November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর সৌন্দর্য: পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া অসন্তোষ

নন্দিতা সিনহা।। সৌন্দর্য বিষয়টা আলোচনাতে আনলেই সাথে সাথে মানসপটে কোনো নারীই ভেসে ওঠে, যেন নারীর সাথেই সৌন্দর্য এক সুতোয় গাঁথা। যেন সৌন্দর্যের একচ্ছত্র চর্চা ও অধিকারটাও একমাত্র নারীরই। নারীই যেন সৌন্দর্যের আধার। আর এই মনমানসিকতা প্রায় সব সমাজের মানুষই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে, তারপর শেখে। সৌন্দর্য চর্চাটা বলতে গেলে পরিকল্পিতভাবেই নারীর কাঁধে চাপানো হয়েছে। এই সৌন্দর্যের চর্চা ও ধারণায় নারীকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে সমাজ সদা তৎপর। নারীকে আর কোনো কিছুর দিকেই এতটা সজাগ তৎপর থাকতে হয় না যতটা তাকে থাকতে হয় নিজের সৌন্দর্যচর্চা নিয়ে। সেই সৌন্দর্যধারণায় নারী এমনভাবে পায়ের নখ থেকে মাথা পর্যন্ত আটকা পড়ে যে জগত সংসারে সবকিছুর উপরে স্থান পায় তার সৌন্দর্যচিন্তা। পুরুষের বেলায় সৌন্দর্যচিন্তাটা এতটা গুরুত্ব না পেলেও  নারীর বেলায় সেটা প্রকট।

মেয়ে শিশুর জন্মের পর থেকে জ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত মা মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে আর সে উদ্বিগ্নতা মেয়ে সারাজীবন বহন করে। সেখান থেকে বের হওয়াটা অনেকাংশেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। নারীর সৌন্দর্যচর্চা ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ  কাজ করার আছে সেটা অধিকাংশ নারীই ভাবতে পারে না।

নারীর অলংকার, প্রসাধনী ও আভরণে নারীর দাসত্ব সরাসরি সম্পৃক্ত। আর নারী সেই দাসত্ব পরম সাদরেই গ্রহণ করে। এই সৌন্দর্য উপকরণে দাসত্বের সম্পৃক্ততার ভাবনাটা নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গত উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি নারীর হাতের চুড়ি, বালা, পায়ের মল, নাকের নথ, গলার অলংকারকে জেলখানার কয়েদীদের গায়ে চড়ানো বন্দীত্বে সহায়ক বিভিন্ন সরঞ্জামের সাথে চমৎকার মিল দেখিয়েছিলেন, যা যথার্থও। জার্মেইন গ্রিয়া তার ‘ফিমেল ইউনাক’ গ্রন্থে নারীর বহুল ব্যবহৃত হাইহিল জুতো সম্পর্কে বলেছেন, পুরুষ যখন নারীকে আক্রমণ করে তখন নারী সর্বপ্রথম দৌঁড়াতে চেষ্টা করে, পুরুষের আক্রমণ কালে নারী যেন দৌঁড়াতে না পারে সেই জন্যই এই হাইহিল জুতোর উদ্ভাবন।

অলক্ষ্যে থেকেও নারীর  গতিবিধি জানার জন্য নারীর পায়ে মল পরানোর প্রথা চালু হয়েছিল। আর সেই মল পায়ে দিয়ে নারী ভেবেছে তার পায়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেলো। সেই প্রাগৈতিহাসিককালে যখন পুরুষ নারীকে ঘরে আবদ্ধ করলো, সেইদিন থেকেই আজ পর্যন্ত ৯৯ শতাংশ নারী অসচেতনভাবে এইসব অলংকার ও আভরণের প্রতি উচ্চমাত্রার অনুরাগী। কিন্তু একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, শৃঙ্খল স্বর্ণের হোক বা লৌহের, শৃঙ্খল শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলই।

