November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

অস্থির সম্পর্ক কাটিয়ে উঠবেন কীভাবে !

হুরায়রা শিশির।। কিছু কিছু সম্পর্ক আছে পেন্ডুলামের মতো, নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মাঝে ব্যালেন্স করতে না পারলে  খুবই নাজুক হয়ে ওঠে, মুশকিল হয়ে যায়। এই রকম সম্পর্ক শেয়ার করার মত না কারণ এর নামকরণ করা মুশকিল। একটা চলমান সম্পর্কের মাঝে থেকে নতুন বা পুরানো সম্পর্ককে নিয়ে চলাটা খুব একটা সহজ নয় অনেক ক্ষেত্রেই।

অনেকেই ব্যালেন্স করতে না পেরে ছিটকে যায় স্বাভাবিক জীবন থেকে। সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই রকম সম্পর্ক এখন পৃথিবীর একুল-অকুল বহমান নদীর মত। হয়তো ঝিনাইদহে একজন বসে মন কেড়ে বা মন মিলিয়ে বসে আছেন সুইডেনের কারও সাথে। কারও স্ত্রী কারও স্বামী বা কোনো অবিবাহিত কারও সাথে কমপ্লিকেটেড সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। কোথায় কে কীভাবে কোনো সম্পর্কে জড়াচ্ছেন তা হয়তো নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না।

এই সম্পর্কগুলোর নাম দেয়া মুশকিল, জীবন থেকে বা মন থেকে মুছে ফেলা মুশকিল। জীবনে স্ট্যাবিলিটি কমে যায় যদি এই রকম সম্পর্ক বা মনের অবস্থা তৈরি হয় আর সেই মানুষটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন। আমাদের জীবনের সাথে অনেক মানুষ জড়িয়ে থাকেন। বাবা-মা, সন্তান, ভাইবোন, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন। অনেকক্ষেত্রেই চাইলেই কি মন যা বলে তাই করা যায় না মানা যায়? নাকি সুযোগ হয় সবার ?

খুব পার্সোনালিটি সম্পন্ন মানুষও বোকা হয়ে যায়, হঠাৎ করে নিজের চারপাশকে গুটিয়ে ফেলেন বা আউটবার্স্ট করেন কেউ কেউ। এতে তার সাথে সম্পর্কে জুড়ে থাকা অন্য মানুষগুলোর জীবনও যন্ত্রণাময় হয়ে যায়। কী করবেন? কী করা উচিত? কাকে বলবেন? বললে কী ভাববে? তার সাথে আর কেউ মিশবেন কিনা? কাকে কাকে বলে দেবেন ? কার কার কানে যেতে পারে? গেলে কী হবে? বাবা-মা কীভাবে নেবেন? বোনের হাসবেন্ড বা ভাইয়ের বউ কী কী বলবেন বোন-ভাইকে? সন্তান ? হায় হায় ও কী করবে? বখে যাবে? মেনে নেবে? সঙ্গী বদলানো আমাদের কালচারে বা সমাজে এত্ত সোজা না। প্রতিটা সম্পর্ক খারাপ হলেই নারীর দোষ- তাহলে?

তবে কি গোপনীয়তা রক্ষা করে এই সম্পর্কে থাকবেন? একদিন দুদিন? দেয়ালের কান আছে? সিসি ক্যামেরা আছে, ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জারও হ্যাক হয়- তো? বিয়ে করেই ফেললাম! এখন?  অনেকে ভাবেন, আমাদের সন্তানের কথা ভেবে কি সারা জীবন দিয়ে দেব? কী হবে কলেজে উঠলে কি ও আর আমাকে সময় দেবে? সেই একটাই জীবন তো! ভালো, আমি বুদ্ধিমান। আমি এখনই নতুন সম্পর্কের নাম দিয়ে- ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করে নিলাম।  এক জীবনে এত কষ্টের মানে হয়? না, হয় না!

এখন বড় যারা আছেন- রাগ করলেন বা মেনে নিলেন আর ছোট যারা আছেন তারা অবাক হলেন বা  শিখে নিলেন আগামী সুন্দর এবং সহজ তাদের জন্য। এখন?

