আমাদের জীবনের ‘হোয়াইট টাইগার’রা
সেঁজুতি জাহান জিনাত।। আদর্শ গৌরবের অভিনয়ের ব্যাপারে কোনো ত্রুটির কথা বলার নাই। একেবারে রিয়েল ‘হোয়াইট টাইগার’ এর অভিনয় করেছে সে। দুর্দান্ত আনুগত্য এবং অভাবনীয় খুন, তাও আবার একটি ধনাঢ্য ক্রিমিনাল পরিবারের সব থেকে নিরীহ ও ভদ্র ছেলেটিকে।
এই উদ্দেশ্য প্রণোদিত আনুগত্য সাংঘাতিক ভয়ের বিষয়। আপনি ওই ধনাঢ্য ‘ দ্যা স্টোর্ক’ পরিবারের মতো নাও হন, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে সাংঘাতিকভাবে দ্রবীভূত বা আপনার ধর্মপ্রাণ আত্মা অথবা আপনার মানবিক চেতনাটি এই আনুগত্যের ফাঁদে যদি একবার পড়ে তাহলে জৈবিক বা মানসিকভাবে খুন হয়ে যাওয়াই আপনার একমাত্র পরিণতি।
‘হোয়াইট টাইগার’রা তুলনামূলক স্বচ্ছল পরিবার দেখলেই মনে করবে তাদের অনেক অবৈধ টাকা। না হলেও তাদেরকে দেবার মতো প্রচুর টাকা আছে, ইচ্ছা করে দেয় না। ফলে, ধরেন গার্মেন্টসের বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ঊর্ধতন কর্মচারি না হয়েও যদি কেউ মোবাইল বা হালকা পাতলা ব্যবসায়ী হন, অথবা যেকোনোভাবে একটু স্বচ্ছল জীবন যাপন করেন, তাহলেও এরা আপনাকে ওই গার্মেন্টস মালিকের কিংবা দুই নাম্বারি ধনাঢ্যের ক্যাটাগরিতে ফেলে দিয়ে আপনাকে নিয়ে ফুটবল খেলবে।
ভাবছেন নিরীহ অশিক্ষিত শ্রেণি, তারা আবার শিক্ষিতদেরকে নিয়ে কীভাবে ফুটবল খেলবে?
নিশ্চই ভাবছেন?
সুমন রহমানের ‘নিরপরাধ ঘুম’ গল্পের বইয়ের ‘সুপারহিরো পরিবারে…’ নামের একটি গল্প আছে। সেখানে একজন গৃহপরিচারিকার কৃতকর্ম এবং তার ফলে একটি পরিবারের শিশুর ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। সুমন রহমান একজন সমাজ সচেতন কবি, লেখক এবং শিক্ষক। ‘হোয়াইট টাইগার’ শ্রেণির অপকর্মের ব্যাপারে এমন একটা গল্প তিনি কীভাবে লিখতে পারলেন এবং সেটি ওই গল্পের বইয়ের শীর্ষ গল্পগুলোর মধ্যের একটিও হয়ে গেল, কী করে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁকে, সমাজের এমন ডিফোকাসে থাকা ব্যাপারটি আপনি ক্যাম্নে এতো নিখুঁতভাবে তুলে ধরলেন?
জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, এই শ্রেণির লোকেরা কী করতে পারে আমাদের ধারণা নাই। এদের অনেকেই অনেক ডেঞ্জারাস হয়।
সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মীয় চেতনার একটি পাকাপোক্ত অবস্থানে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়ে আমরা ‘হোয়াইট টাইগার’দের অনেক কিছুই ওভারলুক করে যাই। মনে করি, থাক গরীব মানুষ তো!
কর্মজীবী নারীদের মধ্যে এমন একজনকে পাওয়া যাবে না, যে এদের ‘টাইগারিং’ এর শিকার হননি। গৃহিণীদেরকেও নিয়ে হরেক রকমের খেলা খেলে। এদের কেউ কেউ ঘরের গিন্নির সামনে খুবই আনুগত্য দেখাবে, প্রকৃতভাবে অনুগত থাকবে পুরুষ সদস্যদের প্রতি (গৃহকর্তা ও তার ছেলে সন্তান)। পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো গৃহকর্তা নাই যিনি গৃহকর্ত্রীর চেয়ে অনেক ভালো হয়ে থাকেন (যে সব গৃহকর্তারা রান্নাঘর, গাড়ি বা যেকোনো কাজ বোঝেন ও কাজের দুই নাম্বারিগুলো ধরতে পারেন এবং ধরেন; তারা বাদে)!
এমনও দেখেছি, বাড়ির নারীটির বাপের বাড়ির লোকজনের চেয়ে এরা পুরুষটির বাপের বাড়ির লোকজনকে বেশি আকাঙ্ক্ষা করে, যাতে কিছু প্রিয়-অপ্রিয় কথা আদান প্রদান করে গৃহকর্ত্রীকে চাপে রাখা যায় এবং গৃহকর্তার বাপের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে আরেক রকম কিছু বলে কিছু বকশিস কামাই করা যায়।
আপনি গৃহিণী হন কিংবা কর্মজীবী এইসব ‘হোয়াইট টাইগার’দের এইসব কৌশল আপনার পরিবারে খুব পরোক্ষ হলেও খুব গভীর প্রভাব ফেলে। হয়ত আপনি টের পান, না হয় বুঝতে পেরেও নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে চেপে যান।
আপনি যতোই দিল দরিয়া হোন না কেন, সেজন্য প্রকাশ্যে আপনার প্রতি একনিষ্ঠতা দেখালেও গোপনে আপনাকে কোথায় নিয়ে ছেড়ে দেয় তা আপনি ধারণাই করতে পারবেন না।
আর একশ্রেণির গৃহকর্ত্রী আছেন যারা এই ‘টাইগার’দের বানোয়াট গল্পগুলোতে নিজেদের হীনন্মন্য মনের ক্রান্তি দূর করার জন্য ভাগ বসান। তারা টেরও পান না এরা তাদেরকে নিয়েও একই গল্প অন্য জায়গায় করে। ফলে গৃহকর্ত্রীদের সবার পরিচয় প্রায় একই ফ্লেভারে এদের কাছ থেকে পাবেন।
বিবেক মতো এদের ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে বলরামদের মতো ‘হোয়াইট টাইগার’এর ‘আনুগত্যময়’ ফাঁদ ঠিক কীভাবে সমাজে কাজ করে সেটা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। বইয়ের অক্ষরে কিংবা রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এমন ‘টাইগারিং’ এর শিকার হয়ে মরে গেলে আপনার মানব জনম আপনাকে কী দিল বলে ভাববেন?
সমাজের সমতা আনার জন্য সব ধরনের শঠতাকে হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে নিজেকেই একদিন সে হাতিয়ায়ারের মোক্ষম শিকার করে তুলতে হবে।
এবং সে দিন খুব বেশি দূরে নাই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]