সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংক্রান্ত আইন নিয়ে ফালতু তর্ক
সাব্বির এ মুকীম।। প্রতি বছরের ৮ই মার্চ নারী দিবস আসলেই সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে প্রলাপ শুরু হয়। সেসব প্রলাপগুলোর মধ্যে প্রধানতম দুটি ধরণ নিয়ে আলাপ করবো। এক ধরনের আলাপে বলা হয় সম্পত্তিতে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার হতে আইন দ্বারা বঞ্চিত করা হয়েছে। আরেকটা আলাপ হলো ইসলামে যদিও ছেলে মেয়ের দ্বিগুন পায়, কিন্তু ভালো করে যাচাই করলে দেখা যাবে বরং নানা ক্যাটাগরিতে মেয়েদেরকেই আনুপাতিক হারে সম্পত্তিতে বেশি দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান কাঠামোয় দুইটা আলাপ ফালতু কথা। বাস্তবতা হল সমাজের ক্ষমতা কাঠামোর আলোয় সম্পত্তিতে নারীদের আসলে কোনও অধিকারই নেই। এমনকি নারী নিজেও স্বীকার করে প্রায়শই নিজের রোজগারও নারীর নিয়ন্ত্রণ অনুপাতে নগণ্য। সে বাস্তবতায় উল্লেখিত দুই রকমের ফালতু আলাপ বরং সম্পত্তিতে নারীদের বঞ্চনাকেই আরও প্রলম্বিত করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের সভ্যতার ইতিহাসের যমজ ভাই। আমাদের সভ্যতার শুরুই হয়েছে সম্পত্তির ইতিহাসের দিয়ে। আবার সম্পত্তির ইতিহাস শুরু হয় নারীকে বঞ্চিত করে। ব্যাপক রকম স্থুলভাবে বয়ান করলে এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া যায়- মানুষের সম্পত্তি ধারণার উৎপত্তি হয়েছে খাদ্য সংগ্রহ করে করে তার জমিয়ে রাখার অভ্যাস থেকে। আদিম মানব সমাজে জমানো খাদ্যের উপর সে ব্যক্তিরই বেশি অনুপাতে অধিকার ছিল যে ব্যক্তি খাদ্য সংগ্রহে বেশি ভূমিকা রাখত, সময় দিতো, শ্রম ব্যয় করতো। খাদ্য সংগ্রহের অভ্যাস ছিল খুব সম্ভবত প্রধানত দুই রকম- প্রাণী শিকার আর যা প্রকৃতির চাষ করা ফসল তা সংগ্রহ। খাদ্য সংগ্রহে যে বেশি পারঙ্গম ও সফল, জমা খাদ্যে তার বেশি অধিকার। কিন্তু নারী যখন সন্তান সম্ভবা হতো তখন সে আর খাদ্য সংগ্রহ কর্মে ততটা সক্রিয় থাকতে পারত না। এভাবেই সামষ্টিকভাবে খাদ্য মজুদে নারীর স্বত্বাধিকারের অনুপাত কমতে থাকে। কমতে কমতে এমন এক পর্যায়ে আসে ইতিহাসের স্তরে যে, নারীকে সম্পত্তিতে স্বত্বহীন ভাবা শুরু হয়। এই সংগ্রহে অক্ষম নারীই তার সে অবকাশকালে সক্রিয়তার ফলাফলস্বরূপ মানব কৃষিকাজের পত্তন হলেও নারী স্বত্বহীনতা গণমনস্তত্ত্ব রয়েই যায়। এভাবেই আদিকাল হতে সম্পত্তি থেকে নারী বঞ্চিত হয়েই চলে। ইতিহাসের সময়ের মাপকাঠিতে উপমহাদেশের ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মে প্রথম স্ত্রীধন হিসেবে, বাস্তবে না হলেও তত্ত্বে, নারীর কিছু সম্পত্তির স্বত্বাধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। এরপর ইসলাম ধর্ম একেবারে শূন্য অধিকারের অবস্থা থেকে নারীকে পুরুষের অর্ধেক অনুপাতে সম্পত্তির অধিকার দেয়, সেটাও তত্ত্বীয় সীমাতেই।
একুশ শতকের বাস্তবতা হলো ওই অর্ধেকটুকুও নারী পায় নাই বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেই অর্ধেক অনুপাতের নারীর পাওনা নেয়াকেও নারীদেরকেই স্বয়ং পাপ বলে অনুভব করানো হয়। সে প্রেক্ষিতে শুরুতে উল্লেখিত দুই রকমের ফালতু কথার রূপ উন্মোচন করার চেষ্টাই এ আলাপে করেছি।
প্রথম ফালতু কথাটা হলো- আইনে সম্পত্তির নারী-পুরুষ সমান অধিকার নাই। নির্জলা মিথ্যা কথা। কথাটা সত্যের কাছাকাছি হতো যদি এভাবে বলা হতো- মুসলিম আইনে সম্পত্তির সমান অধিকার নাই, হিন্দু আইনে সম্পত্তির সমান অধিকার নাই, বৌদ্ধ আইনে সম্পত্তির সমান অধিকার নাই। কিন্তু এক লহমায় বলা পুরো আইনের কাঠোমোর কোনো অংশেই সমান অধিকার নেই- বাক্যটা একটা সূক্ষ্ম ও স্থূল দুই দৃষ্টিতেই অপ্রকৃত। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ভুল, কারণ খ্রিস্টান আইনে সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া আছে এবং খ্রিস্টান আইনের চর্চা বাংলাদেশ আছে। তাই আইনে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার দেওয়া হয় নাই কথাটা শুধু খ্রিস্টান আইনের অস্তিত্বর কারণে ভুল প্রমাণ হয়। কথাটা স্থূল দৃষ্টিতেও অপ্রকৃত কথা, বাংলাদেশে সাকজেশন অ্যাক্ট ১৯২৫ বলবৎ আছে। সাকজেশন অ্যাক্ট ১৯২৫ এর পঞ্চম ভাগ এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পত্তি বন্টনের হার সংক্রান্ত বিধান প্রদান করা হয়েছে। ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে যে 37. Where the intestate has left surviving him a child or children, but no more remote lineal descendant through a deceased child, the property shall belong to his surviving child, if there is only one, or shall be equally divided among all his surviving children. তথা ছেলে হোক মেয়ে হোক সম্পত্তিতে সবার সমান ভাগ, সমান অনুপাতে অংশ পাবে- ছেলে যেটুকু পাবে, মেয়েও সেটুকু পাবে।
সাকজেশন অ্যাক্ট ১৯২৫ এর ৩৭ ধারা সুবিধা নিতে হলে সে আইনের ২৯ ধারার শর্তপূরণ করতে হবে। কী সে শর্ত? সে শর্ত হলো যার সম্পত্তির ভাগ করা হবে তিনি হিন্দু হতে পারবেন না, মুসলিম হতে পারবেন না, বৌদ্ধ হতে পারবেন না, শিখ হতে পারবেন না, জৈন হতে পারবেন না বা পার্শি হতে পারবেন না। উদাহণস্বরূপ লিখি, নিজেকে হিন্দু দাবি করা মানে হিন্দু আইনের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া, নিজেকে মুসলিম দাবি করা মানে মুসলিম আইনের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া। একজন বিদেশি যখন বাংলাদেশের ভিসা নেয় তখন সে বাংলাদেশের আইনের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েই বাংলাদেশের ভিসা নেয়। বসবাস করতে বাংলাদেশি আইনের কর্তৃত্ব নেয়ার ফলে সে বাংলাদেশের আইন মানতে বাধ্য। তেমনি একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবি করলে সে মুসলিম আইনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য, একজন ব্যক্তি নিজেকে বৌদ্ধ দাবি করলে সে বৌদ্ধ আইনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য।
