September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষতান্ত্রিক বিবাহে ভালোবাসার অবস্থান

নন্দিতা সিনহা।। কয়েকদিন আগেই গেলো ভালোবাসা দিবস। বেশ ঘটা করেই সর্বস্তরের মানুষ পালন করেছে ভালোবাসার এই দিবসকে। ভালোবেসে নরনারী হয়তো একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সারাজীবন পাশে থাকার, ভালোবাসার। অবিবাহিতরাও হয়তো বিয়ে করে সংসার ও জীবন সাজানোর এক বর্ণিল স্বপ্ন দেখেছেন। সাধরণত পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবেই হোক আর জৈবিক কারণেই হোক, আমরা এমন এক ধারণা মননে ও মস্তিষ্কে পোষণ করে রাখি যে ভালোবাসার শেষ পরিণতি বিয়েই। আসলেই কি তাই!

আজকাল প্রেম/ভালোবাসার সম্পর্কে থাকাটাই যেন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছ। এর বাইরে থাকা যেন দলছুটের মতো এক ব্যাপার। তাই তরুণ তরুণী বা নারী পুরুষের কেউই একক বা সিঙ্গেল থাকতে চায় না, সবাই মনে মনে অপর একজন মানুষকে প্রত্যাশা করে। এই যে প্রত্যাশা, এটার সবটুকুকে যদি বলা হয় ভালোবাসার প্রত্যাশা তবে হয়তো তা পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। এর অনেকটাই লোক দেখানো বলা যায়।

আমার আশেপাশে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়দের  সবার সঙ্গী আছে, আমার নেই, আমি একা দলছুট হয়ে পড়েছি- এমন একটা মনমানসিকতা কাজ করে। আমার পরিচিত অনেক ছেলেই প্রায় অনুরোধ করে থাকে যেন তাদের একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে দেই। এই বিষয়টি একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে এখানে  আসন্ন অগঠিত সম্পর্কটার গুরত্ব কীসে, নিজের মনস্তাত্ত্বিক সাড়া নাকি সম্পর্ক গঠনের প্রয়োজনের তাগিদ।

পৃথিবীতে মানবজীবনের এক সুন্দরতম স্বর্গীয় অনুভুতি ভালোবাসা। ভালোবাসার সাথে দয়া, উদারতা, নৈতিকতা, সহমর্মিতার মতো মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলোও মানুষের মননে প্রবেশ করে, প্রকাশ পায়, বিকশিত হয়। ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ শর্তহীন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয় বা বৈশিষ্ট্য তেমন প্রভাব সাধারণত ফেলতে পারে না। ভালোবাসার আলাদা কোনো রূপরেখা নেই, হোক সেটা পিতামাতা ও সন্তানের, ভাই ও বোনের, বন্ধুবান্ধবদের, স্বামী ও স্ত্রীর বা সংগীর, অপরিচিত বা সল্পপরিচিত কারও। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সুখে নিজেও সুখ অনুভব করে, কষ্টে নিজেও কষ্টে পায়, বিপদে পাশে দাঁড়ায়। মানুষ যেই হোক, এখানে ভালোবাসাটাই মূখ্য ভুমিকা পালন করে। সব সম্পর্কের মূল ভিত্তিই ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া এসব সম্পর্ক অর্থহীন।

আমাদের সমাজে ভালোবেসে বিয়ে করাটাই সর্বোচ্চ পরিনতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।বিয়ের মাধ্যমে দুজন মানুষের জীবন এক হওয়ার কথা আমরা সবসময়ই শুনে এসেছি। বলা হয়ে থাকে এর মাধ্যমে একজনের উপর অপরজনের অধিকার তৈরি হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ পুরুষ, এমনকি নারীও বিবাহ প্রথাকে শুধুমাত্র যৌনতাকে সামাজিকভাবে অনুমোদিত করার একটা চুক্তি বা উপায় ভাবে। আমি আমার ছেলেবন্ধুগুলোর সাথে এমন বিষয় নিয়ে কথা চলাকালীন তাদের এটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে বিয়েতে যৌনতাই মূখ্য বিষয় নয়।

মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে  তার জৈবিক ও মানসিক এই দুই চাহিদাই আছে। পৃথিবীতে মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য তার চারপাশের মানুষ ও প্রতিকূল পরিবেশের সাথে প্রতিনিয়ত প্রাণান্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, এমনকি নিজের সাথেও। এই জীবনব্যপী চলমান পুরো সময়টাতে একজন সঙ্গীর চরম প্রয়োজনবোধ হয়, যাকে বিশ্বাস করে ভালোবাসা যায়, যার প্রতি এই বিশ্বাসটা রাখা যায় যে- যেকোনো অবস্থাতেও মানুষটা পাশে এসে দাঁড়াবে, যার কাছে বিব্ধস্ত মনটাকে ও নিজেকে সঁপে দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হওয়া যাবে।

