November 21, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

মিথ এবং নারী

সালমা মোস্তফা নুসরাত।। কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বাংলা সাহিত্যের একজন আধুনিক কবি। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-

চেতনা প্রবাহ (stream of consciousness)- কবিতায় একান্তভাবেই কবির নিজের মনের ভাবনা-চিন্তা ফুটে উঠবে।মুক্ত চরণ (free verse)- ছন্দ বা স্তবকের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম অনুসরণ করা হয় না।
Mise-en-Abyme- একটা গল্পের ভিতর আরেকটা গল্প থাকবে; অর্থাৎ, কবি নিজের কথা বলতে গিয়ে অন্য আরেকটা ঘটনার উল্লেখ করবেন।

আধুনিক কবিতায় একটা লাইনে কবির মনের ভাব সম্পূর্ণ হয় না; কবির মনের ভাব বুঝতে পরবর্তী লাইনে যেতে হয়।

‘বাঙলার মুখ আমি’ কবিতায় কবি বলেছেন, যেহেতু কবি বাংলার মুখ দেখেছেন সেহেতু পৃথিবীর রূপ দেখার তার আর দরকার নেই। ভোরের অন্ধকারে জেগে উঠে, ডুমুরের গাছে ছাতার মতো বড় পাতার নিচে দোয়েল পাখিকে বসে থাকতে দেখেছেন। চারিদিকে পাতার স্তূপ। ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে জাম-বট-কাঁঠাল-হিজল-অশ্বথ গাছের ছায়া পড়ে আছে; সব বড় গাছ চুপ করে আছে। চাঁদ সওদাগর যখন তার বাণিজ্য তরী নিয়ে চম্পা নগরীতে গিয়েছিল, তখনও সে সেখানে বাংলার এরকম অপরূপ রূপ দেখেছিলো। বেহুলাও একদিন দামোদর নদীর শাখা নদী গাঙুড় নদীর জলে ভেলা নিয়ে ভেসে গিয়েছিল, তখন নদীর তীরে কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোৎস্না মরে গিয়েছিল। সোনালী ধানের পাশের অনেক অশ্বথ, বটগাছ তা দেখেছিল; শ্যামা নরম সুরে গান গেয়েছিল। বেহুলা যখন অমরায় গিয়ে দেবতা ইন্দ্রের সভায় যন্ত্রণায় কাতর খঞ্জনা পাখির মতো নেচেছিল, তখন বাংলার সমস্ত প্রকৃতি (নদী, মাঠ, ভাটফুল) তার পায়ে ঘুঙুরের মতো কেঁদে উঠেছিল। কেন? কারণ বেহুলা যে দেবতাদের সভায় নেচেছিল, এতে বেহুলার নারীত্বের অবমাননা হয়েছিল; বেহুলার অপমান হয়েছিল। বেহুলার অপমান ও নারীত্বের অবমাননা দেখে সমস্ত বাংলার প্রকৃতি কেঁদে উঠেছিল। এখানে কবি এমনভাবে প্রকৃতিকে এনেছেন, যেন তিনি প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চাচ্ছেন। আধুনিক যুগের পূর্বে মানুষ প্রকৃতিকে এক ধরনের প্রভু মনে করতো, সে যেন সবসময় প্রকৃতিকে তুষ্ট করে চলতে চাইতো। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষ প্রকৃতিকে আর তার প্রভু মনে করেনি।

এই কবিতায় বেহুলা, লখিন্দর, চাঁদ সওদাগরের মিথটা ব্যবহার করা হয়েছে। মিথ কী? এটা গ্রীক শব্দ ‘মুথোস'(mythos) থেকে এসেছে। এটার মানে হচ্ছে ‘গল্প’। ল্যাটিন ভাষায় মিথ মানে হচ্ছে- কোন জাতির কোন একটা অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস।

মিথ পড়ে কী লাভ হয়? মিথ পড়ে কোন একটা গোষ্ঠীর বিশ্বাস সম্পর্কে, একটা সময় সম্পর্কে জানা যায়। অনেক মিথে দাদী বা নানীকে দুষ্ট-কুটনী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটার মাধ্যমে ঐ সমাজের সামাজিক কাঠামো, গঠন ও সম্পর্কের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। Claude Levi-Strauss তার “The Structural Study of Myth” রচনাটিতে বলেছেন- মিথ বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতকে ব্যাখ্যা করে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় সব মিথের সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে, মানুষ মাটি থেকে জন্মলাভ করেছে এবং যখনই সে গভীরতা থেকে উদিত হয়, তখনই সে হয় হাঁটতে ব্যর্থ হয় অথবা কদাকারভাবে হাঁটে। ইডিপাস(Oedipus) মিথে দেখা যায়, ইডিপাসের বাবার দিকের সবার পদবীগুলোর গূঢ়ার্থ হচ্ছে, সোজা হয়ে হাঁটার এবং বলিষ্ঠভাবে দাঁড়ানোর অসুবিধাসমূহ; অর্থাৎ, মানুষ খুব বেশি জানার চেষ্টা করতে পারবেনা, সে তার ভাগ্যকে বদলাতে পারবেনা।

