যৌন-শিকারি কারা? চিনে নিন ওদের, সাবধান হোন
মেহেরুন নূর রহমান।। আহারে মুনিয়া পাখি! মিষ্টি একটা মেয়ে কীভাবে চলে গেল! আর মরে যাবার পরও রেহাই নাই। ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন হচ্ছে, গালিগালাজ চলছে তো চলছেই। মাঝে মাঝে ভুলে যাই, কিন্তু এ রকম এক একটা ঘটনা আমাকে মনে করিয়ে দেয় কী রকম তীব্র নারীবিদ্বেষী অসভ্য, বর্বর, নোংরা একটা দেশে আমরা বাস করি। নারীর প্রতি ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে আছে তৃণমূল পর্যন্ত। সুযোগ পেলেই তার কদর্য মুখ বেরিয়ে আসে।
বিশ একুশ বছরের একটি মেয়ে মরে গেছে। মৃত্যুটা প্রশ্নবিদ্ধ। হত্যা না আত্মহত্যা এখনো জানা যায়নি ঠিকমত, আর সবাই উঠে পড়ে লেগেছে মেয়েটাকে দোষ দিতে। বলা হচ্ছে এই মেয়েটির সাথে দেশের বিখ্যাত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক পুত্রের প্রণয় ছিলো। যেহেতু বিশ/একুশ বছরের অবিবাহিত কলেজ পড়ুয়া একটি মেয়ে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় লাখ টাকা ভাড়ার বাড়িতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো, তাই মনে করা হচ্ছে তার প্রেমিক সব খরচ বহন করত। তো লোকজন গণহারে মেয়েটিকে বেশ্যা, রক্ষিতা, গোল্ড ডিগার ইত্যদি ইত্যদি বলে যাচ্ছে। তার প্রেমিক লোকটি যদিও এ ধরণের কোন উপাধি পাচ্ছে না।
জানি অরণ্যে রোদন হবে তারপরেও কয়েকটা কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। মেয়েটিকে গালিগালাজ করার আগে কিছু জিনিস একটু ভাবুন।
মেয়েটি যখন মারা যায় তখন তার বয়স বিশ বা একুশ। তো আনভীর নামক পুরুষটির সাথে সম্পর্কের শুরুতে তার বয়স ছিল বড়জোর আঠারো কিংবা উনিশ। নিতান্তই অল্পবয়সী, অনভিজ্ঞ, বাচ্চা একটা মেয়ে। সুন্দরী বলে হয়তো পুরুষদের স্তুতি শুনেই বড় হয়েছে। তাদের নিষ্ঠুরতা, অবহেলা, কুৎসিত ব্যবহার এসবের সাথে তেমন পরিচিতি না থাকারই কথা। এই বয়সে চোখ জুড়ে থাকে স্বপ্ন। যুক্তির চেয়ে আবেগ দিয়েই চালিত হয়। অনভিজ্ঞতার কারণে মানুষকে বিশ্বাস করার প্রবণতাও থাকে বেশি।
মেয়েটির বাবা-মা নেই। সুতরাং মেয়েটিকে শাসন করবার, বোঝাবার, গ্রাউন্ডেড করে রাখবার মতো তেমন কেউ ছিল না। পিতৃ-মাতৃহীন অল্প বয়সী মেয়েটিকে আমি ভালনারেবল-ই বলবো। এরকম একটি মেয়ের চোখ বিত্ত-বৈভবের ঝলকানিতে ধাঁধিয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করা তেমন কিছু কঠিন নয়। ধুরন্ধর যে কেউ সহজেই মেয়েটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারবে। আর ঠিক এই কাজটি করেছে আনভীর নামক প্রবঞ্চকটি।
বিত্তবান, ক্ষমতাধর, বিবাহিত একজন পুরুষ যে কিনা তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, অনভিজ্ঞ, অর্থনৈতিকভাবে সমকক্ষ নয় এমন একজনকে প্রলুব্ধ করে সোনার খাঁচায় আটকে রেখেছিলো। সভ্য দুনিয়ায় একে অ্যাবিউজ বলে এবং এই ধরনের পুরুষদের বলে সেক্সচুয়াল প্রেডিটার বা যৌন শিকারি।
বিত্তবান এবং ক্ষমতাধর একজন মানুষ যখন তার অসম (বয়সে অনেক ছোট, অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে অধঃস্তন ইত্যাদি) কারো উপর ভয় বা প্রভাব-প্রতিপত্তি বা অসৎ উদ্দেশ্যে প্রলোভিত করে শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তিগত তৃপ্তি বা আনন্দ লাভের জন্য তখন এই ধরনের কাজকর্মকে অ্যাবিউসিভ কাজকর্ম বলা হয় এবং এই মানুষটিকে বলা হয় অ্যাবিউসার বা প্রেডিটার।
অনেক বছর আগের কথা বলছি। আমাদের বাসায় মধ্য পঁচিশের এক তরুণী কাজ করতে এলো। সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন । জানা গেল গরীব ঘরের মেয়ে, যখন সে কিশোরী তখন তাদের পরিচিত এক পুরুষ যে কিনা তার থেকে বিশ বছরের বড় এবং বিবাহিত এবং কয়েক বাচ্চার বাবা, সে তাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই লোকটা মেয়েটিকে বিয়েও করে এবং কয়েক বছর পর মন ভরে গেলে অবলীলায় তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে ভালো মানুষের মত নিজের স্ত্রী পুত্র-কন্যাদের কাছে ফিরে যায়। অবশ্য পুরুষটি শুরু থেকেই দু’দিকেই সম্পর্ক রেখে যাচ্ছিল। এই ঘটনার পর ছোট একটি বাচ্চা নিয়ে মেয়েটি অথৈ পানিতে। বিয়ে যেহেতু রেজিস্ট্রি করে হয়নি তাই মেয়েটি কিছুই দাবি করতে পারেনি। লেখাপড়াও তেমন ছিল না যে নিজে কিছু করবে। এক পর্যায়ে ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের বাসায় গৃহকর্মের জন্য এসে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলেছিল সে হয়তো আত্মহত্যা করত শুধু বাচ্চাটার জন্য পারছে না।