এসব ছাড়ায় নানা ধরনের ও আঙ্গিকের রূপচর্চার সামগ্রী রয়েছে, যেগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধণের সত্য মিথ্যা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে, এমনকি সে পণ্যগুলোতে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থও বিদ্যমান থাকে। কিন্তু নারী তার সৌন্দর্যচিন্তায় এতটাই নিমগ্ন থাকে যে সেসব প্রোডাক্ট ব্যবহারেও পিছপা হয় না। বস্তুত অনেক নারী মুখিয়েই থাকেন কখন কোন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসছে সেটা জানার ও ব্যবহার করার জন্য। এই পুরো ব্যাপারটায় থাকা আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির কথাটা আর নাই বা বললাম।

পাড়া মহল্লা বা শহরের রাস্তায় চলতে গেলে কিছু হকার চোখে পড়েন, যারা শুধুমাত্র  মেয়েদের ব্যবহারের জিনিসপত্রই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেখানে থাকা তিন চতুর্থাংশ জিনিসই জীবনধারণের জন্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এই নিষ্প্রয়োজন অপশনাল সামগ্রীগুলোই নারীরা আগ্রহের সাথে কিনে থাকেন, আর সেইসব সামগ্রীর উপযোগীতা নারীর কাছে এত বেশি যে একজন হকার সেগুলো বিক্রি করেই জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে নামতে সাহস রাখেন। অবশ্য এখানে দোষটা হকারকে  কোনোভাবেই দেওয়া যায় না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ধনিক বুর্জোয়াশ্রেণির সামনে হকার একজন প্রলেতারিয়েত মাত্র। আর নারীও। নারী শোষনের বেলায়  পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদ মিলেমিশে একাকার হয়েই নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। একদিকে পুরুষ নারীকে অলংকার ও প্রসাধনী অর্থাৎ একচেটিয়াভাবে পুরুষের এক মনগড়া সৌন্দর্যধরণায় নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অবদমিত করে রেখেছে, আর অন্যদিকে পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা নারীর কাছে হরেক রকমের নিষ্প্রয়োজনীয় ও ভুয়া পণ্য, যা এই পুরুষতান্ত্রিক সৌন্দর্যধারণায় প্রয়োজনীয় ও সহায়ক, তা বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে গত এক দশক আগে রূপচর্চা ও ফ্যাশনজগতে যে ধারার ও যে আঙ্গিকের সৌন্দর্যধারণা চালু ছিল আজকের দিনে সেটার আর বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই, সম্পূর্ণ নতুন ধারা ও আঙ্গিকের সৌন্দর্যধারণা স্থান দখল করে নিয়েছে। এটিও পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার এক কৌশলমাত্র। সাধারণ আয়ের মানুষ যখন বর্তমানের ফ্যাশন অনুযায়ী জিনিসপত্র কেনে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটার ব্যবহার  কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত বা এর বেশি চালাতে পারে। সেই সময়টায় ওই ক্রেতারা ওই সামগ্রী কেনা থেকে বিরত থাকার ফলে পণ্য অবিক্রিত থাকে যার ফলে উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাজারে নিত্যনতুন ধাচ ও ফ্যাশনের জিনিসপত্রের উদয় হয়। আর ক্রেতারাও ওই ফ্যাশনস্রোতে ভেসে সারাবছরই কেনার উপর থাকেন। প্রায়ই বিক্রেতাগোষ্ঠী পণ্য বিক্রয়কালে জাতীয়তাবোধ, ঐতিহ্যবোধ, সংস্কৃতিবোধ ইত্যাদি বিভিন্ন চেতনার দোহাই দিয়ে বিক্রির হার সুকৌশলে বাড়িয়ে থাকেন। আর এই কৌশলটা পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা নারীর উপরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করে থাকে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অত্যন্ত সুকৌশলে নারীর শরীরের উপর নারীর এক অসীম অসন্তোষ তৈরি করে। নিজের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নারীর মনে হীনমন্যতার কোনো শেষ নেই, সৌন্দর্য নামক এক মরীচিকার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় নারীকে। বস্তুত এই পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার এক বৃহৎ অংশই দাঁড়িয়ে আছে নারী শরীরের উপর নারীর ঘৃণা তৈরি করেই। তাই এই উৎপাদনবিমুখ সমাজব্যবস্থায় নারী পুরুষ ও হকার একই শোষণব্যবস্থার শোষিত প্রাণী।