সমস্যা তবে কার? কেন সবগুলো দিক বিবেচনা করা? কারণ পুরো অবস্থায় একমাত্র, কেবল মাত্র একমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কে বা কারা?

সন্তানেরা! তারপর! স্ত্রী বা পার্টনার! যদি তার মন বার বার প্রেমে পরার মত খুব বড় না হয় বা বয়সটা আর যায় না বিয়ের সাথে বা আবেগের জায়গায় ঘৃণা, অভিমান আর সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়। যারা অবিশ্বস্ত সঙ্গীর মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত হন তারা কি খুব সহজে আর কাউকে বিশ্বাস করে ঘুমাতে পারবেন নিশ্চিন্তে? তাই তারা অনেক সময় অবিবাহিত সঙ্গী খোঁজেনা। কারণ তার যেন তার মত তিক্ত অভিজ্ঞতা না থাকে, অনেকে আবার ভাবেন এমন  হলেই ভালো আমাকে ভাল বুঝবেন। কিন্তু কোনটা ভালো? কোথায় ভালো? কে ভালো ? পোড়া এই মানুষগুলোকে একটা জায়গায় আনতে, তাদেরকে একমত করতে আশেপাশের মানুষ বা নিজেকে অনেক সময় দিয়ে দিতে হয়- যা  অমূল্য।

আর যারা এমন করলেন তারাই কি খুব ভালো থাকেন? এক দিন তার মতিভ্রম কেটে যায়। আর থাকেনা মোহ। পৃথিবীর কষ্ট আর একজনকে কষ্ট দেয়া- খুব অনুশোচনা বা যন্ত্রনা দিতে থাকে। তখন কী হয়? খুব দ্রুত বার্ধক্য বা বিভিন্ন রকম অসুখ মনে বা মগজে বাসা বাধে। অবচেতন মন না বুঝে খুব বড় একটা মূল্য দিয়ে দেন।  সুখ তো সোনার হরিণ হয়ে কবে পালিয়েছে স্যাটেলাইট দিয়ে খুঁজেও আর না পেয়ে ডিপ্রেশনে পড়ে যান।

এই হলো পেন্ডুলামের মতো মনকে ব্যালেন্স বা  কন্ট্রোল না করতে পারা মনের লাইফ সাইকেল।

মন কি আর দেখা যায়, শাসন বা সুতোয় ধরে রাখব! এই রকম সম্পর্ক কিন্তু খুব পাওয়ারফুল সুনামি টাইপ। ভাংচুর বা ধ্বংস তার একমাত্র গোল। এর আগে কিন্তু একে থামানো এত্ত সোজা নয়। তবে সোজা কী?

সোজা হলো উপরের লেখাগুলো একটু পড়ে নিজের অবস্থানটার জন্য কোনটা ঠিক একটু বুদ্ধি করা বা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে নিজের কাউন্সেলিং করা বা বিশ্বস্ত বা প্রফেশনাল সহযোগিতা নেয়া। কারণ এই সময়ে সবাইকে শত্রু আর বোকা মনে হয়। কারণ তার কষ্ট বা অবস্থান তো কেউ বোঝেনা- খুবই ইলজিক্যাল অবস্থা তো। ঘরে দায়িত্ব- সন্তান ফেলে প্রেমে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে এইটা বোঝার মতো মানসিক অবস্থা যার আছে তার মনও ঘুরপাক খাচ্ছে এই অবস্থা ! তাহলে কী লাভ হল- কী হবে! জীবন তো একটাই। এই জীবন কি প্রেম কষ্টেই কাটাবেন?