ইডিপাস মিথের দিকে তাকালে বোঝা যায়, একটা জাতিগোষ্ঠী আসলে একটা ব্যাপার বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে; তারা তাদের বিশ্বাস ও জ্ঞানের মধ্যে মিলন ঘটাতে পারছে না। সেটা হলো, মানুষ কি আসলে মাটি থেকে জন্মলাভ করে নাকি দু’জন মানুষের মিলনের মাধ্যমে জন্মলাভ করে? মানুষ কি একজনের মাধ্যমে জন্মলাভ করে নাকি দু’জনের মাধ্যমে? মানুষ কি দু’জন ভিন্ন মানুষের মাধ্যমে জন্মলাভ করে নাকি দু’জন একই মানুষের মাধ্যমে জন্মলাভ করে? এজন্যই মিথটির এক পর্যায়ে রক্তের সম্পর্ককে অতি গুরুত্ব দেওয়া হয় (overrating of blood relations); আরেক পর্যায়ে অত গুরুত্ব দেওয়া হয় না (underrating of blood relations)।

Marie Delcourt স্ফিংসকে দানবী হিসেবে দেখিয়েছেন, যে কিনা  তরুণদেরকে আক্রমণ করে ও ধর্ষণ করে। এটা উত্তর আমেরিকার মিথোলজির দুটো চরিত্রের সাথে মিলে গেছে (সম্ভবত যে কিনা একজনে রূপান্তরিত হয়)। একদিকে আমরা একে “বুড়ি-কদাকার ডাইনি”, একটা ঘৃণ্য মোহিনী ডাকিনী হিসেবে চিহ্নিত করি; যার শারীরিক উপস্থিতি একজন তরুণ বীরের জন্য একটা “সমস্যা” তৈরি করে। যদি সে এই সমস্যার সমাধান করতে “সক্ষম” হয়, অর্থাৎ যদি সে এই ঘৃণ্য জীবের আহ্বানে সাড়া দেয়, সে তার বিছানায় জেগে ওঠার পর একটা সুন্দরী রমণীকে দেখতে পায়; যে কিনা তার উপর ক্ষমতা আরোপ করবে। অপরদিকে স্ফিংস  হোপি  ইন্ডিয়ানদের “বাচ্চা-প্রসবকারী নারী”র ভূমিকার চেয়েও বেশি কিছু মনে করিয়ে দেয়। সেটা হচ্ছে, সর্বোচ্চ মাত্রায় সমুত্তেজিত লৈঙ্গিক মা। এই তরুণী মা যে কিনা একটা জটিল অভিবাসন বা পরিভ্রমণের কালে তার প্রসব প্রক্রিয়ার সময় তার দল-বল কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল। তারপর থেকে সে “জন্তু-জানোয়ারের মা” হিসেবে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায়, যাদেরকে সে শিকারীদের কাছ থেকে রক্ষা করে। কোন পুরুষ মানুষের ঐ নারীর সাথে ঐ নারীর রক্তাক্ত কাপড় পরিধান করা অবস্থায় দেখা হলে সে “এত বেশি ভয় পায় যে তার পুংদন্ডের উত্থান ঘটে”। নারীটি পুরুষটির এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে; এটার পরেই নারীটি পুরুষটিকে শিকারে বিশাল সাফল্য দিয়ে পুরষ্কৃত করে।

মিথ কি প্রাসঙ্গিক? সময়ের সাথে সাথে মিথ সবসময় বদলে যায়; এজন্যই মিথ প্রাসঙ্গিক।

বেহুলা, লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর ও সাপের দেবী মনসাকে নিয়ে একটা মিথ আছে। শিবের কন্যা মনসা ছিল  সর্পদেবী, কিন্তু তিনি কোথাও পূজিতা হতেন না। তার পিতা তাকে বলল, কোন ভক্তিমান শৈব (শিবের উপাসক) মনসার পূজা করলেই পৃথিবীতে তার পূজা চালু করা যাবে। মনসা চাঁদ সওদাগরকে তার পূজা করতে বললে সে সেটা প্রত্যাখ্যান করে কারণ সে কোন নারীর পূজা করবে না। এতে মনসা ক্ষিপ্ত হয়ে চাঁদ সওদাগরের সমস্ত বাণিজ্যতরী ধ্বংস করে। চাঁদ সওদাগরের সবগুলো ছেলে সাপের কামড়ে মারা যায়। এজন্য চাঁদ সওদাগর বেহুলা ও লখিন্দরের জন্য লোহার বাসর ঘর তৈরি করে কিন্তু তারপরও বাসর ঘরের একটা ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করে। লখিন্দরের মৃতদেহকে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হলে বেহুলা তার সাথী হয়। বেহুলা মনসার কাছে গিয়ে তার স্বামীর প্রাণভিক্ষা চায়। মনসা বলে তার শ্বশুর যদি মনসার পূজা দেয়, তবেই সেটা সম্ভব হবে। বেহুলা তার শ্বশুরকে অনুরোধ করলে, চাঁদ সওদাগর পুত্রবধূর কথায় বাম হাতে মনসার পূজা দেয়।

এভাবেই মনসা দেবীর পূজা শুরু হয়েছিল। এটা কেন চালু হয়েছিল? ঐ সময় এই বাংলা অঞ্চলটা বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বর্ষাকালে এখানে অনেক বৃষ্টি হতো এবং এ সময় সাপের উপদ্রব বেড়ে যেতো। ধারণা করা হয়, সাপের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্যই সাপের দেবী মনসাকে তুষ্ট রাখতে, মনসা দেবীর পূজা চালু হয়।