December 23, 2024
কলামফিচার ৩

নারীবাদ শব্দে কিছু মানুষের এত বিদ্বেষ কেন?

আঞ্জুমান রোজী।। নারীবাদ নিয়ে অনেক রকম জল্পনা কল্পনা, আলোচনা, সমালোচনা, বিভ্রান্তি, কটুক্তি রয়েছে। এই শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিন্তাচেতনাকে  দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। রেখেছে সংশয়াগ্রস্ত করে।  কেউ যখন নারীবাদকে কটাক্ষ করে কথা বলে, মনে হয়, বিষয়টা যেন হীনমন্যতারও চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়।

অনেকের কাছে নারীবাদ বিষয়টি খেলো মনে হতে পারে; তবে এর গভীরতা উপলব্ধি করার ক্ষমতা তাদেরই আছে; যাদের মনুষ্যত্ব আছে। মনুষ্যত্ব বিবর্জিত মানুষের পক্ষে নারীবাদের মর্ম বোঝা আসলেই কঠিন । অথচ এই নারীবাদ শব্দেই নারী ও পুরুষের মৌলিক মুক্তি ও শক্তির  উৎস রোপিত। সেইসাথে প্রোথিত আছে মানবতার রূপ।  বিষয়টি বুঝতে হলে নারীবাদের আদ্যপান্ত বুঝতে হবে।

‘নারীবাদ’ শব্দটিতে  নারী অস্তিত্বের গভীরসত্তা নিহিত আছে। এতে আছে নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা, সচেতনতা এবং নারী অস্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের মূলমন্ত্র। সেইসাথে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে  সমতা।  সমাজের সব  সুযোগ সুবিধা এবং গুরুত্বপূর্ন উপাদানগুলোতে নারীর সমান অধিকারের কথা এসেছে । বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি ও সপ্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই নারীবাদ এসেছে।

নারী তার নিজের জীবনের ওপর, পছন্দের ওপর কর্তৃত্ব করবে এবং বিশ্বব্যাপী  নারীর  ক্ষমতায়ন ও পুরুষের একক কর্তৃত্বের পরিবর্তনই নারীবাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদেশ্য হিসেবে প্রতিপাদ্য হচ্ছে। দয়া  নয়, করুণা নয়, মানুষের মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলার শক্তিই হলো নারীবাদের মজ্জাগত চেতনা।

নারীবাদের প্রথম শর্ত হলো- নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তিই সবকিছুর চালিকা শক্তি।  শিশু বয়স থেকে নারীকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত এ জীবন তার নিজের এবং তা তাকেই গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য যা যা উপকরণ দরকার তার সবরকম সহযোগিতা এবং সরবরাহের পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা নারীকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে হলে এবং  জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হলে তার দৃঢ় মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। যারা এই মানসিকতা রাখেন না, তারাই পরনির্ভরশীল হয়ে সমাজে পরগাছা হয়ে বেঁচে আছেন। তারা হয় পিতার আশ্রয়ে, নাহয় স্বামীর আশ্রয়ে, অথবা সন্তানের আশ্রয়ে কিংবা অন্য কোন অসদুপায়ে বেঁচে থাকার পায়তারা করে। অনেকসময় এই শ্রেণির নারীর জীবনযাপনের জন্যও নারীবাদ শব্দটি প্রশ্নবিদ্ধ  হচ্ছে। অথচ এসবই প্রাগৌতিহাসিক সামাজিক অবকাঠামো, যা পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই অবকাঠামো ভাঙ্গতে হলে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিই প্রথম শর্ত।

নারীবাদের আরেকটি শর্ত হলো, শিক্ষাদীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে মেধা ও মননের সংযোগে কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠা। মননশীল চিন্তা-চেতনায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করা।  সৃষ্টিশীল কোনো না কোনো কাজে মনোনিবেশ করা।  নিজের ভেতরে নিজেকে আবিস্কার করা এবং নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার মানসিকতা তৈরি করা। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। উপযুক্ত শিক্ষাই শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান সহায়ক। শিক্ষাই মুক্তি, শিক্ষাই  জীবনের  আনন্দ।

নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, সমঅধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করা, সকল পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণে নারীকে উদ্বুদ্ধ ও দক্ষ করা, দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র বিমোচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সেই সাথে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়তা করা, সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ্যময় পরিবার গঠনে উৎসাহিত করা এবং যৌতুক ও নারী নির্যাতনরোধ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মপ্রত্যয় নারীর মধ্যে সৃষ্টি করা যা নারীবাদ শব্দের  অলংকার।

বাস্তবতা এমনই যে, বাংলাদেশে নারীশিক্ষার অগ্রগতি হলেও, এমনকি  জাতীয় সংসদে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও নারী পরিবার বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন  সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে। অন্যদিকে নারী নির্যাতনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, শ্রমের মূল্যায়ন, নারীর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া এখনও দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নারী মুক্তির আন্দোলনে নারীবাদ বিষয়টি বাস্তবতার আলোকে আরো জোরালো হবে, হবে আরো সোচ্চার। প্রত্যেকটি নারী যদি  সচেতন হয় তবে অনতিবিলম্বে এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই।

সর্বোপরি নারীই পারে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে। যদিও পুরুষশাসিত সমাজ তা কখনওই চায়নি, চাইবেও না হয়তো। এক্ষেত্রে নারী নিজেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে কীভাবে তার অর্থনৈতিক এবং মানসিক মুক্তি আসবে, তার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর সেভাবেই অনেক নারী পুরুষের সাথে সমান তালে এখন কাজ করে যাচ্ছে। নারী স্বাধীনতা এবং নারী ক্ষমতায়নে মুখ্য ভূমিকাও রাখছে অনেক নারী। অথচ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘নারীবাদ’ শব্দটি যেনো  পুরুষবিদ্বেষী শব্দরূপে পরিগণিত হচ্ছে।

কিন্তু কেন?

এই বিদ্বেষভাব অনেক তথাকথিত সচেতন পুরুষের কাছ থেকেই আসছে, আবার অনেক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারীও নারীবাদের বিপক্ষে বিদ্রুপ ভাব প্রকাশ করছে। সেটার জন্য হয়তো প্রথা না ভাঙ্গার মানসিকতা কিংবা প্রগতির পথে পা বাড়াতে বা পরিবর্তন না মেনে নেওয়ার মানসিকতাই দায়ী। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ‘নারীবাদ’ শব্দের ছত্রছায়ায় এমন কোন নেতিবাচক কিছু হয়ে থাকলে তা নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। তাই বলে ‘নারীবাদ’ শব্দটিকে কটাক্ষ করে কেন?

সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকলে একটি স্বাস্থ্যবান সমাজ গড়া সম্ভব নয়। একইভাবে তা কখনওই গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে দাবি করতে পারবে না।

নারীবাদ শুধু নারীর জন্য নয়, পরিবার, সংসার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য নারীবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  নারীবাদ  দিতে পারে  সুস্থ সমাজ, সংসার এবং রাষ্ট্র। নারীবাদের বিপক্ষে বিদ্বেষভাব দেখিয়ে যারাই নেতিবাচক ইঙ্গিত দেবেন, তাদের বিশেষভাবে জানা উচিৎ নারী পুরুষে সাম্য মৈত্রী তৈরি না হলে দেশ ও জাতি কখনও উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে পারবে না। উন্নতবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়।

অতএব, জয়তু নারীবাদ!

 

আঞ্জুমান রোজী: লেখক ও কথাশিল্পী

[ ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের কলাম হিসেবে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *