November 21, 2024
কলামফিচার ২

রোজিনা ইসলামের কলম বনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

সুমাইয়া সেতু।। রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা খুবই চ্যালেঞ্জিং, আর যদি কোন নারী এই পেশা গ্রহণ করে তবে চ্যালেঞ্জটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সেই সব লড়াই লড়েই রোজিনা ইসলাম আজকে সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

সাংবাদিকতার রিপোর্টিং পার্টে অনেকের অনেক ধরনের লেখার প্রতি আকর্ষণ থাকে। আমরা দেখেছি যে রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী রিপোর্ট-এর প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল। সাংবাদিকতা বা আইনি পেশায় তথ্য শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে হলে যেকোন সাংবাদিকের তথ্যের প্রয়োজন হবে, আর সেই তথ্য সে কোন না কোন মাধ্যম থেকেই যোগাড় করবে। এভাবেই হয়ে আসছে অনুসন্ধানী রিপোর্ট। কিন্তু আমরা দেখলাম রোজিনা ইসলামকে আটক করে দীর্ঘ সময় মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করে তাকে পুলিশে দেওয়া হলো। এখন যদি প্রশ্ন করি এই ঘটনা কি অস্বাভাবিক? উত্তর হলো না। কারণ যে রিপোর্টগুলো রোজিনা ইসলাম তার অনুসন্ধানের মাধ্যমে তুলে আনছিলেন সেইগুলো কোনভাবেই সরকার বা তার মন্ত্রণালয়ের জন্যে ভালো ফল বয়ে আনত না। বরং এর মধ্যে দিয়ে আগামী দিনে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলনের সূচনা হতে পারত।

আমরা জানি এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সাংবাদিক নির্যাতন বা হত্যার কথা। সাগর-রুনীর সন্তান মেঘ বড় হয়ে যাচ্ছে বিচারের আশায়। একজন কাজলকে ভারতীয় বর্ডার থেকে পাওয়া গেল। লেখক মুশতাক আহাম্মেদ কে মরতে হলো জেলখানায়। এই প্রতিটি ঘটনার সাথে দুর্নীতির তথ্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রয়েছে কথা বলার বা বাক স্বাধীনতার সংশ্লিষ্টতা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো আসলে কতটা স্বাধীন তার পাশাপাশি এদেশের সাংবাদিকরাই বা কতোটা স্বাধীন এই প্রশ্নটি এখন অনেক বেশি আলোচিত হওয়া উচিত।

গণমাধ্যমের পরাধীনতার সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম ( রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারের তথ্য মতে)। এর একটা বড় কারণ এদেশের প্রচলিত আইনগুলো। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার জন্যে নানা ধরণের আইন রেডি করা আছে আমাদের দেশে। কখনো তথ্য প্রযুক্তি আইন, কখনো সুরক্ষা আইন, আবার কখনো বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই বার নতুন করে ব্যবহৃত হলো ”অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট”। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা তৈরি করা হয়েছে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার জন্যে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮,২১,২৫,২৮,২৯,৩১,৩২,৪৩ ধারার মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এই আইন পাশ হওয়ার আগেই এই বিষয়ে সাংবাদিকরা কথা বলেছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। ৮ ধারায় বলা হয়েছে যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মনে হয় কোন তথ্য তাদের কাছে হুমকিস্বরূপ তবে তারা সেই তথ্য অপসারণ করতে পারবে। ২৫ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে কোন লেখা প্রকাশ করে তবে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ৩১ ধারায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এমন তথ্য প্রকাশে বাধার কথা বলা হয়েছে। আর এই প্রত্যেকটি কাজকে অপরাধ বলে ধরে নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে। এই আইন যখন হয় তখন সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতিবাদ করে বলেছিল যে এই আইনের মাধ্যমে বৃটিশ আমলের “অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট” ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা মূলত গদি রক্ষার আইন। তথ্য আইন যদি মানুষের তথ্য প্রাপ্তির কথা বলে তবে এই আইন তথ্য আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করবে।

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় আমাদের। আবার এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর নামে সেই স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়ে থাকে। এই আইনের কারণে যেকোনো লেখক সাংবাদিকের নিজের মধ্যেই সেল্ফ সেন্সরশিপ তৈরি হয়ে যায়। তাই এদেশে অনুসন্ধানী রিপোর্ট খুব বেশি দেখা যায় না।

আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখবো তথ্য অধিকার আইনটিও সেই বৃটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় চলছে। সেখানেও মানুষের সব তথ্য পাওয়ার অধিকার আসলে নেই। কেমন যেন একটা লুকোচুরি নীতিতে চলে রাষ্ট্র। এবার যদি আসি এই সময়ের আলোচিত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ নিয়ে। যেই আইনটি ১৯২৩ সালে প্রনীত হয়েছিল বৃটিশ সরকার কর্তৃক। কারণ সেই সময়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্যে সরকারি নথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর সেই নথি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে পরলে সরকারের বিপদ হয়ে যেত। তাই এই আইন প্রনয়ণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইনের দুইটি শব্দ পরিবর্তন করে আইনটি রেখে দেওয়া হয়। যদিও এই আইন রেখে দেওয়ার কারণ ছিল না আর। তবে এর প্রয়োগ করা হয়নি এতোদিন। এই সময়ে এসে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলায় এই আইনের প্রয়োগ আমরা দেখতে পেলাম।