এই পুরুষতান্ত্রিক সৌন্দর্যধারণার পেছনে নারীকে লেলিয়ে দিয়ে তাকে বাস্তব থেকে সরিয়ে অবদমিত করে রাখাটাও পুরুষতন্ত্রের  একটা কৌশল। এক্ষেত্রে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাল থেকে আজ পর্যন্ত রচিত হওয়া সাহিত্যও বেশ বড়সড় কৃতিত্বের দাবিদার। আমরা দেখি কবি সাহিত্যিকেরা চিরদিন নারীর সৌন্দর্যের প্রতি উচ্চ অনুরাগ দেখিয়েছেন ও প্রশংসা করেছেন। বহমান নদী, চঞ্চল ঝর্ণা, সুকোমল ফুল, চাঁদের আলো, উত্তাল সমুদ্রসহ আরো নানা উপমা ব্যবহার করে সৌন্দর্যের এক একচেটিয়া মানদণ্ড তৈরি করে নারীর সৌন্দর্যকে নারীর সর্বপ্রথম বিবেচ্য বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যুগ যুগ ধরে। আর মানুষকে তার যে গুণ বা বৈশিষ্ঠ্যের জন্য অ্যাপ্রিশিয়েট করা হয় মানুষ স্বভাবতই সে দিকটায় ঝুঁকে পড়ে, সেদিকটায় ধাবিত হয়।

আমাদের শৈশব থেকে কৈশোরের শেষ পর্যন্ত আমার বাবা আমাদের এই নারীসুলভ সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যধারণার বাইরে রেখেছিলেন, আমাদের মাথার চুলও তিন ইঞ্চির বেশি লম্বা হতে দিতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের বেড়ে ওঠার ওই সময়টায় সৌন্দর্যের পেছনে ছোটা মানেই জ্ঞানার্জনের পথ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া। তখন আমি সেটা তেমন না বুঝলেও আজ এতদিন পরে আমিও সেটা বিশ্বাস করি। এই পুরুষতন্ত্র চায়, নারী এই সৌন্দর্যধারণায় এমনভাবে ডুবে থাকুক যাতে তার হাজার বছরের অত্যাচারিত ও অবদমিত সত্তাটির মুক্তির চিন্তা তার মাথাতেই না আসে।

বিগত শতকের শেষের দিকে নারীবাদী আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তখনকার অনেক নারী মাথার চুল ছোট রাখাসহ যাবতীয় কৃত্রিম সৌন্দর্যসামগ্রী ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় ও ব্যক্তির সাথে সাথে চিন্তাভাবনা ও আদর্শেরও পরিবর্তন হয়। আর নারী-পুরুষের নিজের শরীরের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারটাও স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করে। তাই কে কী করবেন, কী ব্যবহার করবেন, কী না করবেন সেটা একমাত্র ব্যক্তির উপরই নির্ভর করে। অন্য কারো উপর নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সৌন্দর্যধারণায় সচেতন হয়েই জীবনাচার নির্বাচন করা উচিত। মানসিকতাটা এমন হওয়া উচিত যে, আমি যাই পরি, যাই ব্যবহার করি সেটা হবে একান্তই আমার নিজের সচেতন অভিরুচি, আর সেই অভিরুচি থেকেই আমি চাইলেই আমার সেই আবরণ ও আভরণ যেকোনো সময় ছুড়ে ফেলে দিতে পারি। সেটা যেন আমার নিজেরই সিদ্ধান্ত হয়। সাজলেও সাজবো একান্তই নিজের জন্য, অন্য কারো জন্য নয়, কারো কৌশলের লক্ষ্যবস্তু হয়ে নয়। সর্বহারা নারীর অন্তত নিজের শরীরটা নিজের থাক।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]