কবরী: মালিন্যের শ্যাওলা স্পর্শ করেনি যে রাজহাঁসকে
মাসকাওয়াথ আহসান।। ষাটের দশকের শিল্প-সংস্কৃতির সোনালী যুগে চলচ্চিত্রের রূপালী পর্দায় তখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই; বোম্বে আর লাহোরের ফিল্ম দৃশ্যত একটি রেস; চলচ্চিত্রের রেস কতাটা সুন্দর হতে পারে; তার নয়নাভিরাম প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা চলছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে।
কলকাতার চলচ্চিত্র অবিসংবাদিতভাবে রাজত্ব করছে বাঙালি মননে ও মনীষায়। উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রেমের জোয়ারে উত্তাল রুপালি পর্দা। সুপ্রিয়া সেখানে ত্রিভুজ প্রেমের দ্যোতনা নিয়ে হাজির। রাজকাপুর-নার্গিস, মোহম্মদ আলী-জেবা বোম্বে আর লাহোরের গ্ল্যামারাস ফিল্ম দরিয়ায় তুফান তুলেছেন।
আমার নানা ও দাদা সে সময়ের ফিল্মের পোকা হিসেবে রীতিমত সিনে ম্যাগ ‘উল্টোরথ’-এর নিয়মিত গ্রাহক হয়ে খোঁজখবর রাখতেন চলচ্চিত্র জগতের। পূর্ব-বাংলা আর পশ্চিম-বাংলার এই দুই যুবক তাদের যাপিত জীবনে দৈনন্দিন কাজ আর চলচ্চিত্র দুটোকেই সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন। ফলে কলকাতায় নতুন রিলিজ পাওয়া ফিল্মের প্রথম শো মিস করতেন না দুজনে। সে সময়ের নাইট লাইফ মানে বন্ধুরা একসঙ্গে মুভি দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া আর আড্ডা। এরা দুজন দুজনকে বন্ধুত্বে চিনে নিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে।
সে যুগে ফিল্মে প্রেমের স্বপ্নের পাল তোলা নৌকা যতটা অনায়াসে ভাসতো; যাপিত জীবনে প্রেমের ধারণাটা অতটা স্পষ্ট ছিলো না। বিবাহোত্তর প্রেমকেই দক্ষিণ এশিয়ার সে যুগের অনুশীলন বলে মেনে নিতে হতো। তাই ম্যাচ মেকিং-টা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে বেয়াই-বেয়াইনের ইতিহাস-ভূগোল-সংস্কৃতি দেখে নিতেন রীতিমতো প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগিয়ে।
দুই বন্ধুর একসঙ্গে চলচ্চিত্র দেখার ও গল্পের উষ্ণতা থেকে আমার আব্বা-আম্মার বিয়ের সম্মন্ধ ঠিক হয়। ফলে বুদ্ধি হবার পরেই দেখলাম আমার আব্বা বনাম আম্মার মাঝে কলকাতা ও ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে একে-অপরকে দেখানোর প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা। যেহেতু সীমান্তের কাঁটাতারে বাংলাদেশে কলকাতার চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ প্রায় তিরোহিত হয়েছে; আব্বা তাই টিভিতে দূরদর্শনে একটা কলকাতাই চলচ্চিত্র আম্মাকে দেখাতে; সেই যে লম্বা বাঁশের মগডালে লাগানো এন্টেনাটা কলকাতার দিকে তাক করতে গলদঘর্ম হয়েছেন। পরে ভিসিআর এলে; কলকাতা চলচ্চিত্রের ভিডিও ক্যাসেট এনে টেক্কার মতো ছুঁড়ে দিতেন আম্মার দিকে। আর আম্মার তখন ঢাকার চলচ্চিত্র বেশ করে আব্বাকে দেখিয়ে দেবার অনেক প্রেক্ষাগৃহ; ঈশ্বরদী-পাবনা-রাজশাহী-ঢাকা জুড়ে।
সুতরাং কবরী এলেন আমাদের রুপালি পর্দার মিষ্টি মেয়ে হিসেবে।
কবরীর স্নিগ্ধ-প্লেটোনিক প্রেমই তখন রোমান্টিকতার ‘জলছবি’। এমনকি কী এক ‘বাহানা’য় কবরী জিতে নিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার অ-বাংলাভাষী দর্শকের মন। কবরীর ‘সাত ভাই চম্পা’ সেই কবে বিভাজিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বন্ধুত্বের ইনসেপশান করে দেয়। এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রীর ‘আবির্ভাব’ ঘটে যেন, যার অভিনয় সহজাত, যার ‘বাঁশরি’ মনের দুষ্টু পাখিকে উতল করে। করবীর গ্ল্যামারের ‘যে আগুনে পুড়ি’ আমরা; তাতে স্পষ্ট হয় পূর্ব-বাংলার তথা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র-শিল্প-সাংস্কৃতিক মননের ‘দীপ নেভে নাই’। তাই তো কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা মিথের ‘দর্পচূর্ণ’ করে রাজ্জাক-কবরী ফিল্মি জুটি বাঙ্গালিকে প্রেমের ‘ক খ গ ঘ ঙ’ পড়ালেন। প্রেম কত নির্ভেজাল ভালোলাগার ‘বিনিময়’ হতে পারে; তা আমরা বুঝতে পারলাম কবরীর শিশির ভেজা মুখাবয়বের সৌম্য দ্যুতিতে।
