September 20, 2024
কলামফিচার ৩

‘রক্ষিতা’ শব্দপ্রয়োগ, ব্যক্তির ক্ষমা প্রার্থনা ও অন্তর্নিহিত নারীঘৃণা

উম্মে ফারহানা।। রাজু আলাউদ্দিন তাঁর নারীবিদ্বেষী বক্তব্য সংবলিত পোস্ট কিংবা পোস্টের প্রেক্ষিতে কমেন্ট ডিলিট করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে শব্দপ্রয়োগে তাঁর ভুল হয়েছিল। রাজু আলাউদ্দিনের ক্ষমাপ্রার্থনা যা প্রমাণ করে তা হলো, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে অপমান করতে গিয়ে তিনি যাদের লেখার প্রশংসা করেন তাদের সকলকে (নারী হলে) গোমেজের ‘রক্ষিতা’ বলা উচিৎ হয়নি- এই ব্যাপারটা তিনি ধরতে পেরেছেন। আলোচিত লেখক যদি সাগুফতা শারমিন তানিয়া না হয়ে কোনো পুরুষ লেখক হতেন তাহলে তাঁকে গোমেজের শিষ্য বা মুরিদ পর্যন্ত বলতেন আলাউদ্দিন। রক্ষিতা বলার অর্থ গোমেজ সেই নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত কিংবা সেই নারী লেখকরা গোমেজের প্রশংসা কিনতে তাঁর সঙ্গে শয্যায় গিয়ে থাকেন। এই বক্তব্য জেন্ডার ইনসেনসিটিভ কেন তা বোঝার ক্ষমতা আমার মনে হয় আমার ক্লাস নাইনে পড়া কন্যারও আছে।

ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি কেন একটু বিশদে বলি। গোমেজ কোনদিন আমার লেখা পড়েননি বলে, “যাক বাবা, আমাকে তো আর বলতে পারবে না” ভাবার অবকাশ নেই। আজকে আমি যদি তানিয়ার মতন ব্যাপকভাবে প্রকাশিত এবং প্রতিষ্ঠিত হতাম, আমাকেও এসব কথা শুনতে হতো বলে আমার ধারণা। ‘রক্ষিতা’র ধারণা সামন্ত ধারণা, পুরুষ অর্থের বিনিময়ে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক পুষলে সেই সম্পর্কিত নারীকে ‘রক্ষিতা’ বলা হয়। শুধুমাত্র যৌন আচরণ নিয়ে স্টিগমাটাইজ করাই ‘রক্ষিতা’ বলার উদ্দেশ্য- এমন মনে হতে পারে। এখানে প্রশংসাকারী পুরুষ এবং প্রশংসিত নারী উভয়েই বদনামের ভাগীদার।

ব্যাপারটা আদতে এত সরল নয়। নারীর মেধা এবং যোগ্যতাকে নিচু দেখাবার জন্য একথা বলা হয়। লক্ষ্য করুন, শিষ্য বা মুরিদ কিন্তু অপমানজনক নয় অতটা। সাহিত্যে গুরুশিষ্য সম্পর্ক চলতে পারে, সাধনা যেখানে দরকার সেখানে গুরু ধরা বা শিষ্যত্ব গ্রহণ কোন আপত্তিকর প্রক্রিয়া না। আবার এই শব্দ ব্যবহার না করেও নারী লেখকদের সম্পাদক বা প্রকাশকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকার সংকেত দিয়ে থাকে অনেকে। আর্থিক সংকটে থাকা নারী লেখককে একথা বলা আরো সহজ হয়। বটম লাইন এটাই যে, সেই নারীর লেখার কোনো সাহিত্যমূল্য নাই, কিংবা অন্য কোনো উপযোগিতা নাই। প্রকাশক/সম্পাদক/প্রতিষ্ঠিত কবি সেক্সের বিনিময়ে এই লেখকের লেখা ছাপছেন/প্রশংসা করছেন।

