November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সমকামী মস্তিষ্কের গঠন এবং প্রাকৃতিক পার্থোজেনেসিস

মাহমুদুল হাসান উৎস।। সমকাম অন্তর্গত কোনো জিন না পাওয়া যাওয়ায় একদল সমকামকে অপ্রাকৃতিক এবং অস্পৃশ্য রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু সমকাম অন্তর্গত কোনো জিন না পাওয়া গেলেও সমকামী এবং বিষমকামী মানুষের মস্তিষ্কে প্রবল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই পার্থক্য শুধুমাত্র সমকামী মানুষ নয়, বরং সমকামী যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেও লক্ষনীয়। সমকামী ইঁদুর, ভেড়া, বানর, হাঙর, গিরগিটির ক্ষেত্রেও মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস-এর ভিন্ন গঠন পাওয়া যায়।

হাইপোথ্যালামাস-এর সাথে যৌন প্রবৃত্তির নিবিড় সম্পর্ক আছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাস (INAH)। আবার এই অঞ্চলের প্রতিটা পার্টকে বিভিন্ন নাম্বারে ভাগ করা হয়- INAH-1, INAH-2, INAH-3, INAH-4। আমরা জানি যে, মেয়েদের মস্তিষ্কের চাইতে ছেলেদের মস্তিষ্ক অন্তত ১০০ গ্রাম বড়। আবার সেইসাথে ছেলেদের মস্তিষ্কের তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাসের আকার মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ বড়।

এবার আসা যাক, সমকামী মানুষের হাইপোথ্যালামাস নিয়ে। এক্ষেত্রে, তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র-এর আকার বিষমকামী পুরুষদের চাইতে সমকামী পুরুষদের দুই বা তিনগুণ ছোট। মানে হচ্ছে, সমকামী পুরুষ আর বিষমকামী মহিলার তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র-এর সাইজ সমান। এখন বলা যেতে পারে বটম সমকামী পুরুষেরা ঠিক একারণেই মেয়েদের মতো আচরণ করে। আপনারা রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে অনেক ছেলেকে মেয়েলী বলে বুলিয়িং করেন, তার জন্যে ছেলেটার কোনো দোষ থাকে না। প্রাকৃতিকভাবেই তার মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস-এর তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র বিষমকামী মহিলাদের সমান থাকে। সুতরাং নিজেকে শুধরে নিন।

হাইপোথ্যালামাস-এর গঠন নিয়ে আলোচনায় আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা জানি, সমকামী মানুষের মধ্যে সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটির প্রকারণে তিন ভাগ আছে। যেমন- টপ, বটম এবং ভার্সেটাইল। ভার্সেটাইল এবং বটম নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ তাদের মধ্যে মেয়েলী আচরণ আছে। সমস্যা হচ্ছে টপ পুরুষ নিয়ে। সমকামী টপ পুরুষ যেহেতু পুরুষালী আচরণ করে, পুরুষের উপরেই আকৃষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে তাদের হাইপোথ্যালামাস কেমন হবে? যেহেতু, আচরণগত পরিবর্তনে যৌন প্রবৃত্তিরও পরিবর্তন ঘটে সেহেতু এখানে চাপা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা দায়ী। পার্টনারের অভাবেও একদল লোক বিষমকামী থেকে সমকামী হয়। যেমনটা, জেলখানাতে অনেক কয়েদী নারীসঙ্গের অভাবে পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

“টপ ব্যক্তিরা চাইলেই স্ট্রেট হতে পারেন”- এই বিষয়টা টপ সমকামীদের বলার পর তাদের বক্তব্য হচ্ছে- না, তারা চাইলেই স্ট্রেট হতে পারবে না। কেননা, তারা পুরুষ ছাড়া আর কারও প্রতি কোনো যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন না। এক্ষেত্রে আলফ্রেড কিন্সের স্কেল অনুযায়ী তারা পূর্ণ সমকামী ব্যক্তি।

শুধুমাত্র হাইপোথ্যালামাসই নয়। ক্রোমোজোম, থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, এড্রিনাল গ্রন্থির জৈবিক ফ্যাক্টরগুলোও সমকামী ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ডিন হ্যামার বলেছেন, ক্রোমোজোমের Xq28 নামক অংশটি সমকামিতাকে ত্বরান্বিত করে। এবং, সমকামী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণ করে।

পার্থোজেনেসিস-এর কথা আমরা সকলেই জানি। এরা মূলত বিশ্বজয়ী প্রাণী। এদের আলাদাভাবে পুরুষ কিংবা মহিলা সঙ্গীর দরকার নেই। এরা পুরুষ ছাড়াই সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। পার্থোজেনেসিস মূলত প্রকৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যারা বলে, সমকামের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে তাদের জন্যে পার্থোজেনেসিস উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পার্থোজেনেসিস প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়নি। বরং, স্বমহিমায় টিকে থাকে।

হেনরি বেঞ্জামিন তার বিখ্যাত বই “ট্রান্সেক্সুয়াল ফেনোমেনন বইয়ে জেন্ডার এবং সেক্সের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছিলেন। সেক্স বলতে লিঙ্গ আর জেন্ডারের ক্ষেত্রে মানসিক লিঙ্গ। মানে হচ্ছে, মানসিক ধ্যানধারণা প্রধান বিষয়। একজন মানুষ মানসিকভাবে নিজেকে নারী নাকি পুরুষ হিসেবে কল্পনা করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। দৈহিকভাবে পুরুষ হলেও মানসিকভাবে নিজেকে নারী ভাবলে কিংবা পুরুষের উপর আকৃষ্ট হলে সেখানে সমকাম চলে আসে। আবার, নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে জেন্ডারের ক্ষেত্রে মানসিকভাবে নারীর উপরেই আকৃষ্ট হবে।

এখন পর্যন্ত প্রকৃতিতে প্রায় ১৫০০ প্রাণীর মধ্যে সমকামিতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব প্রাণীরা খুবই সহজভাবে প্রকৃতিতে অভিযোজিত হয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়াই এরা টিকে আছে।সমকাম যদি অপ্রাকৃতিক হতো তাহলে এতো অধিক সংখ্যক প্রজাতি প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারতো না। উৎপাদনের হিসেবে ধরলে সমকামকে বিবর্তনের উপজাত বলা যেতে পারে। আছে।তাই সমকামকে অস্পৃশ্য রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে এতো সংখ্যক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়াটা মানবিক নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]