জয় হোক নারী ও পুরুষের
মানুষ ভাবছে পৃথিবীতে আর জায়গা না হলে অন্য কোন গ্রহে গিয়ে বাসা বাঁধবে! কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি। বদলে যাচ্ছে চারপাশ।
বদলে যাচ্ছে নারী পুরুষ ধারণাও। মানুষের লিঙ্গগত ভাবনার জায়গাটিতে এসে একজনকে দাস আর অন্যজনকে মালিক বানিয়ে রাখার প্রথা ও প্রবৃত্তিতে আঘাত, পাল্টা আঘাত পড়ছে। আবার নারী ও পুরুষ ছাড়াও যে আরো একটি লিঙ্গ আছে এবং তারাও নারী পুরুষের মতই সমান অধিকারে পৃথিবী উপভোগ ও জীবনযাপনের মর্যাদা রাখে, সেটিও বোধে ধরতে শুরু করেছে আমাদের।
নারীবাদ- এমন এক ধারণা, তত্ত্ব, চিন্তা ও অনুশীলন যা আপনাকে একটি বৈষম্যহীন সুন্দর সুস্থ পৃথিবী দিতে পারে। আজ নারীবাদের সর্বব্যপী বয়ে চলা সেই সুন্দরের দিকে আমাদের যাত্রাকে চিহ্নিত করে।
যাত্রাপথ দুর্গম। বোধের লড়াই দুস্তর। আমাদের ক্লান্তিহীন যুদ্ধ, শ্রমঘাম শেষে সকালে খবরের কাগজের পাতায় দেখি সারা দুনিয়ায় বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা। এতে প্রাণ হারাচ্ছে নারী। নানা দেশি, নানা বর্ণ, ধর্ম, গোত্র ও সমাজের নারী তারা। পুরুষতন্ত্র তাদের মৃত্যুকে এক সুতায় গেঁথেছে। গণমাধ্যম জুড়ে প্রতিদিন যে সংবাদ পড়ি তার সারকথা আসে-গত বছরের প্রথম ছয়মাসে ৭৩১ জন নারী, যার মধ্যে ৩৯৬ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।পড়তে হয় সেইসব সংবাদ যেখানে লেখা থাকে মেধাবী ছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে কেউ, ধর্ষণ শেষে ছুড়ে ফেলে আগুনে, ছিড়ে ফেলে স্তন। পড়তে থাকি তনুকে, নুসরাতকে, পূজাকে। পড়তে থাকি একের পর এক। বিচারহীনতার এই দিন কবে শেষ হবে আমাদের জানা নেই। আমাদের যুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে। আমাদের মুখে রক্ত ওঠে। আমাদের বুক ভেঙ্গে যায়। অনলাইনে, বাস্তবে, শাহবাগের চত্বরে, মিছিলে, সমাবেশে, সেমিনারে, বইয়ে, পত্রিকায় আমাদের প্রতিবাদ বার বার অপমানিত হয়। পাল্টা আঘাতে আমরা বারবার আহত, বেদনার্ত আর বিস্মিত হয়ে থমকে যাই। তারপর ফের মাথা তুলি, তুলে ছুটি, ছুটতে থাকি অবিরাম…
এই লড়াইয়ের নাম অধিকারের লড়াই। মর্যাদার লড়াই। সমতার লড়াই। প্রাপ্যের লড়াই। এই লড়াইয়ের নাম নারীবাদ।
নারীবাদ বা নারী অধিকার ও লিঙ্গ সমতার লড়াইয়ের জন্য একটি নতুন আলাদা প্লাটফর্ম গড়ে তুলবার ইচ্ছে কেন জাগলো? কেন এটি দরকার?
মনে হল, বিশ্বাস এলো, এতে লড়াইয়ের পথটি আরো দৃঢ়, সংঘবদ্ধ ও সুচিন্তিত হবে। লড়াইয়ের মাঠ বিস্তৃত হবে। নারীবাদ নিয়ে ভুল ও মিথ্যে প্রচারের বিপরীতে জ্ঞানগর্ভ, গঠনমূলক চিন্তা প্রসারের কাজটি সহজতর হবে। সহযোদ্ধাদের পাশে পাওয়া যাবে। সারা দুনিয়াজুড়ে নারীবাদের লড়াইয়ে যে তীব্রতা আছে, জোর আছে, শক্তি আছে, বাংলাদেশের নারীবাদ আন্দোলনেরও সেই শক্তি ও তীব্রতার সাথে সংযুক্তির সুযোগ তৈরি হবে। আর এই সুযোগটি আসবে তখনই যখন সব যোদ্ধা সংগঠিত হয়ে উঠবেন, একতাবদ্ধ হবেন এবং লড়বেন কাঁধে কাঁধ রেখে।
নারীবাদ শুধু লড়াই নয়। নারীবাদ বন্ধুতাও। নারীবাদ মানে সহানুভূতি, সহমর্মিতা আর ভালবাসার হাত প্রসারিত করে দেয়া। নারীবাদ মানে মানবিকতাকে উর্ধ্বে তুলে ধরা। নারীবাদ মানে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া- জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, চিন্তায়, অনুভবে, উপলব্ধিতে আর কর্মে। নারীবাদ মানে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে জ্বলে ওঠা আর সমতার পৃথিবী কায়েম করা।
নারীবাদের চর্চা শুধু কর্মে হয় না। লাগে বোঝাপড়া। সেটি ছড়িয়ে দেয়াও লাগে- লেখায়, বলায়, চলায়, জীবনযাপনে। নারীবাদ নিয়ে সুচিন্তিত চিন্তার প্রসার যেমন জরুরি, তেমনি নারীবাদকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও সৃষ্টিশীল অন্যান্য মাধ্যমে বিস্তৃত করে দেয়াটাও খুব প্রয়োজন।
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নারীবাদ চর্চার জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম। যেখানে লেখা, বলা ও সৃষ্টিশীলতার ভেতর দিয়ে আন্দোলনটিকে সমাজের সব স্তরে পৌঁছে দেবার একটা আন্তরিক চেষ্টা থাকবে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর চাইবে প্রান্তিক নারীটি থেকে শুরু করে সমাজের সবচেয়ে বিত্তশালী নারীটির মনে আত্মমর্যাদা ও নিজের অধিকার বুঝে নেবার সচেতনতা জাগুক। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর কাজ করবে এই সমাজের প্রতিটি পুরুষের জন্য, সমতা ও বৈষম্যহীন একটি পৃথিবী তৈরিতে তারা যেন নিজেদের গড়ে নিতে পারে।
নারী কখনোই রাজনীতির বাইরে নয়। নারী অধিকার যতটা সামাজিক ইস্যু, ততটাই রাজনৈতিক। নারীবাদের সাথে রাষ্ট্রচিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতির গতি প্রকৃতির সম্পর্ক রয়েছে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর সবকিছুকেই স্পর্শ করবে। এবং অবশ্যই প্রাসঙ্গিকভাবে। নারীর প্রয়োজন, নারীর অধিকারই ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজের প্রতিটি নারী পুরুষই এর সাথে সংযুক্ত।
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের যাত্রা শুরু হল। আপনাকে এতে স্বাগত জানাই। আমাদের পাঠক, দর্শক, শ্রোতারাই আমাদের শক্তি। তারাই গড়ে তুলবে একে, লালন করবে, বড় করবে। জয় হোক নারী ও পুরুষের। জয় হোক সাম্য ও সমতার। জয় হোক নারীবাদের।
কৃতজ্ঞতা।