মন অস্থির হলে, আগে নিজের অবস্থানটা পাশের মানুষের সাথে কমপেয়ার করুন (যদি না তিনিই আপনার মনের কষ্টের কারণ হয়, নিজেরদের ইস্যু থাকে, মাতাল বা লোভী পার্টনার, ধরে পিটাচ্ছেন, মিথ্যা বলছেন বা ডমিনেট করে শ্বাসরুদ্ধ করে মরার দশা না হয়। সেইটা অন্য আলোচনা, এই লেখার বিষয়বস্তু একদম সাধারণ দম্পতি বা সম্পর্ক নিয়ে।) আপনার পার্টনার একজন সাধারণ মানুষ, তার জায়গায় নিজেকে ফেলে দেখুন কেমন লাগছে! বিষয় একান্ত আপনার। কীভাবে সামলাচ্ছেন।

তিন প্রকার অবস্থা যা খুবই সাধারণ জ্ঞানের মত স্বচ্ছ।

খুবই ইমোশনাল মনকেই বললেন, এই জীবনে কী আছে! সময়টা আর সাথে মানুষটাই সব। জীবনে সব পাবো, তাকে তো আর পাবনা। বউ-বাচ্চা তো থাকলো, করে নিলাম বিয়ে।  বাচ্চা আর বউকে খরচ দেবো- যখন জীবনের শেষ সময় আসবে সিনেমার ১৫ নাম্বার রিল রইল, তাদের কাছে গিয়ে মাফ চাইবো, সব দিক পেলাম। ঝাউবন-আখিরাত থাকল। এর পর উনার কী হলো এইটা অন্য বিষয়। কিন্তু এই পরিবারের সন্তান বড় হয়ে সম্পর্কে জড়াতে ভয় পাবেন, মনটা অনিশ্চয়তায় পেয়ে বসবে। এবং স্ত্রী দুর্বল হলে এই জীবন মেনে নিয়ে চলল আর সবল হলে রেগে নিজেই কিংবা পরিবার বা বন্ধুরা বিয়ে দিলেন, নতুন সংসার! সন্তান কিন্তু  একদম একা এবং বিষন্ন।

আর একদল, ডিপ্রেশনে গিয়ে মাতাল বা নেশাগ্রস্থ-  “মার ডালা, মার ডালা”  বা সবার উপরে রাগ করে বসলেন। সবার জন্য এই ঝুলন্ত সম্পর্ককে নাম দিতে পারছেন না, হয় সুইসাইড করে বা হার্ট অ্যাটাচ করে বসলেন শেষে! ইদানিং এমন খবর অহরহ আসছে।

আর একদল, যারা একটু বুদ্ধিমান বা ভীতু- সমাজ বা সংসারারের ভয়ে, কাজে এত্ত মনোযোগ দিলেন প্রমোশন হলো, নিজের অবস্থার পরিবর্তন হলো- টাকাপয়সা বাড়লো, ফ্ল্যাট হলো, সম্মান থাকলো- মতিভ্রমের  সময়টা কাজে ব্যস্ত থেকে পার করলেন। সব কুল থাকলো, মাঝে মাঝে কফি খেতে বা পথে  জার্নিতে মনে করে মনটা হালকা হলো, কাউকে একটু ভালো লেগেছিলো, একটু দীর্ঘশ্বাস! কিন্তু বিশ্বাস, সংসার, দায়িত্ব তো অনেক বড় , চারপাশের প্রেশার নেয়ার অবস্থা সবার থাকেনা! প্রকাণ্ড বাস্তববাদী মানুষ।

জীবনের এই পরিস্থিতিতে, খুব ইমোশনাল বা কাঠখোট্টা না হয়ে সচেতন হওয়া জরুরি, মনের এই দোদুল্যমান অবস্থাকে সামাল দিতে একেক জনকে একেক রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় আবেগকে। আর খুব ভালো বন্ধু থাকা বা পরিবারে কাছের মানুষ থাকা খুবই জরুরি প্রতিটা মানুষের জন্য। তা না হলে এমন কাউকে খুঁজে নিন বা পেশাদার কনসালটেন্সি সার্ভিস নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে ফেলুন। জীবন সুন্দর, কিন্তু তাকে সুন্দর করে না তৈরি করতে পারলে এটা ভয়াবহ কষ্টের।

 

হুরায়রা শিশির: বিয়ে বিষয়ক কনসালটেন্ট

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]