November 23, 2024
কলামফিচার ৩

‘রক্ষিতা’ ও সমাজের অবদমিত মনের সুরাহা

সেঁজুতি জাহান জিনাত।। শব্দটি ছিল: ‘রক্ষিতা’। গত কয়েকদিন ধরে শব্দটি নিয়ে যার পর নাই নাড়াচাড়া হয়েছে/হচ্ছে। এতোটা হয়েছে যে রীতিমিতো চুইংগামের মতো বা লেবুর খোসা চটকানোর মতো তিতা তিতা হয়ে গেছে। আজকে আমিও একটু কচলাতে বসলাম। আশা করি শেষ মেষ কিছু খোসা মাটিচাপা দিতে সক্ষম হবো।বিচক্ষণ পাঠক, সাথে থাকবেন তো?

মুনমুন আপু একটা লেখা দিতে বললেন চলতি বিষয়ের ওপর। ভাবলাম, এটা এমন এক বিষয় যা শুধু চলতি নয়, প্রচলিত ও পৃথিবীর জন্মপরবর্তী প্রবাহিত একটি বিষয়। সেই আদম-হাওয়া (আ.)-এর গন্ধম ভক্ষণ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এক আদিপাপ মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে। অনুশোচনার চেয়ে তথাকথিত শয়তানি যুক্তিসমেত সব ধরনের পাপ প্রতিষ্ঠাই যেখানে মুখ্য হয়েছে সব সময়।

ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে অনেকেই জানেন হয়ত যে, ১২শ শতাব্দীর দিকে তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এরতুগুল গাজীর মাধ্যমে, এবং তা বেশ প্রসারিত ও প্রভাবিত হয়েছিল উসমানীয় খিলাফাতের নামে, ১৫শ শতক থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে খিলাফাত বীরদর্পে বহাল ছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে যা ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

এই গৌরবময় মুসলিম শাসনের অন্তরালে যে হেরেমের অভিশাপ ছিল, তাও কিন্তু অনেকেরই জানা। কবি নজরুলের খুব বিখ্যাত গান- ‘হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ফেরে, তুমি শুনিতে কি পাও’। এ সম্রাটদের মনোরঞ্জনের জন্য দেশ বিদেশ থেকে পশুর মতো ধরে ধরে আনা রূপবতী নারীদেরকে, বন্দী করে রাখা হতো যে হেরেমে, তার করুণ কান্না এ গানে উঠে এসেছে।

হুমায়ূন আহমেদের ‘পায়ের তলায় খড়ম’ বইটি পড়ে অনেক পাঠকেরই ‘হেরেমের বন্দিনী’দের জন্য হৃদয় কেঁদে উঠেছে। আর দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিয়ালের মাধ্যমে বা বর্তমানে ইউটিউবের বদৌলতে ‘এরতুগুল গাজী’ র মাধ্যমে ‘হেরেমের বন্দিনী’ সম্পর্কে প্রায় সব ধরণের দর্শকই অবগত।

রাজা ৪র্থ উইলিয়ামের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়া চার্লস গ্রের প্রেমিকা জর্জিয়ানা তাঁর স্বামী ডেভেনশায়ারের ডিউক উইলিয়াম কেভেলিশের দ্বারা যেভাবে প্রতারিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল পরকীয়া। প্রেম নয়, কেবল শরীবৃত্তি। জর্জিয়ার বান্ধবী লেডি বেস ফস্টারের সঙ্গে এই সম্পর্কে জড়িয়ে যায় ডিউক অব ডেভেনশায়ার। তিনি ডিউক, ফলে যাকে যেভাবে চাইবেন তাকে সেভাবেই পাবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। স্বামীর অমনোযোগ, কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে নির্যাতিত হয়ে চার্লস গ্রের সঙ্গে প্রণয়ে আসক্ত হন জর্জিয়া। সে খবর গোটা ডেভেনশায়ার জানতো, কিন্তু স্বামী উইলিয়াম কেভেলিশ ও বান্ধবীর সম্পর্কটি জানতো না তেমন কেউ, কারণ এ সম্পর্কে তো হৃদয়ের সংযোগ ছিল না।

