‘‘বাবা-মা তো কিছুই শেখায়নি!” কার বাবা-মা?
লীনা দিলরুবা শারমিন।। বিয়ে ব্যাপারটি আমার কাছে অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির বগিতে ট্রেন ভ্রমণের মতো। ধরুন, আপনি খুব আরামের একটা সুতির জামা পরে চুলগুলো গুছিয়ে বেঁধে ট্রেনে উঠেছেন। জানালার পাশে সিট। খোলা জানালা দিয়ে লু হাওয়া বইছে। আপনি হেলান দিয়ে মোবাইলে কিছু পড়ছেন, লিখছেন বা দেখছেন। সামনে ঠান্ডা পানি, চিপসের প্যাকেট… জীবন চমৎকারভাবে চলছে। ঠিক এ সময় জানালা দিয়ে টান মেরে আপনার মোবাইলটি কেড়ে নিলো।
বিয়েতে মনের মতো পার্টনার পাওয়া অনেকখানি জানালার পাশের সিট পেয়ে তার ওপর পা ভাঁজ করে নিজেকে আরাম দেয়ার মতো। জীবনের ছোট বড় আনন্দ, একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলাটিকে আমি তুলনা করি লু হাওয়া, আরামদায়ক ঠান্ডা পানি বা অন্য যে কোনো মধুর কিছুর সাথে।
এবার চলুন ট্রেনে মোবাইল ছিনতাইকারীর মতো বিবাহিত জীবনে সুখ কেড়ে নেয়া ছিনতাইকারীর সাথে পরিচিত হই। আমার চোখে এরা হচ্ছে নিজের ও শ্বশুরবাড়ির নিচু মানসিকতার আত্মীয়স্বজন। আপনি যদি পুরুষ হন তাহলে আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বড় ধরনের আচরণগত সমস্যা না থাকলে আপনাকে কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে শুনতে হয়নি, ‘মা বাপ তো কিছুই শিখিয়ে পাঠায়নি’!
অথচ, এই আপনার সামনে বা আগে পরে হয়তো আপনারই স্ত্রী-টিকে শুনতে হয়েছে। আপনি কি কথাটিকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন? আপনাকে যদি বলা হয় একইভাবে নিতে পারবেন তো? মনের ক্ষতি দেখানো যায় না বলে হয়তো আপনি বুঝতেও পারেননি এ ধরনের কথাতে আপনার সঙ্গীর মন ততটাই আঘাতপ্রাপ্ত যতটা পুড়ে গেলে বা কেটে গেলে হতো।
সব বিষয়ে কথা বলা জাতি বলে হয়তো আমরা জানি না কোনো যুক্তিতেই আপনি কারো পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না। স্ত্রীর দায়িত্ব সংসারের কাজ নয় এ তথ্যটি বাংলাদেশি ছেলেদের জানা নেই। দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ শাসিত সমাজের নানা অসঙ্গতি মেনে নিতে নিতে এবং এসবকেই স্বাভাবিক জেনে বড় হওয়া নারী নিজেও জানেন না তিনি চাইলেই যা ইচ্ছা বলতে পারেন না।
১৫ বছর বয়সি বিবাহিত মেয়েদের প্রতি ২ জনের ১ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। গত ১২ মাসে প্রতি ৪ জন নারীর মধ্যে ১ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। আপনি কি সংখ্যাটি বুঝতে পেরেছেন? বাল্য বিয়ের শিকার অর্ধেকের বেশি মেয়ে কিন্তু পারিবারিক সহিংসতারও শিকার। বাকি যারা ছিলেন, কোভিড মহামারীতে তাদের অনেকে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
যে কোনো ধরনের কটূক্তি, হুমকি ও নাশকতামূলক আচরণ সহিংসতার আওতাভুক্ত। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা যা হয়েছে তাতে জানি পিটিয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেয়ার আগে নারীরা সহিংসতা হয়েছে মানতে নারাজ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই, বাবা মায়ের সাপোর্ট নেই, ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই, শিক্ষা নেই, সাহস নেই… মানবে কী করে? আমাদের পৃথিবীতে এতো অবিচার যে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখাটিকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিতে চাইনি। কী অদ্ভুত সমতাহীন এই পৃথিবী।
আমার একটা ভয় হচ্ছে বাংলাদেশে আগামী একশো বছরেও লিভ টুগেদারের কনসেপ্টটিকে আমরা মানতে পারবো না। আমাদের বিয়ে বাড়িতে যাওয়া চাই। কে এখনো বাচ্চা নেয়নি, স্বামীর সমস্যা না স্ত্রীর (!), কার বেতন কত, কত মোটা গয়না পরেছে, গায়ে কত কেজি মাংস লাগিয়েছে, কার মেয়ে প্রেম করছে, কার ছেলে চাকরি পাচ্ছে না এসব আলাপ করতে করতে একেবারে ঠেসে খেতে হবে আমাদের। এবার খাওয়া কতটা মজা হয়নি সেটা বলবেন পান খেতে খেতে।
একবার ধর্ম ও আইন অনুসারে বাঁধা পড়ে গেলে দু পক্ষকেই আজীবন মেয়াদে কথা শোনানোর জন্য আমাদের বিয়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা চাই। লিভ টুগেদারে কারো বাবা মাকে সকাল বেলা চা বানিয়ে দেয়া নেই, খালা শাশুড়ির কাপড় ভাঁজ করা নেই, চাচী শাশুড়ির পা টিপে দেয়া নেই। সামর্থ্যের বাইরে বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ বহন করার কিছু নেই, ভাত কাপড়ের দিব্যি নেই। এতো আরাম কি আমরা কাউকে করতে দিতে পারি আমরা? না বাবা! ওসব হবে না!
আমাদের চাই অত্যাচার করার অধিকার। আচ্ছা, মা বাবা কিচ্ছু শেখায়নি শুনেও যে মেয়েটি চুপ করে থাকে, ভেবে দেখুন তো কার পারিবারিক শিক্ষা ভালো? অথবা নিজের আত্মসম্মানের জন্য জবাব দিতে জানা মেয়েটা কত নিখুঁত? কত ভালো তার বাবা মা?
ভালো মানুষ হবার জন্য লোক দেখানো অভ্যাস থাকার দরকার নেই। ভালো মানুষ হবার জন্য চর্চার দরকার হয়। চর্চাটি করছেন তো?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]