এ রকম অসংখ্য সেক্সচুয়াল প্রেডিটার বা যৌন শিকারি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভালো জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে কয়েক বছর সহবাস তারপর লাথি দিয়ে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া। অসহায় বোকা মেয়েগুলো তখন মরে, না হয় হারিয়ে যায় অতল অন্ধকারে। আর তাকে অ্যাবিউজ করা শিকারী পুরুষটি বুক ফুলিয়ে পরিবারের সাথে বসবাস করে। এসব খবর অনেক সময় প্রকাশ পায় না আর প্রকাশ পেলেও তাদের খুব একটা সমস্যা হয়না। পরিবার, সমাজ সবাই তাদের মাফ করে দেয়। বেশ্যা, রক্ষিতা, পতিতা এসব শুধু নারীদের জন্য, পুরুষদের জন্য নয়।
মুনিয়ার একটি ফোনালাপ শুনলাম। কি জঘন্য নোংরা ভাষায় আনভীর নামক পুরুষটি মেয়েটিকে গালিগালাজ করছিলো। এক সময় এই লোকটিই না জানি কত প্রেমের মধুর ফুলঝুরিতে মেয়েটিকে ভুলিয়েছিলো।
দুঃখ হয় এই বয়সে একটি মেয়ে নিজের জন্য স্বপ্ন রচনা না করে কি করে এসব রাক্ষসদের ফাঁদে পা দেয়। কেন লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা না ভেবে অন্যের দেখানো ঝা চকচকে জীবনের প্রলোভনে বিভোর হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা ভালো তবে তা যেন নিজের সর্বনাশের কারণ না হয় সেই বোধও থাকা দরকার।
আমাদের পরিবার, সমাজ এমনভাবে একটি মেয়েকে বড় করে যেন একটি পুরুষ ছাড়া তাদের জীবন অসম্পূর্ণ। লতার মতো একটি পুরুষ বৃক্ষকে জড়িয়ে থাকাই জীবন সেটা মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও কিংবা অত্যাচারিত হলেও।
অথচ আমাদের মেয়েদের এমন ভাবে বড় করা উচিৎ যেন তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে। পরনির্ভরশীল না হয়, পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়। পুরুষদের জীবনের সকল সুখের চাবি না ভেবে নিজেকে সুখি করার, নিজের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিজে নেয়। আপনার পুরুষ সঙ্গী আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তবে তাকে সমগ্র জীবন ভাবার কোন কারণ নাই।
এখন কথা হলো অল্পবয়সী বা যেকোনো বয়সের মেয়েরা এই ধরনের শিকারি পুরুষদের পাল্লায় পড়তে পারে। আপনি যদি বুদ্ধিমান হন তবে কিন্তু একটু সচেতন হলেই আপনি এদেরকে চিনতে পারবেন। এসব পুরুষদের কিছু কমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। নিজেরাও বুঝুন এবং আপনার অল্প বয়সী কন্যা, বোন, বন্ধুদেরও বোঝান। মনে রাখা দরকার এ ধরনের সেক্সচুয়াল প্রেডিটারদের ফাঁদে অনভিজ্ঞ অল্পবয়সী ছেলেরাও পড়তে পারে।
চলুন দেখি তারা সাধারণত কেমন হয়।
সম্পর্কের শুরুতে খুব মনোযোগী হয় এরা। অনেক কল/টেক্সট পাঠায়। দামি উপহার দেয়, সত্য/মিথ্যা প্রশংসা করে। অনেক যৌন শিকারিরা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যে তার শিকার তার উপর নির্ভর করতে শুরু করে। তারা ভালোবাসা দেখায়, কেয়ার দেখায়। এভাবে আসলে তারা তাদের শিকারকে গ্রুমিং করে। তাদের অধীনে নিয়ে আসে। ভালোবাসা, যত্ন, মনোযোগ পেতে আমরা সবাই ভালবাসি কিন্তু এসব যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ের বলে মনে হয়, অনেকটা too good to be true, তবে সাবধান হোন। সময় নিন গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়বার আগে। জীবন রূপকথা কিংবা সিনেমা নয়, এটা মনে রাখবেন।
আগেই বলেছি এরা কথা এবং কাজে ভীষণ ধান্ধাবাজ বা ম্যানিপিউলেটিভ হয়। সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর এরা ধীরে ধীরে গ্যাসলাইটিং করা শুরু করে।
