December 25, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

কেন রে চড়লি ওরে বাবুদের জুড়িগাড়িতে

মাসকাওয়াথ আহসান।।

মনোহরপুরের সেই খুব আদরের মেয়েটি; যার জন্য পুকুরে জাল ফেলে মাছ তোলা হতো, যার জন্য নবান্নে ফুল পিঠায় হেসে উঠতো বাড়ির উঠোন। সবার আদরের এই মেয়েটি পড়াশোনায় তীক্ষ্ণ ছিল। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব বলতেন, মা তুই অনেক গুণীরে। তোর পরীক্ষার খাতাও যেমন, গানের গলাও তেমন, আচার-ব্যবহারেও উত্তম।

স্থানীয় চেয়ারম্যানের ডাগর পোলাটির খুব পছন্দ ছিল মেয়েটিকে। কিন্তু বাপ ধমক দিয়ে বলেছিল; হোন্ডায় চইড়া গুন্ডামি কইরা বেড়াও ঠিক আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার মাইয়ার দিকে যদি চোখ দেস; আমি তোর চক্ষু তুইলা কুত্তা দিয়া খাওয়াইয়া দিমু।

সেই থেকে চেয়ারম্যানের ছেলেটি দেবদাস হয়ে যায়। বিলের মধ্যে কাকুতাড়ুয়া টং ঘরে দেশি খুশিজল খেয়ে পড়ে থাকে। পার্বতী তখন ঢাকায় কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজ তো নয় বেহেশতের বাগান যেন। সেইখানে পাপিয়া আপু উন্নয়নের পিউ-পাপিয়া ফেস্টের ব্যাকোয়ার্ড লিংকেজ খুলেছে। জাপানে গেইসাদের যেভাবে সাজগোজ, কথাবার্তা, সাহিত্য-সংস্কৃতির দুটি লাস্য শেখানো হতো; সেইভাবে রূপশীলন করান অপরাজিতা দিদি। দিদি বোঝান, আমরা আসলে সমাজসেবা করি। এই দেশে ধনীর সব আছে, শুধু প্রেম নেই। আমরা তাদের স্ত্রীর কারাগার থেকে অন্তর্বতীকালীন জামিনে প্রেমের রিমান্ডে নিয়ে যাই।

পাপিয়া আপু চূড়ান্ত ‘লাল চড়ুই’ সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে বলেন, বাবুদের কোলে এই রাষ্ট্র-পুলিশ-আদালত-মন্ত্রীসভা দোলে; আর তোমাদের কোলে বাবুরা দুলবে। আজ থেকে তোমরা অন্যরকম ক্ষমতায়িত হলে।
অপরাজিতা আপু বলেন, তোমরা মাতাহারির নাম শুনেছো, জার্মান নারী; সে রাতের রজনীগন্ধা হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতো। রাশান রেড স্প্যারোদের নাম শুনেছো, এক্ষুণি গুগল করো; কেউ যদি স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো, সমালোচনা করতো, রেডস্প্যারোরা গিয়ে তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতো। তোমরা বাবুদের প্রেম দেবে, আর আমাদের দলের সমালোচকদের সঙ্গে গেম দেবে, কেমন!

মনোহরদির মেয়েটি এতো জটিল ব্যাপার বুঝে উঠতে পারে না। অপরাজিতা আপু ধমক দেয়, এই মেয়ে তুমি অন্যমনষ্ক কেন! খবরদার এইসব উন্নয়নের প্রেমকে সিরিয়াসলি নেবে না। এগুলো গেম, সবই গেম। খেলা হবে!

থমাস হার্ডির টেস অফ ডি’আরবারভিলস উপন্যাসের টেসের মতোই মনোহরদীর টেস এক ফেইক এলিট এলেক ডারবারভিলসের প্রেমে পড়ে যায়; ওয়েস্টিনে ক্রিসমাসের পার্টিতে।

মনোহরদীর চেয়ারম্যানের ছেলেটি বেহেশতের বাগান মহাবিদ্যালয়ের হোস্টেলের গেটের কাছে চিরকুট পাঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সেটা চোখে পড়ে যায় অপরাজিতাদির। তিনি এ খবর পাপিয়াকে জানালে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জওয়ান হেলমেট পরে এসে হাতুড়ি নিয়ে তাড়া করে মনোহরদীর চেয়ারম্যানের ছেলেকে। সে প্রাণপণে দৌড়ে সুমিল্লার বাসে উঠে প্রাণ বাঁচায়। তারপর দুই কানি জমি বেচে স্যুট কিনে ওয়েস্টিনে ঢুকে পড়ে। ক্রিসমাস পার্টিতে দেখে, মনোহরদির সেই হলুদিয়া পাখি আজ লাল পাখি; রেড স্প্যারো, গল্প করছে শিল্পপতির সঙ্গে। উন্নয়নের শিল্পপতি। তার বাবা সেই বিশেষ দূতের আমল থেকে উন্নয়নের সেবা করছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শোকে সেই বাবা সবসময় মাটিতে ঘুমাতেন। জাতির জনক মাটিতে ঘুমিয়ে আছে, সে কী করে পালংকে ঘুমায়! জিয়ার মৃত্যুশোকে উইকএন্ডে সে কোদাল দিয়ে খাল খনন করে। ১৯৯০ এর দশকে সিমেন্ট, কাগজ, টিস্যু পেপার এবং ইস্পাত উৎপাদন, এলপি গ্যাসের বোতলজাতকরণ এবং বিতরণের পাশাপাশি আরও অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করে সেইসব পণ্য খালপথে বিপণন করে। সুতরাং সে উন্নয়নের বাবার ছেলে শাহজাদা ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিয়া মন; আছে তার শৌর্য-বীর্য আর ধন।’

