September 20, 2024
কলামফিচার ২

নারীর স্বাধীনতা কি পুরুষের হাতে?

আঞ্জুমান রোজী।। স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না, না নারী, না পুরুষ। কিন্তু সমাজ নারীকে এক শৃঙ্খলের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে। সেক্ষেত্রে পুরুষ পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে চলছে। নারীর বুকের মধ্যেও স্বাধীনতা ভোগের দৃঢ় স্পৃহা কাজ করে। কিন্তু নারীকে থাকতে হয় পুরুষের অধীনে। সবরকম সিদ্ধান্ত, অনুমতি পুরুষের থেকে নিয়েই নারীকে চলতে হয়। জন্ম থেকে লক্ষ্য করে আসছি, প্রায় সব বয়সী নারী পুরুষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ করে। সেই পুরুষ হয় বাবা, বড়ভাই, বিয়ের পর স্বামী এবং পুত্র। এই অনুমতির বিষয়ে আমার আম্মার সঙ্গে প্রায়ই তর্ক হতো। বলতাম, অনুমতি নেয়ার কী আছে, শুধু জানিয়ে যা কাজ করতে ইচ্ছে করে, করুন। কিন্তু সিলমোহরকৃত বিষয় থেকে অনেক নারী বের হয়ে আসতে পারে না। এমনই কঠিন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তারপরও অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করা নারীদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বোঝার চেষ্টা করি।

জন্মের পর থেকেই কন্যাশিশুটিকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়। তারপর বড় হতে হতে কন্যাটি যখন তার নিজস্বতা বুঝতে পারে তখন ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়, সেইসাথে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিধিনিষেধ। নিয়মতান্ত্রিক শাসন অনুশাসনের বেড়াজালে কন্যাটিকে বেঁধে ফেলা হয়, এতে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এদের সংখ্যাই বেশি। পরনির্ভরশীলতাই ওদের ধর্ম হয়ে যায়। আবার এক শ্রেণির নারী আছেন যারা জন্ম থেকেই স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে। তাদের কাছে অনুমতি নেয়া মানে আত্মসম্মানে আঘাত লাগার মতো বিষয়।  বড়জোর জানাতে পারে।  কী করবে না করবে এটা নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের অনুমতির কোনো বিষয় নেই। পুরুষ জন্মেই স্বাধীন। তারা স্বাধীন ইচ্ছায় বড় হয়। বাবা-মা’ও পুত্র সন্তানকে স্বাধীনতার বিষয়টি ভালো করে বুঝিয়ে দেন। যার ফলে, কীভাবে অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হয়, তারা তা বোঝে না। ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক ব্যবস্থা এমনই একচেটিয়া রূঢ় পক্ষপাতিত্ব করে যে, সবকিছুর স্বাধীনতা একমাত্র পুরুষের এখতিয়ারে। সেইসাথে পুত্র সন্তানকে বড় হতে হতে বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে একটা মেয়েকে তার অধীনে রাখতে হয়। জন্ম থেকেই একটা পুরুষ ধীরে ধীরে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারীদের ওপর, কি ঘরে কি বাইরে সর্বাবস্থায় কর্তৃত্বের ভাবমূর্তি চূড়ান্তরূপে বহাল রাখে। মোটকথা নারীর কোথাও স্বাধীনতা নাই৷ তাকে অন্যের উপর নির্ভর করে চলতে হবে অর্থাৎ চলতে সে বাধ্য।

সমাজের যখন এমন অবস্থা তখন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে  স্বামীকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাকে আর কত স্বাধীনতা দেবো?’ বিষয়টা এমন যে, নারীর স্বাধীনতা সব পুরুষের হাতে। এরকম কথোপকথনে অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়, অনেকসময় সংসারও ভেঙ্গে যায়। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী কখনোই কারোর হাতের ক্রীড়নক হতে চাইবে না। আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন নারী এর প্রতিবাদ করবেই। সচেতন স্ত্রী জিজ্ঞেস করবেই। বলবে, ‘আমার স্বাধীনতা তুমি কে দেয়ার?’ লক্ষ্য করে দেখেছি, বাবার বাড়ি যাবে, বাইরে যে কোনো কাজের জন্য যাবে, নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করবে; বলতে গেলে জীবনের যাবতীয় সমস্ত বিষয়ে স্বামীর অনুমতির অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি স্ত্রী চাকরি করলে সেই টাকাটাও স্বামীর অনুমতি ছাড়া খরচ করতে পারে না। অথচ, পুরুষের বিষয়টা একবার ভাবুন, নারীর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করছে। আজ পর্যন্ত কোনো স্বামীকে দেখিনি, স্ত্রীর কাছ থেকে কখনো কোনো কাজের জন্য অনুমতি নিয়েছে। শিক্ষিত সমাজে স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে  বড়োজোর আলোচনা করে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সম্পূর্ণরূপে পুরুষের। নারী-পুরুষের মধ্যে এই যে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে সমাজ, তাতেই সমাজের সব রকম বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত। স্বাধীনতা নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান হবে না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর জানা আছে, কিন্তু প্রায়োগিক কোনো বাস্তব অবস্থা নেই।

অথচ স্বাধীনতা হলো মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। নারী-পুরুষ সকলের জন্য সমান স্বাধীনতা রয়েছে, যা প্রকৃতিজাত একটি বিষয়। এখানে কেউ কাউকে স্বাধীনতা দেয় না। স্বাধীনতা যার যার মতো সে অর্জন করে। শিক্ষা দীক্ষায় মননে-মগজে মানুষ তার স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে তোলে। পরাধীনতা মানুষের ধর্ম নয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশকে  স্বাধীন করার মানসিকতা থাকলে, নারী কেন পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে না? নারী-পুরুষের স্বাধীনচেতা মনোভাবই পারে মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে, গড়তে পারে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। অথচ ঘরে ঘরে পরাধীনতার শৃঙ্খল ঠিক রেখে সেই পুরুষ যখন স্বাধীনতার কথা বলে তখন সেটার কোনো ভিত থাকেনা। অগ্রগতির পথে কুড়াল বসিয়ে রাখার মতো।

নারী স্বাধীনতার বিষয়ে শিক্ষিত পুরুষেরও বিশেষ মাথাব্যথা আছে। বিষয়টা এমন যে  নারীর স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। নিজের মতো করে কোনো কিছু পাওয়ার অধিকার নারীর নেই। তাদের ভাষায় হলো, নারী তার ‘নারীসত্তা’য় বেঁচে থাকবে। এখানে নারীর ‘নারীসত্তা’ দিয়ে কী বোঝাতে চান, জানি না। তবে এইটুকু বুঝি, পুরুষ চায় না নারী তার স্বাধীন ইচ্ছায় চলুক। অনেকে মনে করেন, নারী স্বাধীন জীবনযাপন করলে সেটা পুরুষালী জীবন হয়ে যায়। এই মানসিকতা কতিপয় পুরুষ ও নারী বহন করে আসছে। কে কীভাবে জীবনযাপন করবে সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। এই ব্যক্তিগত অভিরুচি নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ পুরুষ নিশ্চিত ধরেই নিয়েছে, নারীর স্বাধীনতা কেমন হওয়া উচিৎ তা শুধু তাদেরই  নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

নারী অবশ্যই নারীসত্তা নিয়ে মানুষের মর্যাদায় বাঁচে এবং বাঁচতে  চায়। যদিও সমাজ নারীর স্বাধীনতা ভালো চোখে দেখে না। যার জন্যে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, স্বাধীনতা অর্জনে নারীর এতো লড়াই। এ লড়াই বহাল থাকবেই। নারী নিজেই একা যুদ্ধ করে তা অর্জন করছে এবং করবে। আজ বাংলাদেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বলতে ইচ্ছে করে, নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নারীকে দেয়া হোক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে নারীর অগ্রগতি কতটুকুই বা হয়েছে? আশানুরূপ কিছুই না। নারীকে তার ইচ্ছায় যতদিন পর্যন্ত চলতে না দেবে ততদিন উন্নতির দোরগোড়াতেও দেশ যাবে না। কি ঘরে কি বাইরে, নারী তার স্বাধীন ইচ্ছায় বাঁঁচবে। সমতার কথা বললে প্রথমেই নারীকে তার মতামত ব্যক্ত করার এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে।

সবশেষে বলি, নারীর উপর থেকে সামাজিক-পারিবারিক অনুশাসন; সেইসাথে সবরকম বাধানিষেধ, আদেশনির্দেশ, কর্তৃত্ব আরোপ বন্ধ করা হোক। নারী তার স্বাধীন ইচ্ছায় জীবনযাপন করবে, এই হোক সকল নারীর ব্রত।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]