-সত্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত, নারীবাদ আন্দোলনের মূল উপজীব্য। সিমোন ডি বোভোয়্যার ও তাঁর উত্তরসূরিরা নারীসত্তা, স্বাতন্ত্র্য, যৌন স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, আন্তঃসদৃশতার প্রশ্ন তুলে নারী জাগরণের উন্মীলন এবং আন্দোলনের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছিলেন এবং যা এখনো চলমান। আন্দোলন বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের পরিক্রমায় ইতিমধ্যে তিন ধাপ বা ওয়েভ পেরিয়ে ২০১২ সাল থেকে চতুর্থ ধাপে প্রবেশ করেছে। যদিও আন্দোলনকে সর্বাঙ্গীণভাবে সফল বলা যায় না, তবে অগ্রগতি ও সচেতনতা অনেকাংশেই দৃশ্যমান বা অনুভূত হয়।

আন্দোলনের কারণে সত্তা ও যৌনতার স্বাধীনতা, বিকাশ এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাভিত্তিক অংশগ্রহণ ঘটলেও উত্তর-আধুনিকতার এ পর্যায়েও নারীকে এখনও দেখা হয় সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালনের ক্ষেত্র হিসেবে। বাস্তবিকভাবে নারীর ভূমিকার পরিবর্তন হলেও, হাজার বছরের লালিত পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন হয়েছে, তা অসম। এ দৃষ্টিভঙ্গি ধারক ও বাহক শুধু পুরুষ নয়, নারীও বটে। নিজ সত্তা ও যৌনতার পরিচয়, স্বাধীনতা ও সমতাভিত্তিক বিকাশ ও ক্ষমতায়ন প্রশ্নে অজ্ঞতা বা সামান্য জ্ঞান অর্থাৎ প্রকৃত নারীবাদী শিক্ষা ও চেতনার অভাব এর কারণ। বেশিরভাগ নারী, এমনকি শিক্ষিতরা এখনও জানে না সে কে, সমাজে তার ভূমিকা এবং বিকাশের পন্থা। তার পরিচয়, ভূমিকা এবং বিকাশ পুরুষতন্ত্র দ্বারা এখনো আরোপিত; কখনো প্রবল স্বৈরতান্ত্রিকভাবে, কখনোবা malevolent paternalism এর মাধ্যমে। তারই ধারাবাহিকতায় পুরুষরা ফেমিনিস্ট হতে পারেন কিনা এ তর্কও গড়িয়েছে? কারো মতে পারে, কারো মতে পারে না; তবে প্রো-ফেমিনিস্ট হওয়া যেতে পারে।

বেশ আগে এঙ্গেলস বলেছিলেন, একটা সমাজের অবস্থা বুঝতে হলে সে সমাজের নারীদের অবস্থা বোঝা জরুরি। অর্থাৎ নারীর সার্বিক উত্তরণ প্রয়োজন। ফলে, যাহোক না কেন, নারীর ভূমিকা যেমন প্রকৃতিতে জৈবিকতার মাধ্যমে মানব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাতে জরুরি যা পুরুষেরও অন্যতম প্রধান ভূমিকা, তেমনি একটা পরিণত সুষম বা  ইউটোপিয়ান ধারণার সমাজ বিনির্মাণে নারী-পুরুষ উভয়ের লিঙ্গ বৈষম্যহীন পরিচয়, বিকাশ ও সমতাভিত্তিক সুষম অংশগ্রহণও নারীর অন্যতম প্রধান ভূমিকা। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা নয়। তাই, মানব-সত্তার সার্বিক পাঠ  ও প্রকৃত নারীবাদ চর্চার মাধ্যমে বিকশিত, সমতাভিত্তিক সুষম সমাজ কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]