হলিউডের ভুরি ভুরি সিনেমা আছে যেখানে বিষয়বস্তু হিসেবে নারীদের প্রতি ক্ষমতাসীন পুরুষতন্ত্রের নির্যাতনের বলিরেখা এভাবে ধরা পড়ে। এছাড়া ইতিহাস তো আছেই।

এতো গেল ইউরোপের কথা। ভারতের মুঘল শাসনামলে বা তার আগে-পরেও রাজা বা সম্রাটদের মনোরঞ্জনের জন্য যারা থাকতেন তাদেরকে ‘বাঈজি’ বা ‘নর্তকী’ বলা হতো। এরা শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে শাস্ত্রীয় নাচ দেখাতেন। অনেক রাজা বা সম্রাটই প্রণয়ের সম্পর্কের অভিনয় করে বা কেবল অবস্থানের জোরের ওপর ভিত্তি করে শরীরের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য এইসব ‘বাঈজি’দেরকে বাধ্য করতেন নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য।

কোনো কোনো বাঈজি এসবে আনন্দ পেতেন হয়তো (তাদের অন্তরের খবর জানা নেই), তবে অধিকাংশই চাইতেন রাণী বা প্রণয়িনী হতে। হিন্দী বা কলকাতার অসংখ্য বাংলা সিনেমায় অথবা ইতিহাসের আদ্যোপান্ত ঘাটলে ক্ষমতা বা অর্থের পাশাপাশি  নারীদের  এমনতর দুর্দশা সহজেই চোখে পড়বে।

ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে পুরোহিতদের প্ররোচনায় বহু নারীকে ফতোয়া দিয়ে ধরে আনা হতো সেবাদাসী করে, যাদেরকে বলা হতো ‘দেবদাসী’। দুর্দশাগ্রস্ত নারীদেরকে নানান ফতোয়া দিয়ে ভোগ করার ঘটনা অনেক মওলানা মৌলবীর মধ্যেও ছিল বা আছে। ইসলাম সকল ধরণের ভোগবাদিতাকে হারাম করেছে, কিন্তু তাতে কী? ফতোয়া আছে না?

যুগে যুগে ফতোয়ার জালে, ক্ষমতার জোরে, অর্থশালীর প্রণয়-নাটকের খপ্পরে আটকে কতো কতো নিরীহ নারী যে নিঃশেষ হয়ে গেছেন, ইতিহাস খুব কম খবরই রেখেছে। পাঠক হয়ত বলতেই বলতে পারেন, তাহলে নারীদের কি কোনো দোষ নেই, তারা কি এ ব্যাপারে অনগ্রসর থেকেও ভিক্টিম হন?

মোটেও তা নয়। অনেক নারীই হয়ত এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ নারীই শরীরের চেয়ে নিজের হৃদয়ের যত্ন নেবার পার্টনার খোঁজেন। এমনকি যারা রূপোপজীবিনী, তাদের মধ্যে জরিপ করে দেখতে পারেন; তাদের দায়িত্ব যদি কেউ আন্তরিকতার সঙ্গে নেয় তাহলে তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। অতীতে ‘বাঈজি’দের কেউ কেউ রাজাকে ভালোবেসে, ভালোবাসা দিয়ে হয়ত রাণী হতে চাইতেন, হয়ত রাজাকে প্রস্তাবও দিতেন তার রাণী হবার। বিনিময়ে হয়ত রাজা তাদেরকে ‘রক্ষিতা’ বলে গালি দিয়ে নিজের পরিবারমুখী হতেন। সেই সব  ‘বাঈজি’রা হয়ত আত্মহত্যাও করত!

ইতিহাস আমাদেরকে মমতাজ আর ‘তাজমহল’কেই দেখায়, গোপনে আত্মহত্যা করা তারাবানুর খবর সাত আসমানে জমা থাকে হয়ত! শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীকে যেভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, আজকের পরিস্থিতি তার থেকে খুব একটা উন্নত হয়নি।

তো, মুনমুন আপুকে জিজ্ঞেস করলাম কী বিষয়ের ওপর লিখবো। উনি কালবিলম্ব না করে জানালেন ‘রক্ষিতা’ শব্দটির ওপর লেখেন।

‘রক্ষিতা’। প্রথমেই ডিকশনারিটা হাতে নিলাম। ‘রক্ষিতা’ শব্দের অর্থ যা পেলাম তা হলো:

১. পালিতা (সংস্কৃত রক্ষিত+আ প্রত্যয়), উপপত্নী (বাংলায়)

২. রক্ষাকারী, পরিত্রাতা।

এর স্ত্রীবাচক শব্দটি হল ‘রক্ষিত্রী’।

কিন্তু, ‘রক্ষিত’ অর্থ হল:১. গচ্ছিত, পরিত্রাণ পেয়েছে এমন, লালিত

২.পদবিশেষ। যেমন: অমিতাভ রক্ষিত (আদম ও ইভ এর লেখক)

এই পদবীর অর্থ হলো ভালো বন্ধু।

এত্তগুলো অর্থের ভেতর থেকে আমরা বাঙালিরা ব্যবহার করতে শুরু করলাম ‘উপপত্নী’ শব্দটি। যদিও শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই ‘ভাষা’র শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তো,  আমরা কোনো পরিস্থিতি না জেনে, না বুঝেই যত্রতত্র শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করি। এবং এমন সুন্দর একটি শব্দের নেতিবাচক অর্থটি প্রতিষ্ঠা করে দিই। ব্যাপারটিকে অনেকটা নতুন একটি শব্দ শিখে সবখানে তা ব্যবহার করার মতো আনন্দ ভোগ করার মতো আর কি!

ইংরেজিতে ‘উপপত্নী’র এক ধরনের প্রচলিত পরিভাষা হল ‘সুগার ড্যাডি’। এটা আরও এক কাঠি সরেস। ‘বাঈজি’দের সবাই সম্রাটের কন্যা বা নাতির বয়সী না হলেও তারা জলসা ঘরে আসতেন, রাজা বা সম্রাটদের  উপপত্নীও হতে পারতেন। কিন্তু ইংরেজ মুলুকে ‘সুগার ড্যাডি’র সঙ্গে বয়সের পার্থক্য হবে পিতা-কন্যা বা দাদু-নাতনির সমান।

আহা, অভিশপ্ত পুরুষতন্ত্র! কি নারী কি পুরুষ, কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, কি জ্ঞানী কি মূর্খ- নিজের আয়ত্তের বাইরের কাউকে আয়ত্তে আনতে না পারলে ‘রক্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার করে নিজের অবদমিত মনের একটা সুরাহা করে ফেলে।

মানুষ নারীও হতে পারে পুরুষও হতে পারে, মূর্খও হতে পারে জ্ঞানীও হতে পারে কিন্তু অবচেতনে প্রায় সবাইকেই এক বলে মনে হয়।

মুনিয়া বা ঝর্ণা, আঙ্গুরলতা বা কল্যাণী রায়, হুররাম বা লেডি বেস ফস্টারকে আমরা ইচ্ছামতো ‘রক্ষিতা’ বলে গালি দিতে পারি। কিন্তু এরা যাদের দ্বারা রক্ষিতা তাদেরকে গালি দেবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমরা হয় ক্ষমতাবান হবার অপেক্ষায়, না হয় ক্ষমতাবানের পায়ে পড়ে থাকবার অপেক্ষায় থাকি। তাই নারীকে যেন এমন ‘রক্ষিতা’ অভিধায় অভিষিক্ত হতে না হয় সে চেষ্টা আমাদের না থাকলেও চলে। অর্থ, ক্ষমতা, ধর্ম বা সামাজিক প্রতিপত্তি যদি কারো বাগে থাকে, তাহলে এসব নারী ফারী নিয়ে ফালতু কথা বলার সময় থাকে নাকি? এর চেয়ে বরং চাহিদামাফিক কোনো মেয়ে পটানোতে সময় দেই না! কী বলেন? আর এসব নিয়ে যারা কথা বলে তাদেরকে ‘রক্ষিতা’ বলে পুরুষতন্ত্রের বাহুজোর দেখিয়ে দিলেই সব ঠিক।

পরিশেষে বলতে চাই চলুন না, নজরুলের ঐ গানটা শুনতে শুনতে একটু অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনা করি-

“চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়

আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়”

ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর কয়দিনের!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]