মনোহরদীর পাখিটিকে স্বপ্ন দেখায় রাজমহলের বেগম করার। স্বপ্নের ঘোরে মেয়েটি শিকারীর ছলনার শরবিদ্ধ হয়। আহত হরিণীর মতো শাহজাদার কাঁধে মাথা রেখে প্রেমে সরসিজ ফোঁস ফোঁস করে কাঁদলে, শাহজাদা বলে, পুষ্পা আই হেইট টিয়ার্স। চলো তোমাকে আজ বজরা নৌকায় তুলি। আর হোস্টেলে থাকার দরকার নেই। তুমি থাকবে আমার উত্তরা মহলে।

মনোহরদীর দেবদাস চেয়ে চেয়ে দেখে তার পরাজয়। স্যুট-টাই পরে গুলশান লেকে ঝাঁপ দেয় খুশিজলের ঘোরে। মাথাটা তুলে দেখে একটা শাহী নৌকায় শাহজাদার অংকশায়িনী তার মনোহরদীর হলুদিয়া পাখি; সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িলো কে!

২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত কর ফাঁকির মামলায় শাহজাদার বিজনেস গ্রুপের কর্মকর্তাদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন প্রণয়ন ব্যবসায়ী সমিতি, মিডিয়া বাঈ; সবাই যখন হেইলা-দুইলা দরবার নাচায়; তখন আইন তো তার হাতে খেলনা।

টিভিতে একটা খালি অ্যাপার্টমেন্টে মনোহরদীর মেয়ের লাশ ঝুলছে- এ খবর পেয়ে মনোহরদীর চেয়ারম্যানের ছেলেটি ছুটে আসে বাইক নিয়ে। পুলিশ ঘিরে রেখেছে চারপাশ। রাস্তায় ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে যুবক আর্তনাদ করে, কেন রে তুই চড়লি ওরে বাবুদের জুড়িগাড়িতে!

২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর শাহজাদার কোম্পানীর জমির দাম নিয়ে মোহাম্মদ শাহজাহান ‘জালিয়াতির’ অভিযোগে কোম্পানির চেয়ারম্যান বটতলার উকিল থেকে বাদশাহ আকবরের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ঐ উন্নয়নের কোম্পানি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাংলাদেশের কেরানীগঞ্জে দুটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে। ২০২০ সালে উন্নয়নের কোম্পানিটি বাংলাদেশের বৃহত্তম বিটুমিন প্লান্ট তৈরি করতে ১৪৩.৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই কারখানাটি এককভাবে বাংলাদেশকে বিটুমিন উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সহায়তা করবে এবং উদ্বৃত্ত বিদেশে রফতানি করা যাবে। অন্যদেশের বাণিজ্যিক কোম্পানি থাকে; এই এইখানে বাণিজ্যিক কোম্পানিদের একটি দেশ আছে। ফকির-বটতলার উকিল; সরকারের সহমত ভাই থেকে বাদশাহ আকবর হয়ে ওঠে কোম্পানির মালিকেরা। তাদের স্ত্রী কুলসুমেরা বাদি থেকে বেগম হয়।

আর তাদের শাহজাদারা বুনো ষাঁড় হয়ে হোটেল রেনট্রি থেকে ওয়েস্টিন, সেখান থেকে মিসট্রেস লজ দাপিয়ে বেড়ায় পৌরুষহীনতা লুকিয়ে পৌরুষ দেখাতে। তাদের হাতে স্বপ্ন খুন হয়; কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকা সোসাইটি শাহজাদাকে ঠিকই বাঁচিয়ে এয়ারবাসে তুলে দেয়; কিংবা লুকিয়ে ফেলে খবরের শিরোনাম ও অপরাধীর নাম-পরিচয় আড়ালে রেখে।

বিজনেসে অ্যাংজাইটি নাই; পুলিশ-আদালত-মিডিয়া শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে ওস্তাদ। যত অ্যাংজাইটি পালংকের টি টোয়েন্টি ম্যাচে। বার বার এই ম্যাচ হেরে গিয়ে শাহজাদারা হত্যা করে লাল চড়ুই কিংবা হলুদিয়া পাখিদের। সম্মিলিত আঞ্জুমানে মফিদুল জোট মর্গ থেকে লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মনোহরদী পৌঁছে দিলে; সেই ব্যর্থ প্রেমিক চেয়ারম্যানের ছেলে অপ্রকৃতস্থ হয়ে বিলের কাকতাড়ুয়া ছনে ছাউনিতে শুয়ে কাঁদে, পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না; ওকে গাইতে দাও।