November 24, 2024
সম্পাদকীয়

আতাউর নামের একজন বাবা ও আমাদের ঈদের আনন্দ

শারমিন শামস্।। দুই মেয়ে আর এক ছেলের জন্য ঈদের নতুন জামা কিনে ব্যাগে ভরেছিলেন কারখানার শ্রমিক আতাউর মিয়াঁ। আরেকটা ব্যাগে নিজের নিত্য ব্যবহারের কাপড়। সকাল ৭টায় পদ্মাপারের জন্য মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়াঘাটে ঘাটে এসে দেখেন হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ফেরির অপেক্ষায়। তীব্র রোদ, গরম। এর ভেতরেই ভিড় ঠেলে এগোন তিনি, বুকের কাছে ধরে রাখেন মহামূল্যবান দুই ব্যাগ। ফেরির কাছে যেতে শুরু করেন।

বহু কষ্টে ফেরিতে উঠতে পারেন। ব্যাগ দুটোর একটা একবারে কিনারে রাখেন। আরেকটা রাখার চেষ্টা করছেন, এমন সময় জলে পড়ে যায় ব্যাগ। কোনো কিছু ভাববার অবকাশ ছিল না শ্রমিক বাবার। ফেরি থেকে জলে ঝাঁপ দেন সঙ্গে সঙ্গে। যেকোনো উপায়ে ব্যাগ বাঁচাতে হবে, ব্যাগের ভেতরে সন্তানদের জন্য কেনা ঈদের খুশি।

কিন্তু দুটো ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে সাঁতরে তীরে উঠতে পারছিলেন না। রোজা রেখে ভোর থেকে রোদের মধ্যে দাঁড়ানো। সাঁতরে সামনে যেতে পারছিলেন না। এদিকে ঘাটে হাজার হাজার মানুষ, নতুন করেও আর ফেরিতে উঠতে পারবেন না। দূর থেকে তাকে দেখে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালিয়ে তাকে উদ্ধার করেন নৌকার চালক মাঝহারুল ইসলাম। উদ্ধার হবার পর শুধুই কাঁদছিলেন আতাউর। সাংবাদিকদের বলেছেন,  ‘এতো কষ্ট করে ফেরিতে উঠেও ব্যর্থ হলাম, তাই কান্না চলে আসছিল।’

করোনা, লকডাউন, গণপরিবহন বন্ধ, সবকিছু উপেক্ষা করে বাড়ি ফেরা, এসব তো আছেই। তবু জীবন ঠিক তেমন, যেমনটা সবসময় ছিল এই পোড়া বঙ্গদেশে। শ্রমিক বাবার সামান্য অর্থে কেনা শিশুদের নতুন পোশাক, খা খা রোদ, নিদারুন ভিড় উপেক্ষা করে বাড়ি ফেরা, সন্তানদের হাতে নতুন পোশাক তুলে দেবার খুব সামান্য আনন্দ! হয়তো আপনাদের খুব রাগ হচ্ছে, খুব গালি দিচ্ছেন ওই মানুষগুলোকে যারা ঈদে ফেরিতে চেপে, ভিড়ে পিষে মরেও বাড়ি যায়। কিন্তু আপনাদের গালির দৌড় কি সেই অব্দি পৌঁছায়, সেই তাদের কাছে, যারা মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার কিংবা প্লেনে করে ফিরছেন বাড়ি, দামি লাগেজে যারা ভরে নিয়েছেন দামি শপিং মল থেকে কেনা মখমলের শাড়ি পাঞ্জাবি, সন্তানের লেহেঙ্গা, শার্ট প্যান্ট জুতো! যাদের নতুন জামার ব্যাগ হাত ছিটকে জলে পড়ে যায় না, যাদের লাফিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় না সন্তানদের জন্য কিনে নেয়া হাসিখুশি উদ্ধারে!

আতাউর, আপনাকে বলবার কিছুই নেই আমাদের। আপনি এই বাংলাদেশের লাখ লাখ দরিদ্র বাবাদের একজন, যারা রক্তজল করা টাকায় একমুঠো খুশি কিনে বাড়ি যেতে চাইছেন। যাদের সচেতনতা নেই, যাদের সচেতন করার দায়ও কারুর নেই। যাদের কাছে করোনার চেয়ে দুই মুঠো ভাতের অভাবে মরার মতো বেঁচে থাকাটা বেশি আতংকের! আপনার ঈদ কেমন হবে জানি না। কিন্তু আপনার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংবাদ আমার ঈদের সব আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে।