‘‘একথা মাকে বলবি না, বললে কিন্তু টের পাবি!”
সাবরিনা শারমিন বাঁধন।। ছয় কিংবা সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে। খেলার বয়স। খেলতে খেলতে ইশকুলে যাবে, হিসাবে তাই হবার কথা। ওইটুকু বয়সেই তার মা তার জন্য আরবী শেখার একজন হুজুর রেখে দিলেন। সেই হুজুর আসেন যান, মেয়েটা একদম আরবী শেখায় আগ্রহী নয়। তার আগ্রহ কেবল ছবি আঁকায়। পড়ালেখাও তার লাগেনা ভাল।
সেই হুজুর তাকে বাগে আনার জন্য তার বায়নাক্কা শোনে। ইশকুল থেকে এসে খেয়েই ঘুমানোর সময় বাদ দিয়ে তাকে হুজুরের কাছে পড়তে হয়। খেলার সময় পায়না। তখন হুজুর তার সাথে লুডু খেলেন।
এমন করে একটা বছর পড়ানো শেষে, হুজুর কী একটা কাজে শহরের বাইরে চলে গেলেন। পড়ানোর দায়িত্ব পরলো হুজুরের বড় ভাইয়ের। সেই হুজুর বেশ কড়া তবে কোমল ছিলেন। পড়ানো হয়ে গেলেই চলে যেতেন। বায়নাক্কা তো কোন ছাড়!
বছরবাদে সেই হুজুরটা মারাত্মক লিভার থিরোসিস হয়ে মারা গেলেন। তাঁর বউকে দুই বাচ্চাসহ বিয়ে করলো, সেই হুজুরটা মানে তাঁর ছোট ভাই। শোনা যায় বিয়ের ইচ্ছে ছিলোনা মোটে সবাই নাকি জোর করে বিয়েটা করিয়েছে।
তো ঘুরেফিরে আবার সেই মেয়েটাকে পড়াতে এলো। ওদিকে আরও অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আরবী শিক্ষা দেওয়া শুরু করলো। মেয়েটার মাকে হুজুর আবার আপা বলে ডাকতো। মেয়েটার মা বললো, এখন থেকে আরবীর পাশাপাশি ইশকুলের ইসলাম শিক্ষাও পড়ান ওকে, ওটাতে চাই একশোতে একশো।
তখন মেয়েটা বেশ বড়ই।ফাইভ সিক্সে পড়ে।
এক ভোরে সেই লোকটা পড়াতে এলো। গরম কাল। মেয়েটা পাতলা ফ্রক পরে পড়তে বসলো, যা বাচ্চারা পরে আরকি!
লোকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা বুঝতে পারলো কিছু একটা। পরেরদিন থেকে গায়ে বেশ ভাল করে ওড়না দিয়ে বসতো। দু’পাঁচ দশদিন বাদে একদিন মেয়েটার গায়ে হাত দিল লোকটা। মেয়েটা চেঁচিয়ে বলল, এটা কি হচ্ছে? বলল, কিছুনা। মেয়েটা ঘাবড়ে গেল কিন্তু কাউকেই কিছু বলার সাহস পেল না।
আরেকদিন মেয়েটার বুকেই হাত দিল হুজুরটা। তারপর বলল, একথা তোর মাকে বলবি না, বললে কিন্তু ইশকুলে যাবার সময় টের পাবি। আর তোর মা যদিও এসব বিশ্বাস ও করবেনা। শুধু শুধু বেদম পিটুনি খাবি বলে রাখলাম।
ওদিকে মেয়েটাও সত্যিই সাহস করে তার মাকে বলতে পারলোনা ঘটনাটা। কারণ সে জানতোই পড়তে না চাইবার কারণে এসব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছে, তার মা তাই বলবে।
ওদিকে প্রতিদিন সেই হুজুরের চাহনি হজম করতো মেয়েটা। কাউকে বলতে পারতোনা। কারণ তার মায়ের সাথে মনের কথা বলবার মত সম্পর্ক তার ছিলনা। তার মা কেবল শাসনই করতো, কখনো মাথায় হাত দিয়ে তার মনের কথা কিংবা অনুভূতির কথা শোনার দরকার মনে করতোনা। আর বাবার সাথে কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও একথা বলতে পারেনি। কারণ তার মাবাবার সম্পর্ক সারাজীবনই খারাপ। বাড়িতে ভুল মাছ কেনার অপরাধেও বাড়িসুদ্ধ জিনিস ভাঙ্গা হয়, সেখানে এসসব কথা ধোপে টিকবেনা। শুধু শুধু ক্যাচাল বাড়বে!
ওদিকে বাড়িতে নতুন কাজের সহযোগি মেয়ে রাখা হয়েছে। সেই মেয়েটাকেও দেওয়া হয়েছে আরবী শিখতে ওই হুজুরটার কাছে। তার মা ভাবতো এটা ফরজ। আল্লাহকে তো হিসেব দিতে হবে, নিজের মেয়ের মত করে কেন কাজের সহযোগী মেয়েটাকে আরবী শেখাওনি?
এতে মেয়েটা কিছুটা রেহাই পেল কারণ হুজুর কাজের সহযোগি মেয়েটার গায়ে সমানে হাত দেয়া শুরু করলো।বিনিময়ে কমবেশি পয়সাও দিত কাজের মেয়েটাকে। এরপর থেকে একের পর এক মেয়ে আসতো কাজে।সবগুলোকে পড়তে দেয়া হত হুজুরটার কাছে আর খচ্চর লোকটাও তার কাজ চালিয়ে যেত। আর তার চোখ দিয়ে গিলে খেত ছোট মেয়েটাকে।
এমন করে একদিন মেয়েটার এসএসসি পাশ হল, শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেল। অবশেষে ওই বর্বর, অসভ্য, খচ্চরের কাছ থেকে রেহাই পেয়ে গেল মেয়েটা।
এই চিত্র প্রায় প্রত্যেক ঘরেই ছিল আজ থেকে দশ বারো বছর আগের সমাজে। এখনকার সমাজের চিত্র বোধকরি সামান্য বদল হয়েছে। বর্তমানে বাচ্চাদের কথার দাম দেন কিংবা কথা শোনেন বাবা মায়েরা। তবে সেটা বোধহয় খুব সামান্য কিছু পরিবারে হয়। সমাজের বড় একটা অংশ তার বাইরে।
তো প্রত্যেক বাবামাদেরকে বলি, আপনারা নিজের সন্তানের কথা শুনুন। তাদের বিশ্বাস করুন সবার আগে। কোন সন্তান যেন নীরবে দিনের পর দিন অ্যাবিউজড না হয়। গৃহশিক্ষক পুরুষ কিংবা নারী যাই রাখুন না কেন তাদের দিকে নজর রাখুন। মনে রাখা জরুরি এবিউজিং পুরুষ কিংবা নারী উভয়ই করতে পারে। নিজের এবং বাচ্চার মনের যত্ন নিন। পারিবারিক কলহে বাচ্চাদের জড়াবেন না বরং কলহ থেকে দূরে রাখুন।
সন্তানের সবথেকে প্রিয় মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন। সন্তানকে কেউ প্রশ্ন করলে যেন তারা বলতে পারে বাবা মা তাদের সবথেকে প্রিয় মানুষ ও বন্ধু। নিজেরা বড় হবার সাথে সাথে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, আপনার বাচ্চারা যেন সেগুলো সানন্দে মোকাবেলা করতে পারে। এই বিষয়টা নিশ্চিত করুন।