সাগর পাড়ে জন্ম নেয়া এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন; যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতে তিনি ভারতের আগরতলা হয়ে কলকাতা গিয়েছেন শিল্প-জগতের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রোহের শিবিরে যোগ দিতে।
যুদ্ধ শেষ হলে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রে আবার কবরী আনন্দ-বেদনার গল্পের নায়িকা হিসেবে হাজির হন রুপালি পর্দায়। এরপর ‘রংবাজ’ রাজ্জাককে ট্র্যাকে ফেরাতে প্রেমিকা কবরী প্রাণান্ত চেষ্টা করলেও; আমরা এই মুভি দেখে শিশু রংবাজ হয়ে উঠি যেন। আমাদের তো আর অতো অল্প বয়েসে কবরী নেই জীবনে; যে প্রাণান্ত চেষ্টা করবে সুপথে ফেরাতে।
নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’-তে কবরী গ্রাম্যবালিকার চপল সৌন্দর্যের জ্যামিতি হাজির করলেন। তিনি তখন শহর-গ্রাম সব জায়গার হার্টথ্রব। কখনো কখনো কবরী খুব চেনা ‘আগন্তুক’ হতে জানতেন, ‘নীল আকাশের নিচে’ ডানা মেলে দিতে পারতেন; ‘ময়নামতি’-র অনেক সাধের ময়না যেন বাঁধন মানতে চায়না। এই দোলাচলে অনাবাসী স্বামীর জন্য ভালোবাসা সঞ্চিত করে ‘সারেং বৌ’ কবরী আমাদের আস্থার জায়গা জিতে নেন। ‘দেবদাস’-এর পার্বতী কবরী কেন জমিদারকে বিয়ে করলো, খানিকটা ‘অভিমান’ জাগে কবরীর প্রতি। কিন্তু তার ‘হীরামন’ সুতরাং তাকে ভালোলাগার ‘চোরাবালি’-তে আমরা বার বার পড়েছি। এরপর কবরী থিতু হলেন ‘পারুলের সংসার’-এ।
অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে ঢাকা চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্রের সোনালী যুগের ইতিহাসে অনিন্দ্য জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কবরী ‘আয়না’ নামের একটি চলচ্চিত্রে পেশাদারিত্বের ছাপ রাখেন। অংশ নেন রাজনীতিতে। সাংসদ হন। চলচ্চিত্রে দেখা খলনায়কদের দেখা পেয়ে যান রাজনীতির গুমগঞ্জে। সমাজসেবা, নারী অধিকারে সতত সক্রিয় কবরী আত্মজৈবনিকেও রেখে যান তাঁর হীরের নাকছাবি; ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
১৯৬৩ সালে নৃত্য শিল্পী হিসেবে মঞ্চে যার আবির্ভাব তিনি বেতার-টেলিভিশন-চলচ্চিত্র সবগুলো মাধ্যমে শুভ্র রাজহাঁসের মতো গলা উঁচিয়ে সাঁতার কেটেছেন। মালিন্যের শ্যাওলা তার সাদা ডানায় কাদা লাগাতে পারেনি। ‘এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’- এই বাক্যটা কবরীর কণ্ঠেই মানায়। ৭১ বছর বয়সে ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা কবরী-ভঙ্গুর স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বলি হলেন; আততায়ী করোনাভাইরাস প্রতারক স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বেহুলা কবরীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো লখিন্দর বাংলাদেশের ভেলায়। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী কবরীর ‘ভি আইপি হাসপাতালের নিঃশ্ছিদ্র বাসরঘরে’ও ঢুকে পড়ে করোনাসাপ। এই শোকগাঁথায় শুধু লখিন্দরকে নয়; বেহুলাকেও দংশন করেছে স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার দুর্নীতির সাপ।