গ্যাসলাইটিং হচ্ছে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা চালাকির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আরেকজনের বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, উপলব্ধি এসবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নিজের মতো চালিত করে। গ্যাসলাইটিং এর ভেতরে থাকা মানুষেরা প্রায়শই বিভ্রান্ত উদ্বিগ্ন এবং নিজেকে বিশ্বাস করতে অক্ষম হয়। এভাবে গ্যাসলাইটিং এর মাধ্যমে একজন যৌন শিকারি তার শিকারেরকে কন্ট্রোল করতে শুরু করে।
সেক্সচুয়াল প্রেডিটাররা তার সঙ্গী বা শিকারের বক্তব্যকে ম্যানিপিউলেট করে। ইমোশনালি বিভিন্ন ধরনের চাপ দিয়ে শিকারকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। গ্যাসলাইটিং এর মাধ্যমে এসব প্রেডিটাররা এমনভাবে তাদের শিকারকে ম্যানিপিউলেট করে যে তারা শিকারির অনেক খারাপ ব্যবহারের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করে। আপনি যদি আপনার সম্পর্কের ভেতর এ ধরনের চাপ অনুভব করেন, অস্বস্তি বোধ করেন, দেখেন যে আপনার বক্তব্যকে অন্যভাবে প্রকাশ করে আপনাকেই দোষী বানানো হচ্ছে, আপনার ইচ্ছাশক্তি অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তবে সাবধান হোন। সম্পর্কটি নিয়ে নতুন করে ভাবুন।
সেক্সচুয়াল প্রেডিটার বা যৌন শিকারিদের কথাবার্তার মধ্যে আপনি এক ধরনের লোকদেখানো হামবড়া ভাব দেখতে পাবেন। এরা এদের কাজের দায়িত্ব নেয় না। কোন ঝামেলা হলে নিজেকে ভিকটিম বানিয়ে অপরপক্ষেকে দোষী সাব্যস্ত করে। এবং এই করতে গিয়ে অপরপক্ষকে অপমান করতেও ছাড়ে না। এ ধরনের সম্পর্কে শিকার যখন সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়েন তখন শিকারি তার আসল রূপ দেখাতে শুরু করে। সঙ্গীর চিন্তা, অনুভূতি এসবের প্রতি তার কোন গুরুত্ব থাকে না। সব সময় আমি আমি। আমার কষ্ট, আমার দুঃখ, আমার ঝামেলা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সঙ্গীকে এক ধরনের ইনসিকিউরিটি এর মধ্যে রাখে এবং প্রয়োজনে অবমাননা/হেনস্থা করতে দ্বিধাবোধ করে না।
সম্পর্কের বয়স যখন আরো বাড়ে তখন এই ধরনের সেক্সচুয়াল প্রেডিটারদের ব্যবহারও পাল্টাতে থাকে দ্রুত। সঙ্গী বা শিকারকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নির্যাতন করতে শুরু করে। তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সেই ঠিক আর সব বেঠিক এটা মানতে বাধ্য করে। ভাবতে বাধ্য করে যে তার (শিকার) অনেক সৌভাগ্য যে সে তার (শিকারির) মত একজনকে জীবনে পেয়েছে। সঙ্গীর/শিকারের আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় গুড়ো গুড়ো করে ভেঙে দেয়। এবং এই পর্যায়ে এইসব যৌন শিকারিরা তাদের নতুন শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ততদিনে শিকার শারীরিক এবং মানসিকভাবে হতোদ্যম, অসহায়, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষে পরিণত হয়। এই দুঃসহ পর্যায়ে আসার আগেই সাবধান হউন। বেরিয়ে আসুন এই ধরণের সম্পর্ক থেকে। দরকার হলে আইন বা পরিবার/বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য নিন। আপানার পরিচিত কেউ যদি এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে বুঝতে পারেন তাকে সাহায্য করুন।
মনে রাখবেন আইন দিয়ে এসব প্রেডিটারদের ধরা খুব কঠিন। নানা ছলচাতুরি করে, টাকা পয়সা খাইয়ে এরা হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। তাই যতটুকু সম্ভব নিজেদের সাবধানে থাকা দরকার যেন এদের ট্র্যাপে কেউ পা না দেই ।
মুনিয়ার মৃত্যুর জট এখনো খোলেনি, অথচ সেক্সচুয়াল প্রেডিটার আনভীরকে বাঁচানোর চেষ্টা আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। কাজ হবে না জানি, তবুও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম। তীব্র থেকে তীব্রতর ঘৃণা এসব যৌন শিকারিদের প্রতি। মুনিয়াদের আত্মারা শান্তি পাক আর অনন্ত নরকের জ্বলুক এইসব প্রবঞ্চক রাক্ষসেরা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]