রোজিনা ইসলামের নামে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং ‘অফিস সিক্রেটস আইনের’ ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় রয়েছে চুরির অভিযোগ কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ ঘটনায় কোথাও রোজিনা ইসলামকে চুরি করতে দেখিনি, আর চুরির মামলায় দণ্ডবিধি কেন দিতে হলো! আবার “অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট” এর ৩ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির কথা রয়েছে, কিন্তু রোজিনা ইসলাম কোনো তথ্যই এদেশের শত্রু পক্ষের হাতে তুলে দেয় নি বরং দিতে চেয়েছিল জনগনের কাছে। তার মানে এই দাঁড়ায় যে এদেশের জনগন মন্ত্রণালয়ে থাকা সচিবদের কাছে শত্রুপক্ষ। আর ৫ ধারায় সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ নিষেধ ও কর্মকর্তাদের বেআইনী যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে। তার মানে যদি মামলা সত্যি ধরতে হয়, আজ থেকে সচিবালয়কে নিষিদ্ধ জায়গা হিসেবে ধরে নিতে হবে এদেশের জনগণের।

এতোদিন পরে এই আইনে একজন সাংবাদিককে হেনস্থা করা বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে সবাইকে। তথ্য অধিকার আইন ও আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক একটা আইনকে টিকিয়ে রাখাই বা কেন হয়েছে। আবার এই আইনটির ব্যাখ্যায় যেটা বোঝা যায় সেটি হলো এই আইন মূলত সরকারি কর্মচারিদের জন্যেই করা হয়েছিল যাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নথি বাইরে প্রকাশ না করে, কিন্তু সাংবাদিকের কাজই তো তথ্য সংগ্রহ করা আর তা প্রকাশ করা। জনগণের কাছে সত্য তুলে ধরা। আর অনুসন্ধানী কোনো রিপোর্ট এর জন্যে তথ্য সংগ্রহ করা মোটেও অন্যায় কিছু হতে পারে না।

যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্যে এই আইনের প্রয়োগ। তথ্য পাচার আর তথ্য অনুসন্ধান কখনোই এক বিষয় হতে পারেনা। তাই সর্বস্তরের মানুষ এই আইন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি তৈরি করার মধ্য দিয়ে অন্য সকল সাংবাদিকদের এক ধরণের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হলো, যাতে তারা সত্য প্রকাশে ভয় পায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে এদেশের আইন সবসময়ই এর পরিপন্থী। আবার সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আরো কম। কারণ বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ সংবাদপত্র ব্যাবসায়ীদের। এই ব্যবসায়ীরা আবার কোনো না কোনো দলের। তারা সাংবাদিকদের উপর এক ধরণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রুটি- রুজির ভয়ে তাই সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে পারে না। সাংবাদিকদের জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান যখন গণমাধ্যম থেকে হয় না তখন বাধ্য হয়ে তাদের অবস্থান নড়বড়ে করতে হয়।

বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি গুনগত মান। তাই ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা গণমাধ্যম তৈরি করেছে নিজেদের স্বার্থে। এখানে স্বাধীনভাবে লেখালেখির কোন সুযোগ তারা রাখেনি। একটা সময় মুসলিম লীগের পত্রিকায় বাম ঘরানার লেখা থাকতো নিয়মিত। এতোটা সহিষ্ণুতা মানুষের মাঝে ছিল। আর বর্তমান সময়ে এমন কিছু কল্পনাই করা যায় না। একদিকে সরকারিভাবে চাপিয়ে দেওয়া আইন, অপরদিকে মালিকের মন রক্ষা, চাকরি বাঁচানো এই সব কিছুর ভিড়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা কঠিন ব্যাপার হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও ঔপনিবেশিক আইনে চলা আমাদের কাছে লজ্জার। তবুও এই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন রোজিনা ইসলাম আমাদের পথ দেখায়। সব কিছুকে দূরে ঠেলে নির্ভয়ে অনুসন্ধান করে চলে সত্যের। আর এই সত্যই সামনের দিনে মানুষকে পথ দেখাবে একটা সুন্দর সমাজ বিনির্মানের। সকল গণমাধ্যম কর্মী তাই লড়াই করবে স্বাধীনভাবে লেখার জন্যে। কোনো আইন মানুষের সংগ্রামের পথে কোনদিন বাঁধা হতে পারে নি আর আগামীতেও পারবে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]