সাবু’র ফর্সা হতে চাওয়া ক্রেতাদের মানসিকতাকে সিলগালা করবেন কীভাবে?
নাহিদা নিশি।। কোরবানি ঈদে বাড়িতে এসে যারা গরু-ছাগলের চামড়াগুলো নিয়ে যেতো, ছোটবেলায় তাদেরকেই শুধুমাত্র চামড়া ব্যবসায়ী ভাবতাম। বড় হওয়ার পর ভুল ভাঙলো। দেখলাম, মানুষের চামড়া নিয়ে করা ব্যবসার ধারে কাছেও কোরবানির চামড়া ব্যবসা যেতে পারে না। হ্যাঁ, যারা আমার-আপনার ত্বক নিয়ে নোংরা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছে, সৌন্দর্য সম্বন্ধে ভুল মেসেজ দিয়ে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করছে, তারা চামড়া ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালেই ত্বক ফর্সা করার পেছনে বিশ্বব্যপী ৮.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে যা ২০২৭ সালে গিয়ে ১২.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। এশিয়ার দেশগুলির প্রায় ৪০ শতাংশ নারী এই ধরনের ফেয়ারনেস প্রোডাক্ট ব্যবহার করে থাকেন। দেখা যাচ্ছে, ইউনিলিভার কোম্পানি ভারতে বছরে ২৪ বিলিয়ন রুপি আয় করে শুধুমাত্র ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ (গ্লো এন্ড লাভলী) ক্রিম বিক্রির মাধ্যমে।
এই যে, মানুষজন ত্বক ফর্সা করার চেষ্টায় পাগল হয়ে আছে, ত্বক ফর্সা করতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করছে, এর পেছনে কারণ কী? এই দায় কার?
কোনো মানুষ জন্মের পরপরই তো ফর্সা হওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগে না। প্রথম ধাক্কাটা খায় পরিবার থেকেই। বাচ্চা’কে কোলে নিয়ে পরিবারের লোকজন প্রথম যে মন্তব্যটা করে, তা বেশিরভাগ সময়ই হয় গায়ের রঙ’কে কেন্দ্র করে। বড় হওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের মন্তব্য তো আছেই। ফর্সা হলে, ‘কী মাখিস বলতো, এতো সুন্দর কীভাবে হয় একজন মানুষ!’ আর কালো হলে, ‘এতো কালো হইছিস ক্যান! গায়ের রঙ একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এটা ট্রাই করে দ্যাখ’।
এসবের পেছনে অবশ্য মিডিয়ার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ‘গায়ের রঙ ফর্সা না হলে ভালো বিয়ে হয় না, গায়ের রঙ ফর্সা না হলে ভালো চাকরি হয় না, কালো মেয়েদের কেউ পছন্দ করে না’ এরকম অসংখ্য বিশ্রী বিশ্রী ধারণা আমরা যুগ যুগ ধরে মিডিয়ার মাধ্যমেই পেয়ে আসছি।
ঢাকার প্রথম সারির একটি ঘটকালি প্রতিষ্ঠান বলছে যে, শতকরা ৯০ ভাগ পাত্রপক্ষ এসে বলে ‘ফর্সা মেয়ে চাই’। ফর্সা স্ত্রী চাওয়ার প্রধান কারণ হলো, স্ত্রী কালো হলে সন্তানও কালো হতে পারে। অন্যদিকে বিউটিশিয়ানরা বলছেন, বেশিরভাগ নারীই তাদের কাছে এমন সেবা নিতে আসে, যেটাতে দ্রুত ফর্সা হওয়া যায়। এমনকি যারা ফর্সা, তারা আরও ফর্সা হতে চায়। একজন আরেকজনের চেয়ে বেশি ফর্সা হওয়ার চেষ্টা করে।
শুধুমাত্র ফর্সা ত্বক দিয়ে কিছুই হয়না শেষপর্যন্ত, বড়জোর একটা ছোটখাটো চাকরিজীবী জামাই জোটানো যায়। একটু আশেপাশে চোখ বুলালেই দেখবেন, অনেক ফর্সা নারী আছেন, যারা মেধা-যোগ্যতা বা দক্ষতায় তেমন কিছুই করে উঠতে পারেননি; আবার হাজার হাজার নারী আছেন যাদের গায়ের রঙ কালো, যারা মেধা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছেন।
অপরা উইনফ্রে, তিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধনী আফ্রিকান মার্কিন। এ নিয়ে মোট পাঁচবার ফোর্বস কর্তৃক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী নির্বাচিত হয়েছেন।
মায়া অ্যাঞ্জেলো, তিনি ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি অত্যন্ত দরিদ্র একটি পরিবার থেকে উঠে এসে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, যার লেখা বিশ্বব্যাপী নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির আওতাভুক্ত করা হয়েছে। মেধা এবং যোগ্যতাই যে শেষ কথা, ইচ্ছাশক্তি থাকলে গায়ের রঙ যে কোনোকিছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, টনি মরিসন, অ্যালিস ওয়াকার, অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এর মতো অসংখ্য নারীরা তার প্রমান।
যাই হোক, আসল কথায় আসি। স্যোশাল মিডিয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে একটি আলোচিত পেইজ ‘সাবু শপ’ (সাহস নিয়ে পেইজের নাম লিখলাম, শুনেছি উনার পোস্টে হাসির রিয়্যাক্ট দিলেও নাকি উনি মানহানির মামলা করে দেন) নিয়ে প্রচুর ট্রল চোখে পড়ে। কৌতূহলবশত একদিন সেই পেইজে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করলাম। দেখলাম, কোনো যা তা পেইজ না। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় তিন তিনটা শো-রুম আছে তাদের। রঙ ফর্সাকারী প্রোডাক্টের শো-রুম। মুখ থেকে শুরু করে গোপনাঙ্গ পর্যন্ত ,সমস্ত কিছু ফর্সা করার প্রোডাক্ট। ক্রিম, সাবান, লোশন, তেল, ত্বক ফর্সাকারী জুস, কফি, ট্যাবলেট সবই পাওয়া যায় সেখানে। পেইজের মালিক জানিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য খুবই মহৎ। তিনি মনে প্রাণে চান যে, বাংলাদেশের সব মেয়েরা তার মতো সাদা পরী হয়ে যাক, দেশে একটাও কালো মেয়ে না থাকুক! ওনার এসব কথা-বার্তা শুনে প্রথমদিকে খুব হাসি পেতো। মজা পেতাম। পরবর্তীতে ভেবে দেখলাম, ব্যাপারটাকে আর হালকা বিনোদন হিসেবে নেয়া যায় না।
একটা ভিডিওতে দেখেছি, উনি একটা ক্রিম হাতে নিয়ে বলছেন, “এই ক্রিম কোনো সাধারণ ক্রিম নয়। এটি থেরাপির মতো কাজ করে। এই ক্রিম ইউজ করে প্যারালাইজড রোগী সুস্থ হয়ে গেছে। এই ক্রিম ইউজ করে ট্যারা চোখও সোজা হয়ে গেছে। যাদের বাচ্চা হতো না, এই ক্রিম পেটে মাখার পর তাদের বাচ্চাও হয়ে গেছে”।
কোনো সুস্থ মানুষ এসব বলতে পারে? নাকি কোনো সুস্থ মানুষ এসব বিশ্বাস করতে পারে? হুজুরের পানি পড়ার চেয়েও বাজে অবস্থা এই ক্রিমের, একের ভিতর হাজারটা সমাধান।
একটু আগে শুনলাম, সাবু শপের একাধিক শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়েছে, খুবই ভালো কথা। কিন্তু ওনার যারা কাস্টমার, ফ্যান-ফলোয়ার, তাদের মানসিকতা’কে সিলগালা করার উপায় আছে কোনো? ১৫-১৬ হাজার মানুষ একইসময়ে ওই পেজের লাইভ দেখে। প্রতিটা ভিডিওর টোটাল ভিউ হয় প্রায় ৩-৪ লাখ। এইদেশে কী পরিমাণ মেয়েরা ফর্সা হওয়ার চেষ্টায় পাগল হয়ে আছে, চিন্তা করা যায়! তিনি কারো টাকা মেরে দিছেন কি না, উনার প্রোডাক্ট নিয়ে কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সেসব অন্য আলাপ। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ আছে, যারা এইসব ত্বক ফর্সাকারী প্রোডাক্টের জন্য অগ্রিম পেমেন্ট করে রাখে। প্রোডাক্ট আসতে না আসতেই নাকি স্টকআউট হয়ে যায়! মারামারি, কাড়াকাড়ি লেগে যায় প্রোডাক্ট নিয়ে! এটা সত্যিই চিন্তার বিষয়।
এসবের শেষ কোথায়? কেউ যদি ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রি করে, তাতে আমাদের কিছু বলার নাই, যেহেতু বাংলাদেশে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম নিষিদ্ধ না। কিন্তু লাইভে এসে কালো মেয়েদের উদ্দেশ্যে নোংরা নোংরা কথা বলা, কালো মেয়েদের পেত্নী, শাকচুন্নী বলে ছোট করা, কালো মানুষদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করা, এগুলো তো চরম অপরাধ। এরকম হেইট স্পিচের মাধ্যমে কতো মেয়ের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিচ্ছে, তা কি এনারা কখনো ভেবে দেখেছেন? ক্রিম ইউজ করে কালো ত্বক হয়তো ফর্সা করা যায়, কিন্তু ভেঙে যাওয়া আত্মবিশ্বাস? সেটা তো জোড়া লাগানো যায় না!
গতোবছর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পাশের দেশের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, দীপিকা পাড়ুকোন, কঙ্গনা রানাউতসহ অসংখ্য অভিনেত্রী জানিয়েছেন, তারা ভবিষ্যতে আর কখনোই কোনো ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন করবেন না। বলিউডের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকারা যেখানে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের অফার ছেড়ে দিয়েছেন, সেখানে আমাদের দেশের নায়িকারা ত্বক ফর্সাকারী প্রোডাক্টের পক্ষে কথা বলছেন, শো-রুম উদ্বোধন করছেন। দেশের নামকরা টিভি চ্যানেলগুলো আবার লাইন ধরে সেই নিউজ সম্প্রচার করছে। বর্তমান বিশ্বে বর্ণবৈষম্য’কে যে অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেটা আমরা কবে বুঝবো?
মানুষের গায়ের রঙ কালো, সাদা, বাদামী যে কোনোটা হতে পারে, কোনো রঙই সুপিরিয়র হতে পারে না। নিজেকে আধুনিক মানুষ বলে দাবি করতে চাইলে আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সমস্ত দোষ-গুণ’কে সরিয়ে রেখে মানুষকে তার রঙ দিয়ে বিচার করার এই নোংরা সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এইসব ব্যবসায়ীদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে বদল আনতে হবে। রেসিজম’কে ‘না’ বলতে হবে।
অ্যাঞ্জেলা ডেভিস বলেন, “বর্ণবাদী সমাজে বর্ণবাদহীন হওয়াই যথেষ্ট নয়, আমাদের অবশ্যই বর্ণবাদ-বিরোধী হতে হবে”।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]