এই বক্তব্য দেওয়ার পর কারো যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয় তাহলে সেটা ভালো, সাধুবাদ জানাই। কিন্তু অনেকেরই এই বুদ্ধি নাই। তারা যে নারী লেখকের সঙ্গে তাদের বিবাদ বা দ্বিমত, তাদের সকলকে কোনো না কোনো প্রকাশক/সম্পাদকের ‘রক্ষিতা’ বলে থাকে। রাজু আলাউদ্দিনের মতন প্রকাশ্যে না বললেও, আড্ডা ইত্যাদিতে বলে। Jessa Crispin এর Why I am not a feminist গ্রন্থে তিনি বলছিলেন যে মিসোজিনির বিরুদ্ধে লড়াই ব্যক্তি ধরে ধরে করা যায় না। একজনের চাকরি চলে গেল, একজন ক্ষমা চাইলো- এসব কুইক ফিক্স সাময়িক শান্তি বা সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু এতে যা হবে তা হলো, এই ধরনের মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা সাবধান হয়ে যাবে, নারীবিদ্বেষী কথাবার্তার প্রমাণ রাখবে না। ক্রিস্পিনের মতে পুরো পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার। Men are not our problem অংশে তিনি বলছেন, পুরুষ আমাদের ‘সমস্যা’ নয় বলার মানে এই না যে পুরুষ আমাদের ‘দায়িত্ব’ নয়, পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে ঠেলা দিয়ে ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। সেই দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে একজনকে ক্ষমা চাওয়ানো, কিংবা কারো চাকরি খেয়ে দেওয়া কোন বাস্তবিক সুফল আনবে না।

তো, এখন কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। নারীবাদ সম্পর্কে অনেক জানেন, ব্লগে লেখালেখি করেন সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ইস্যুতে মতামতের বাছবিচার করেন এমন এক পুরুষ আমার বোন উম্মে রায়হানা মুমুকে কোনো এক সম্পাদক/প্রকাশকের ‘ফাকবাডি’ বলেছেন এক ঘরোয়া আড্ডায়। তার এই বক্তব্যটির প্রমাণ কোনোভাবে পাওয়া গেছে। শুনে যা বুঝলাম, তা হলো সরাসরি ‘রক্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার না করেও এমন ইঙ্গিত দেওয়া যায় যে একজন নারী যদি লেখক হতে চান তাহলে তাঁকে কোনো না কোনো পুরুষের সঙ্গে শয্যায় যেতে হবে। কাজেই টাকাপয়সার প্রয়োজন যদি সেই নারীর না থাকে কিংবা অন্য কোন উৎস থেকে তাঁর জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে তাহলে সরাসরি ‘রক্ষিতা’ শব্দটি ব্যবহার না করে অন্যভাবে বোঝানো যেতে পারে যে তিনি সম্পাদক/প্রকাশক/প্রশংসাকারী প্রতিষ্ঠিত পুরুষ কবি/লেখকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন। সোজা বাংলায় ‘নারী লেখক মাত্রেই পুরুষের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে লেখক হয়েছেন’- এই কথা প্রমাণ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না। এখন যার কথা বললাম তিনি বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী এবং স্বঘোষিত আইটি বিশেষজ্ঞ। এই যখন আমাদের ‘জ্ঞানী’ পুরুষদের অবস্থা, তখন নারীবাদীদের যুদ্ধ যে কত কঠিন তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই, জেসা ক্রিস্পিনের কথা মেনে নিলে সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীবিদ্বেষ বা মিসোজিনি সমূলে উৎপাটিত না হলে পরে এই ধরণের গণআদালতে ফেইসবুকের পাব্লিক পরিসরে ক্ষমা চাওয়ানো কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু আমি দুই একজনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করে দেখলাম যে তারা মনে করেন এতো মিসোজিনির প্রকাশ্য নগ্ন রূপটি কিছু হলেও মিইয়ে যাবে। রাজু আলাউদ্দিনের মতন বিশিষ্ট অনুবাদক এবং সাহিত্যব্যক্তিত্ব যেহেতু একজন নারীলেখকের সঙ্গে প্রশংসাকারী কবির সম্পর্ক নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে পার পাননি, কাজেই রাম শ্যাম যদু মধু পুরুষদের জন্য পার পাওয়া আরো শক্ত হবে। এ ধরনের বক্তব্য তখন তারা শুধু মনে মনেই আওড়াতে পারবেন। বলতে পারবেন না। এটা নারীবিদ্বেষ না কমালেও অন্তত এর প্রকাশটুকুকে সীমিত করতে পারবে।
জেসা ক্রিস্পিনের Why I am Not a Feminist: A Feminist Manifesto গ্রন্থের একটি বিস্তারিত আলোচনা লেখার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]