যদিও মানুষকে জীবনের কঠিন সময় একাই সামলে উঠতে হয় কিন্ত একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী সেই কঠিন সময়কে অনেকাংশেই সহজ করে তোলেন। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিবাহ হলো এক অসম চুক্তি। এখানে বিয়ে হলো পুঁজিবাদী শ্রমিকদের দিয়ে সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে আরও বেশিসংখ্যক শ্রমিক উৎপাদন করে পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থ চরিতার্থ করার এক পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। সুতরাং এখানে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর চেয়ে প্রয়োজনীয়তাই প্রাধান্য লাভ করে। তাই অধিকাংশ মানুষই সম্পর্কে বিশ্বস্ত সংগীকে পাওয়ার চেয়ে এক শ্রেণির শ্রমিকের সেবা পেতে ও আরও বেশিসংখ্যক শ্রমিক উৎপাদনে বেশি আগ্রহী। সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাদের বৃদ্ধ বয়সে জীবনধারণের নিশ্চয়তার জন্য সন্তান (বিশেষ করে পুত্রসন্তান) কামনা করে, এটি এর একটি উদাহরণ। অতএব এখানে বুঝতেই পারা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে অপর জনের প্রতি ভালোবাসা জিনিসটা আরো বেশি অপশনাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনে। আর যাদের মধ্যে নিঃস্বার্থ ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ভালোবাসা যা একটু আছে সেটাও মার খাচ্ছে নিদারুনভাবে।

এই বিয়ে ও ভালোবাসার ভেলকিতে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী। পুরুষতান্ত্রিক কায়দায় সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করে রাখা এই সমাজে আজও নারীকে নিজের সেবা ও দেহ দিয়ে নিজের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হয় এই বিয়ে নামক চুক্তির মাধ্যমে। জন স্টুয়ার্ট মিল সেই সত্যকে অনুধাবন করেই বলেছেন,’পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর জন্য বিয়ে ছাড়া সমস্ত রাস্তাই বন্ধ করে রেখেছে। তাই নারীকে সেই কানাগলিতেই ঢুকতে হয়।’ আজও অবস্থা প্রায় একই। যদিও পথ থাকলেও তা পুরুষের পথের তুলনায় কয়েকগুন বেশি কণ্টকাকীর্ণ। আর লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে মানুষের মধ্য থেকে ভালোবাসা, দয়া, মমতার জায়গাটা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে এখানে স্বার্থবাদ নিষ্ঠুরতা ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার মত বৈশিষ্ট্যগুলো জায়গা নিতে শুরু করেছে, যা দৈনিক খবরের পাতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সহজেই অনুমেয়। সুতরাং এখানে আর্থসামাজিকভাবে ক্ষমতাবান পুরুষ সঙ্গীর জীবনে সেসব দিক থেকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল নারীর ভালোবাসার গুরুত্ব কতটুকু সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। কিন্তু নারী তার প্রতিটি শিরা উপশিরায় যুগ যুগ ধরে বহন করে আসা পুরুষতান্ত্রিক একপাক্ষিক শিক্ষার বদৌলতে আজও তার নিজের সমস্যাগুলোর মূলে পৌঁছাতে পারেনি। নারী তার মনে ও মস্তিষ্কে নানান অযৌক্তিক ভাবনা আজও লালন করে চলে। পুরুষের তুলনায় নারী জৈবিকভাবে দুর্বল, পতিধর্ম পতিকর্ম পতি পরমপূজ্য। নারী সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে পুরুষসঙ্গীকে অন্য নারীতে আসক্ত হওয়া ঠেকাবেন, বিবাহ পবিত্র বন্ধন যা ভাঙতে দেওয়া যাবে না, জীবন দিয়ে হলেও টিকিয়ে রাখতে হবে- এমন ধারণাগুলো, যার বৈজ্ঞানিক ও মনোবৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তিই নেই, এমন চিন্তাধারাগুলো নারীরা পুরুষদের চাইতেও বেশি করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

আমাদের সমাজের পরিবারগুলোর দিকে তাকালে সুস্পষ্টভাবে  বিবাহিত নারীর ভয়ানক জীবনের চিত্র ফুটে ওঠে। কীভাবে অধিকাংশ নারী ভালোবাসাহীন এক একটি সম্পর্ক বয়ে বেড়ায়! এই অসম, শ্রেণিবিদ্বেষ নিয়ে গড়া ওঠা সমাজব্যবস্থায় নারীর নিজসত্তাকেই বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। সমাজ প্রতিটি নারীকেই যেমন তেমনভাবে ধরে এনে স্টুয়ার্ট মিলের সেই কানাগলিতে ঢুকিয়েই তাদের মহাদায়িত্ব সেরে নেয়। নারী সেই বিবাহ নামক কানাগলিতে বাঁচুক কি শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করে দম বন্ধ হয়ে মরুক কি খুন হয়ে যাক, সেটা আর কেউ মুখ বাড়িয়ে দেখতে আসবেনা। এখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তথাকথিত মান সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটাই অনেক বেশি। ভালোবাসার প্রত্যাশা করাটাও বিলাসিতা। এখানে তসলিমা নাসরিনের ‘ঠকতেই হবে ভালোবেসে যদি করো গোপনে কোনো কিছুর প্রত্যাশা, এমনকি ভালোবাসা পাবারও আশা’- এই বাক্যগুলো বড় বেশি সত্য।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]