হিন্দু-মুসলিমের আইনগুলোর ভিতরগত কাঠামো ডিভাইন হতে প্রাপ্ত। জুরিসপ্রুডেন্স এগুলোকে ডিভাইন ল বা মানবোত্তর আইন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। মানবোত্তর আইন বলে মানুষ চাইলেই এ আইনগুলো পরিবর্তন করার ম্যান্ডেট পায় নাই। তাই এসব আইনের প্রায় সব বিধানই অপরিবর্তনীয়। মানবসৃষ্ট তথা সেকুলার আইনেও এমন পরিবর্তনঅযোগ্য বিধান আছে যার গালভারি বেসিক স্ট্রাকচার। ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, বিভিন্ন সময়ের স্ব স্ব দেশের সুপ্রিমকোর্টগুলো থেকে ঘোষণা করা হয়েছে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার পরিবর্তন করা যাবে না। হিন্দু আইনে, মুসলিম আইনে ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিধানগুলো বেসিক স্ট্রাকচার নীতির সমান্তরাল মর্যাদায় আসীন। তাই এসব আইনে পরিবর্তন আনার জিগির তোলা দ্বৈত নীতি ফলশ্রুতিতে বাকোয়াজ বৈ কিছু নয়। যেহেতু আমাদের হাতে সাকসেশন অ্যাক্ট নামের বিকল্প বিধান আছে, সাকসেশন অ্যাক্ট এর শরণ নিতে হলে আপাতদৃষ্টিতে নিজের আচরিত ধর্ম দাপ্তরিকভাবে ত্যাগ করতে হবে। যে ধর্মকে দাপ্তরিক ভাবে ত্যাগ করার সাহস বা সামর্থ্য নাই সে ধর্মের মৌলিক বিধান পরিবর্তন করতে চাওয়া এক ধরনের বিগট্রি। এই ধরনের চিন্তা মূলত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফ্যালাসি। বিদ্যমান বিকল্পের দিকে নজর না দিয়ে বিদ্যমান কাঠামোতে অসম্ভব পরিবর্তন চাওয়াই হলো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফ্যালাসি। ফ্যালাসি মানে হল কুযুক্তি ।
যেখানে সাকসেশন অ্যাক্ট এর ৩৭ ধারার মতো বিকল্প আইন আছে সেখানে পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা আয়াত পরিবর্তনের, পবিত্র বেদের বিধান পরিবর্তনের ডাক দেওয়া বাতুলতা এবং এঁড়েপনা।
এবার যাই দ্বিতীয় ফালতু কথায়- কিছু কিছু ইসলামিক আইনে বিশেষজ্ঞ বলে দাবিকারীরা বলেন যদিও ইসলামিক আইনে ছেলেদেরকে মেয়েদের দ্বিগুন দেওয়া হয়েছে তবে মেয়েদের এতো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেয়া হয়েছে যেভাবে ছেলেদের দেয়া হয় নাই। সম্পূর্ণ ফালতু ও সর্বৈব মিথ্যা কথা। অথরিয়াল ফ্যালাসি আর মুভিং গোলপোস্ট ফ্যালাসির খিচুড়ি পাকিয়ে এই ফালতু দাবি তোলা হয়। কোনো বিষয়ে মতামত দেয়ার সময় মতামত প্রদানকারী ঐ বিষয়ের কিছু দিকে আলোকপাত করে আর কিছু দিক গোপন রাখে- যেটুকু বললে সুবিধা সেটুকুই বললাম আর যেটুকু বললে অসুবিধা সেটুকু গোপন রাখলাম নিজের সুবিধামতো, এটাই অথরিয়াল ফ্যালাসি। আবার একবার এক যুক্তি গ্রহণ করে সুবিধা নিয়ে আবার পরে অসুবিধার ক্ষেত্রে সেই একই যুক্তি খারিজ করার ফ্যালাসিকে বলে মুভিং গোলপোস্ট ফ্যালাসি।
মেয়েদের মতো যে ছেলেদেরও দেয়া হয়েছে তা গোপন করা অথরিয়াল ফ্যালাসি আর কেবল মেয়েদের পাওয়াটাকে হাইলাইট করাকে মুভিং গোলপোস্ট ফ্যালাসির প্রয়োগ বলা যায়।
এই দ্বিতীয় ফালতু কথা বলনেওয়ালারা এমনভাবে বলে যে ইসলামিক আইনে সব শ্রেণির নারীদের অধিকার দেওয়া আছে, কিন্তু এটা বলে না যে যে নারীকে অধিকার দেয়া হয়েছে সে সে প্রত্যেকটি নারী সংশ্লিষ্ট শ্রেণির পুরুষকেও অধিকার দেয়া আছে। কিছু নজির টানি-
(১) জীবিত স্ত্রীদের মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দেওয়া আছে কিন্তু জীবিত স্বামীকেও মৃত স্ত্রীর সম্পত্তিতে অধিকার দেয়া আছে এটা বলা হয় না। সন্তান থাকলে জীবিত স্বামী ২৫% পাবে আর জীবিত স্ত্রী ১২.৫০%, কোন সন্তান না থাকলে জীবিত স্বামী ৫০% পাবে আর জীবিত স্ত্রী ২৫%। তার মানে সবসময় স্বামীর অনুপাত স্ত্রীর দ্বিগুণ।
(২) ইসলামে মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে মাকে অধিকার দেয়া আছে। কিন্তু বাবাকেও যে মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা কিন্তু বলা হয় না। মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে মৃত ব্যক্তির বাবা-মা সমান সমান ১৬.৬৭% করে পেলেও সন্তান না থাকলে মৃত ব্যক্তির মা ৩৩.৩৪% পাবে আর বাবা কমসে কম ৬৬.৬৭% পায়।
এই করে এমন কোনো ক্যাটাগরি নাই যে ক্যাটাগরির নারী প্রাপক হলে সে ক্যাটাগরির পুরুষ প্রাপক হয় না। মেয়ে পেলে ছেলেও পায়, বোন পেলে ভাইও পায়, দাদী পেলে দাদাও পায়, সৎ বোন পেলে সৎ ভাইও পায়, নাতনি পেলে নাতিও পায়। মোদ্দাকথা সম্পর্কে যে শ্রেণিতে কোনো নারী প্রাপক হয় সে শ্রেণিতে অবশ্যই পুরুষও প্রাপক হয়। একটা শ্রেণিতে নারীর তুলনায় আনুপাতিক হারে সমশ্রেণি পুরুষ সবসময় বেশি পায় যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ।
ইসলামে বেদাত বলে একটা কনসেপ্ট আছে। যা ইসলামে নাই তাকে ইসলামি বলে চালানোকে বেদাত বলে। ইসলামে নারীদের অনেক দেয়া হয়েছে- এটা বরং বেদাত কনসেপ্টকেই আকর্ষণ করে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার দাবি রাখে। এই দাবির ফলে বরং ইসলামের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য তথা একবারেই বঞ্চিত নারীর জন্য আইয়ামে জাহিলিয়াত হিসেবে চিহ্নিত সময়ে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি চাপা পড়ে যায়।
পরিশেষের বয়ান-ফালতু কথা সুন্দর করে বলে জনপ্রিয় হওয়া যায় কিন্তু সমস্যার সমাধান তো হয়ই না বরং সমস্যাটা আরো প্রকট হয়। অংকের ভগ্নাংশে সমতা না চেয়ে কর্মে কর্মে মূল্যায়নে সমমর্যাদার প্রতিষ্ঠা করা হলে অধিকারের সাম্য আপনা আপনি তৈরি হয়। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে আঁতুড়ঘর চিত্রায়ন বলে দেয় আঁতুড়ঘরের অবমূল্যায়নের মাত্রা কীরকম। আঁতুড়ঘরের এমন মূল্যায়ন চিন্তা করে তথা সন্তান জন্মদান কাজ কে এমন ত্যাজ্য হিসেবে বিবেচনায় না রেখে, বরং খাদ্য সংগ্রহের মত পবিত্র কাজকে হিসেবে গণ্য করলে কর্মে কর্মে সমমর্যাদা তৈরি হয়। কর্মে কর্মে সমমর্যাদা শুধু সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। মর্যাদা নিরাপদ করার আকাঙ্ক্ষায় আইনের সৃজন হয়েছে। মর্যাদা কখোনোই আপেক্ষিক তথা ব্যক্তিনির্ভর রাখা মর্যাদাকর নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]